‘যুদ্ধ হলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে'
২ মে ২০২৫
ডয়চে ভেলে: কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর তো নিয়ন্ত্রণ রেখায় প্রতিদিনই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে৷ এই সংঘাতের যৌক্তিকতা কতটুকু? আর এটা কি আরো বড় ধরনের সংঘাতের দিকে যাচ্ছে?
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারত হয়তো ধরে নিয়েছিল স্পেশাল স্ট্যাটাস (কাশ্মীরের) রিমুভ করার পর একধরনের উন্নয়ন হবে৷ সেখানে পর্যটকদের আকর্ষণ করা এং আরো উন্নয়ন হবে বলে ভারত ধরে নিয়েছিল৷ ভারত মনে করেছিল বড় কোনো ধরনের ঘটনা ঘটবে না৷ এরকমই একটি অবস্থারই কিন্তু সুযোগ টেররিস্টরা নেয়৷ শুধু এই হামলাই যে হয়েছে তা নয়৷ আমরা যদি গত ১০ বছরের হিসাব দেখি, তাদেরই হিসাবে দেখি দুই হাজার ৫০০ টেররিস্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ অ্যাটাকে মোট দুই হাজার মারা গেছে৷ কার্গিল যুদ্ধ তো আমরা আগেই জানি৷ ২০০৮-এর মুম্বাইর পরেও কিন্তু ২০১৯-এ পলওয়ানা অ্যাটাক হলো৷ ৪০ জন ভারতীয় সেনা মারা গিয়েছিলেন৷ মূল সমস্যা যদি থেকেই যায়, তাহলে কিন্তু এটা ঠিক ঢেকে রাখা যায় না৷ ওই সুযোগ টেররিস্টরা নেবেই৷
মূল সমস্যাটা কী?
মূল সমস্যা হলো একটা সময়ে তো স্পেশাল স্ট্যাটাস ছিল৷ সেটা রিমুভ করা হলো৷ সেটা যদি পুরো কাশ্মীরে একটি গণভোট করে করা হতো, তাহলেও বুঝতাম৷ ফলে মূল সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না৷ অনেকেই মনে করেছিলেন বড় কিছু হবে না৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বড় হামলা তো হলো৷ ওখানে ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যাও অনেক সেটা মনে রাখতে হবে৷ তারপরও সেখানে এত বড় আকারের ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর হলো৷ সেটা কীভাবে হলো দেখা দরকার৷
এখন তো নিয়ন্ত্রণ রেখায় প্রতিদিনই গোলাগুলি হচ্ছে৷ হুমকি-পাল্টা হুমকি৷ প্রস্তুতি পাল্টা প্রস্তুতির খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ ওই উত্তেজনা কি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়াতে পারে?
বড় ধরনের যুদ্ধ হওয়ার জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি এবং জনগণের যে প্রস্তুতি থাকা দরকার সেটা দুই দেশেরই নাই৷ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই৷ তার নিজের দেশেও কম-বেশি সন্ত্রাসী হামলা হয়ে থাকে, বিশেষ করে বেলুচিস্তানে৷ ভারতীয় জনগণের মধ্যেও যুদ্ধ করার যে মানসিক প্রস্তুতি দরকার, সেটা তাদের আছে বলে মনে করি না৷ তবে যেহেতু মিডিয়ায় বিশাল হাইপ হচ্ছে৷ রাজনীতিবিদদের মধ্যেও বিশাল হাইপ হচ্ছে৷ সরকারকেও কিছু একটা দেখাতে হবে৷ নাহলে সরকার কীভাবে ফেস করবে, তা থেকে গেল৷ ফলে সার্জিক্যাল অ্যাটাক একটা-দুইটা হতেও পারে৷ এখন যা হচ্ছে, তার চেয়ে আরো কিছুটা বেড়ে যেতে পারে৷ তবে দুই দেশে বড় আকারের যে যুদ্ধ হয়, সেটা হওয়ার আপাতত কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না৷
দুই দেশই ব্যবস্থা -পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ এটা কি দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
