ভারত বায়োটেকের ‘কোভ্যাক্সিন’ এবং চীনের ‘আনুই জেফাই’ টিকার ট্রায়াল হতে পারে বাংলাদেশে৷ দুটি প্রস্তাবই বিবেচনা করা হচ্ছে৷ ট্রায়াল সফল হলে দুটি টিকাই স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশে উৎপাদন করা হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক মাহমুদ উজ জাহান ডয়চে ভেলেকে জানান, ভারত বায়েটেকের ‘কোভ্যাক্স’ টিকার বাংলাদেশে ট্রায়ালের একটা আবেদন তারা পেয়েছেন৷ এখন এথিকস কমিটি আবেদনটি পরীক্ষা করে দেখছে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা এথিক্যাল অনুমোদনের কাজটি করি৷ আর সেজন্য তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আর যা যা প্রয়োজন তার পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ এই কাজে ঠিক কতদিন লাগবে তা এখন বলা যাচ্ছে না৷’’
বাংলাদেশে ভারত বায়োটেকের পক্ষে ঠিক কারা এই আবেদন করেছেন তা তিনি জানাননি৷ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিডিডিআর,বি তাদের পক্ষে আবেদন করেছে৷ গত বছর তারা চীনের ‘সিনোভ্যাক্স’ ট্রায়ালের জন্যও আবেদন করেছিল৷ চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা স্থগিত করে দেয়৷ তিন মাস পরে অবশ্য অনুমতি দিলেও চীন টাকা চাওয়ায় আর ট্রায়াল হয়নি৷
আমরা এথিক্যাল অনুমোদনের কাজটি করি: মাহমুদ উজ জাহান, বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল
আইসিডিডিআর,বি -র একজন কর্মকর্তা জানান, তারা প্রটোকলটি জমা দিয়েছেন ভারত বায়োটেকের পক্ষে৷ তবে বাকি বিষয়গুলো এখানো চূড়ান্ত নয়৷ অনুমোদন পেলে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে উৎপাদন করা যেতে পারে৷ কিন্তু রপ্তানি করা যাবে না৷ কারণ, বাংলাদেশে উৎপাদিত কোনো ধরনের টিকা ডাব্লিউএইচও এখনো অনুমোদন দেয়নি৷ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান কলেরার টিকা উৎপাদন করে, কিন্তু রপ্তানি করতে পারে না৷
ভারতের ‘কোভ্যাক্সিন’ সেখানে সীমিত আকারে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল ছাড়াই৷ বাংলাদেশে এখন তারা তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল করতে চায়৷
এদিকে চীনের আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড তাদের উৎপাদিত করোনা টিকার তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল করতে চায় বাংলাদেশ৷ সরকারের নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পর তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাথে কাজ করছে৷ চীনা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আলোচনা চূড়ান্ত করতে দু-একদিনের মধ্যে ঢাকা আসতে পারেন৷
বিএসএমএমইউ-এর উপাচার্য ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তাদের ভ্যাকসিন এখানে ট্রায়ালে সম্মত হয়েছি৷ এখন ওদের কাছ থেকে আমরা বিভিন্ন তথ্য নিয়ে প্রটোকল তৈরির চেষ্টা করছি৷ চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে কত দিন লাগবে তা বলা যাচ্ছে না৷ সপ্তাহখানেক পর আমরা হয়তো কিছু বলতে পারবো৷’’
আমরা তাদের (চীনা প্রতিষ্ঠানের) ভ্যাকসিন এখানে ট্রায়ালে সম্মত হয়েছি: বিএসএমএমইউ উপাচার্য
তিনি জানান, কিছু ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে৷ এখানে ভ্যাকসিন তৈরির একটি প্ল্যান্টও করতে চেয়েছে৷
তবে সব কিছুর পর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেই কেবল টিকার হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করা যাবে৷
ভারত সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ এরইমধ্যে অক্সফোর্ডের ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে পেয়েছে৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিট চুক্তি মতো অক্সফোর্ডের আরো তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের প্রথম চালান ৫০ লাখ এ মাসের মধ্যেই পাঠাবে৷ ফেব্রুয়ারি মাসে টিকা দেয়া শুরু হওয়ার কথা৷ তবে এই মাসেই স্বল্প পরিসরে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করার পরিকল্পনা আছে৷
করোনা সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউ'র সাবেক উপাচার্য, ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘ভারত ও চীনের নতুন কোম্পানির টিকার ট্রায়াল এখানে হলে তাতে বাংলাদেশের মানুষের সুবিধাই হবে৷ যদি ট্রায়াল সফল হয় তাহলে আমরা ব্যবহার করতে পারবো৷’’
তবে তিনি বলেন, ‘‘সিনোভ্যাক্সের ট্রায়াল যদি উদ্দেশ্যমূলভাবে আটকে দেয়া না হতো, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ অনেক কম দামে এরইমধ্যে টিকা পেতো৷’’
তার মতে, বাংলাদেশে এখন টিকার প্রস্তুতি ভালোই বলা যায়৷ তবে কিছু মানুষ এই টিকা নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছে৷ মানুষের মধ্যে ভয় ছড়াচ্ছে, এটা ঠিক না৷ যে-কোনো টিকা নিতে গেলে কিছু জটিলতা হয়৷ সাধারণ মানুষকে সেটা বুঝাতে হবে৷
