গত এক মাসে বাংলাদেশের ঝিনাহদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ২২৫ জনকে আটক করেছে বিজিবি৷ শনিবার আটক করা হয়েছে ২২ জনকে৷
বিজ্ঞাপন
মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন তদন্তে দেখা গেছে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নাগরিক৷ তারা পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে কাজের জন্য গিয়েছিল৷ এখন সেখানে কড়াকড়ি হওয়ায় তারা আবার ফিরে এসেছেন৷ তাদের সবার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে মামলা হয়েছে৷
ওসি বলেন, ‘‘আজ (শনিবার) যে ২২ জনকে বিজিবি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে, তাদের মধ্যে বাগেরহাটের শরণখোলার আছে ১৫ জন, নড়াইলের আছে পাঁচজন এবং দুইজন আছে আমাদের মহেশপুরের৷ এই দুইজন ভারত থেকে বাকিদের নিয়ে আসেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘তাদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে৷ তারা বিভিন্ন সময় ভারতে গেছেন৷ ব্যাঙ্গালুরুর বাসাবাড়িতে কাজ করতেন, কাগজ টোকাতেন৷''
রাশেদুল আলম
তিনি বলেন, ‘‘বিজিবি শনিবারের আগে এক মাসে ২০৩ জনকে আটকের কথা বললেও থানায় হস্তান্তর করেছে ১৮৪ জনকে৷ তাদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে মামলা করা হয়৷ তারা এরইমধ্যে আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘এরাও বাংলাদেশের নাগরিক৷ কিন্তু তারা পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন৷ তারা বাগেরহাট, খুলনা এবং পিরোজপুরের বাসিন্দা৷ কয়েক বছর আগে কাজের জন্য ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন৷
তিনি বলেন, ‘‘তাদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ এলাকার কিছু লোক ব্যাঙ্গালুরুতে থাকেন বহুদিন ধরে৷ আগে তারা দিল্লি থাকতেন৷ তারা বাংলাদেশে নিয়মিত আসা যাওয়া করেন৷ তাদের মাধ্যমেই এরা ছয় মাস থেকে দুই বছর আগে ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন৷ তাদের সবার বাংলাদেশের ভোটার আইডি কার্ড আছে৷ তারা বাংলাদেশের নাগরিক৷''
যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় সমান সংখ্যক নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে৷
এদিকে এই ‘অনুপ্রবেশে'র ঘটনায় বিজিবি মহেশপুর সীমান্তে টহল বাড়িয়েছে৷ বাড়ানো হয়েছে সতর্কতাও৷ মহেশপুরের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২০-২৫ কিলোমিটার সীমান্ত আছে৷ বিজিবি জানায়, তারা মহেশপুরের খোলাসপুর, পালিয়ানপুর ও মাটিলা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে৷ সংলগ্ন এলাকার সাধারণ মানুষকেও সতর্ক করা হয়েছে৷ কেউ ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই বিজিবিকে খবর দিতে বলা হয়েছে৷
সেলিম রেজা
স্থানীয় কাজিরবেড় ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম রেজা বলেন, ‘‘ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এই এলাকা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে সেই আশঙ্কায় দুই বছর আগে থেকেই আমাদের সতর্ক করা হয়৷ তখন থেকেই স্থানীয় লোকজন বিজিবিকে সহায়তা করছে৷ অনুপ্রবেশের ঘটনা স্থানীয় কারো চোখে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ফোনে বিজিবিকে জাননো হয়৷ এবারও আমরা সতর্ক রয়েছি৷''
খালিশপুর ৫৮ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল আহসান এর আগে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘‘মাইগ্রেশন করে যারা ভারতে গিয়েছিলেন তাদের সেখানে বসবাসে অসুবিধা হচ্ছে৷ এনআরসি আতঙ্কসহ নানাভাবে চাপের মধ্যে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন৷ বিশেষ করে ব্যাঙ্গালুরু এলাকায় এই সমস্যা বেশি হচ্ছে৷ যে কারণে তারা ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন৷ তারা এক সময় বাংলাদেশে ছিলেন বলে দাবি করছেন৷''
শনিবার তাদের মিডিয়া উইং থেকে ল্যান্স নায়েক মোমিন বলেন, ‘‘আমরা সীমান্তে কড়াকড়ি ও সতর্কতা বাড়িয়েছি৷ শনিবারও ২২ জনকে আটক করা হয়েছে৷ তারা ভারত থেকে আসছে৷ আটকের পর তাদের নাগরিকত্ব যাচাই করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশে যারাই অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করবে তাদেরই আটক করা হবে৷''
উল্লেখ্য, গত আগস্টে ভারতে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর সেখানে বাংলাভাষী অনেকেই চাপের মুখে আছেন৷ ২২ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়েও বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ৫৪ জন নারী ও পুরুষকে আটক করা হয়৷
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