এটাও নতুন না৷ যখনই হামলা হয়েছে কী কাশ্মীরে, কী বেলুচিস্তানে- তখনই আমরা দেখেছি খুব তাড়াতাড়ি কোনো এভিডেন্স বা বড় আকারের গবেষণা ছাড়া অন্যকে দায়ী করা৷ এবারও তাই হয়েছে৷ ভারত বলছে, পাকিস্তান জড়িত, পাকিস্তান বলছে, না আমরা জড়িত নই৷ ব্লেম গেমের মধ্যে চলে যাচ্ছে৷ তবে যারা হামলা করেছে, তারা কিন্তু কম-বেশি পার পেয়ে যায়৷ সেই জায়গাটাও দেখা দরকার৷ সেটা ধরে যে কনফ্লিক্ট, সেটা আর কিছুদিন পর শত বছরের কনফ্লিক্টে পরিণত হবে৷ আমার মনে হয়, এর সমাধান দুই দেশের জনগণকেই করতে হবে৷ অন্য কোনো উপায়ে সম্ভব নয়৷ কিন্তু ভারত বা পাকিস্তানে যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা বিষয়টাকে এমনভাবে রাজনীতিকরণ করেন যে, তাতে সমস্যার তো সমাধানও হয় না, দুই দেশের যে সম্পর্ক তাতেও কোনো পরিবর্তন হয় না৷
যুদ্ধ বাধলে ভূ-রাজনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
যদি দুই দেশের মধ্যে বড় যুদ্ধ বেধে যায় দুই দেশের সব ফোর্স যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমি তো মনে করি, বড় প্রভাব পড়বে৷ সাপ্লাই চেইনের বিষয় আছে, নানা ধরনের সম্পর্কের বিষয় আছে৷ এমনকি বাংলাদেশ থেকে এয়ার রুটস, সি রুটস সবগুলোই বিঘ্নিত হবে৷ সেখানে বড় সমস্যা তৈরি হবে৷ তবে এর প্রভাব যে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় হবে, তা নয়৷ এইরকম বড় দুইটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও বড় একটা প্রভাব পড়বে৷ এই কারণেই আমরা দেখছি, বেশ কিছু দেশ এগিয়ে এসেছে পরিস্থিতি সামাল দিতে৷ একটা-দুইটা দেশ আবার মধ্যস্থতা করতে রাজি আছে৷ নোগোসিয়েশনে তারা পার্টনার হতে চাচ্ছে৷ আমি ইরানের কথা শুনেছি৷ দৌদি আরবের কথা শুনেছি৷ ওদিকে অ্যামেরিকা, চীন তারাও দুই দেশকেই ঠান্ডা হতে বলছে৷ ফলে বড় যুদ্ধ না হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা প্রেসার থাকবে৷ তবে ছোটখাটো যে একেবারেই কিছু হবে না তা এখই বলা মুশকিল৷
এখানে তাহলে কি ভূ-রাজনীতির কোনো উসকানি নাই, না অন্য ধরনের খেলা থাকতে পারে?
অন্য অ্যাক্টররা জড়িত কিনা সেটা এভিডেন্স ছাড়া বলা মুশকিল৷ কোনো ধরনের এভিডেন্স ভারত বা পাকিস্তান কেউ সামনে নিয়ে আসতে পারেনি৷ তবে মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ হলে যে সবার ক্ষতি হয়, তা নয়৷ যদি যুদ্ধ পরিস্থিতিও তৈরি হয়, তাহলেও কিন্তু কেউ কেউ লাভ করে৷ কারণ, অস্ত্র বিক্রি করার একটা বিষয় চলে আসে৷ আমরা দেখলাম ভারত ফ্রান্সের সাথে একটা চুক্তি করেছে৷ এয়ারফোর্সের সাথে একটা চুক্তি করেছে৷ তাই সবার যে ক্ষতি হয়, তা নয়৷ তবে জনগণের একটা বড় ভূমিকা থাকে৷ কিন্তু বড় যে হাইপ তৈরি হয়েছে গণমাধ্যমে এবং স্যোসাল মিডিয়ায়, সেটা দুই দেশের জনগণ কীভাবে নেবে দেখার বিষয়৷
হাইপ তো উঠে গেছে৷ সেটা শুধু দুই দেশের সংবাদমাধ্যম কেন, সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমেই চলছে৷ দুই দেশের সামরিক শক্তির হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে৷ যুদ্ধে কে হারতে পারে, কে জিততে পারে- তার হিসাবও হচ্ছে৷ এটাকে কতটা হিসাবের মধ্যে আনা যাবে?