করোনা ভ্যাকসিনের যত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিশ্বের অনেক দেশে শুরু হয়েছে করোনার টিকাদান৷ তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী সেটি নিয়ে এখনও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
সাধারণ প্রতিক্রিয়া
যেকোন টিকারই সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে৷ যেমন, শরীরে ইনজেকশন দেয়ার স্থানটি লাল হয় বা ফুলে যায়৷ তিনদিনের মধ্যে অবসাদ, জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যাথা হতে পারে৷ তবে এর কোনটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ শরীরে টিকার কার্যকারিতা শুরু হলে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ অনুমোদন পাওয়া করোনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷
ছবি: Mark Lenninhan/AFP/Getty Images
গুরুতর প্রতিক্রিয়া
বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে৷ যেমন, যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচি চালুর পর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুইজনের অ্যালার্জি দেখা দেয়৷ দেশটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে সতর্ক করেছে৷ তবে সার্বিকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেই করোনার বিভিন্ন টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি, যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
টিকার উপাদান
সাধারণত টিকায় দুর্বল বা মৃত ভাইরাস থাকে৷ যার মাধ্যমে শরীর সেই ভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে৷ তবে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রথমবারের মতো এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি৷ এতে কোন ভাইরাস থাকে না৷ তার বদলে কোভিড-১৯ এর জীবাণুর ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিরূপ থাকে৷ তাই দুই ধরনের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দুই রকম হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
বায়োনটেক-ফাইজার
অনুমোদন পর্যায়ে বায়োনটেক-ফাইজার উদ্ভাবিত টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কোন কোন ক্ষেত্রে টিকা গ্রহীতা সাময়িক অবসাদ আর মাথা ব্যাথায় ভুগেছেন৷ এমআরএনএ ভ্যাকসিনটির ব্যবহার শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে একজন ও ব্রিটিনে দুইজনের ত্বক লাল হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল৷ যাদের অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে তাদেরকে সতর্ক করেছে বিট্রিশ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি৷
ছবি: Jacob King/REUTERS
মডার্না
বায়োনটেক-ফাইজারের মতোই এমআরএনএ ভিত্তিক মডার্নার টিকাটি৷ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকাগ্রহীতাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি৷ হালকা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো ছিল সাময়িক৷ তবে ১০ শতাংশ অবসাদে ভুগেছেন বলে জানিয়েছে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক প্যানেল৷ অল্প কয়েকজন রোগী অ্যালার্জি ও মুখের স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হওয়ার মতো জটিলতায় ভুগেছেন৷ তবে কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: Dado Ruvic/Reuters
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একজন মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভুগেছেন৷ সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর কিছুদিন ট্রায়াল বন্ধ ছিল৷ কিন্তু পরে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরীক্ষার পর জানিয়েছে সেটির কারণ ভ্যাকসিন নয়৷ এছাড়া টিকাটি নেয়ার পর ইনজেকশনের স্থানে ও পেশিতে ব্যথা, মাথাব্যাথা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম ছিল৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/J. Porzycki
স্পুটনিক ফাইভ
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরুর আগে গত আগস্টেই নিজেদের টিকা স্পুটনিক ফাইভ এর অনুমোদন দেয় রাশিয়া৷ দুই ধরনের পরিবর্তিত অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে এতে৷ রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্বর, মাথাব্যাথার মতো টিকাটির কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ তবে কোন গুরুতর প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ না করার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে৷
ছবি: Sergei Karpukhin/TASS/dpa/picture alliance
দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে সেগুলোর কোনটিই আসলে পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরছে না৷ দীর্ঘ মেয়াদে টিকাগুলোর ব্যবহার মানবদেহে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা অজানা৷ সেটি হয়ত সামনের মাস বা বছরগুলোতেই পরিস্কার হবে৷