এটা নতুন না৷ প্রতিবারই, যতবার হয়েছে এই হিসাব হয়েছে৷ কার্গিল যুদ্ধে তো সামরিক শক্তির বড় ধরনের মবিলাইজেশন হয়েছিল৷ দুই পাশেই অনেকের হিসাবে এক মিলিয়ন ফোর্স দাঁড়িয়েছিল৷ এবার তবে এখনো বড় ধরনের ফোর্স মবিলাইজেশন দেখা যাচ্ছে না এখানে৷ সেই জন্যই বলছি, আপাতত বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা করছি না৷
পানি চুক্তি স্থগিত হয়েছে, আকাশ সীমা বন্ধ করা হয়েছে, ভিসা বাতিল করা হয়েছে৷ আবার গুজরাটে বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ এখন আবার শোনা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান৷ সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
বড় আকারেরই ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের৷ কারণ, দুইটি দেশই নিরাপত্তা রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সিকিউরিটি আরো শক্তিশালী করবে৷ সেই নিরাপত্তা রাষ্ট্র যখন হয়, সাধারণ মানুষের কিন্তু তখন বিশাল একটা ভোগান্তি হয়৷ এটা থেকে কোনোভাবেই পার পাওয়া যাবে না৷ শেষ পর্যন্ত এটা দুই দেশের জনগণের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে৷ বছরের পর বছর এই অবস্থা চলছে৷ আন্তর্জাকিভাবে এটার সমাধান হবে না৷ দুই দেশের মধ্যে এই যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তা তো এক সময় শেষ হতে হবে৷
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন তারা চাইলে বাংলাদেশও সমঝোতায় অংশ নিতে পারে৷ বাংলাদেশের কি সেই ভূমিকা নেয়ার নেয়ার সুযোগ আছে ? আর এই সংঘাতে বাংলাদেশের অবস্থান, ভূমিকা কী হবে?
না, বাংলাদেশ সেই পেশাদারিত্ব তৈরি করতে পারেনি৷ আমার দেখেছি, বাংলাদেশের সরকার হয় দিল্লিকেন্দ্রিক, অথবা পাকিস্তানকেন্দ্রিক৷ না দিল্লি বিশ্বাস রাখবে, না ইসলামাবাদ বিশ্বাস রাখবে৷ বাংলাদেশকেন্দ্রিক যে পররাষ্ট্র নীতি, সেটা কিন্তু আমরা করতে পারিনি এখনো৷ যে পেশাদারিত্বটা দরকার, একেবারে বাংলাদেশিদের নিয়ে, সেটা কিন্তু আমরা করতে পারিনি৷ সেই জায়গায় আমার মনে হয় না বাংলাদেশ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে৷ এখানে কাতার বড় নেগোশিয়েটর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সৌদি আরব ইউক্রেনের ব্যাপারে নতুন নেগোশিয়েটর হিসাবে দাঁড়াচ্ছে৷ সেটা দেখার বিষয়৷ আমরা তুরস্ককে দেখেছি ইউক্রেন রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দাঁড়িয়েছে৷ এই ধরনের দেশ একটা সুনামও অর্জন করেছে৷ বাংলাদেশ সেই পর্যায়ে যায়নি এখনো৷