ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা পানিবন্টন চুক্তি নানা কারণে ঝুলে থাকায় গঙ্গার ভাটির দিকে অববাহিকা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা এগিয়ে চলেছে৷ সম্ভবত বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর আগামী দিল্লি সফরে তাতে সিলমোহর পড়তে পারে৷
বিজ্ঞাপন
ভাটির দিকে গঙ্গা বেসিন বা অববাহিকা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা হয় গত সপ্তাহে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী দিল্লি সফরে মোদী-হাসিনা বৈঠকের আলোচ্যসূচির শীর্ষে আছে এই প্রকল্পের খুঁটিনাটি দিক এবং তার অনুমোদন৷ দুই দেশের মধ্যে তিনটি বড় নদী গঙ্গা, ব্রম্মপুত্র ও মেঘনার অভিন্ন সঙ্গমমুখ বঙ্গোপোসাগরকে বলা যায় একই রিভার-সিস্টেম৷ বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষের বাস গঙ্গা-ব্রম্মপুত্র ডেলটা বা ব-দ্বীপ অঞ্চলে এবং জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশের জীবন ও জীবিকা৷
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রাক্তন হাইকমিশনার এবং এই প্রকল্পের একজন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জামির মনে করেন, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৩০ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে যে পরিমাণ জল বাংলাদেশে ঢোকে তাতে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকাগুলির খরা, বন্যা, নদী গর্ভে পলি জমার মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ পদ্মা নদীর জলস্তর কমে গেছে৷ বেড়ে গেছে সুন্দরবনসহ গোটা এলাকার নোনা জলের মাত্রা৷ সেজন্য ফারাক্কা বাঁধ থেকে ছাড়া জল ধরে রাখতে দরকার বাংলাদেশে ফারাক্কার অনুরূপ আরেকটি বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা৷ সেজন্য এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দিল্লির সাহায্য ও সহযোগিতা জরুরি৷ বাঁধ তৈরি হলে শুখা মরশুমে ভাটির দিকের জলপ্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব হবে৷ এছাড়া অববাহিকা অঞ্চলে পলি সরাতে যৌথ ড্রেজিং হবে এই উন্নয়ন প্রকল্পের অঙ্গ৷ দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে ১৯৯৬ সালে সই হয় দ্বিপাক্ষিক গঙ্গা জল বন্টন চুক্তি৷ কিন্তু তাতে বাংলাদেশের পানি সমস্যার প্রকৃত সুরাহা হয়নি৷ তখন বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে অনুরূপ একটি বাঁধ নির্মানের সুপারিশ করেছিলেন৷ খরচ ধরা হয় ৪০০ কোটি ডলার৷
ব্রহ্মপুত্র নদের দ্বীপটি হারিয়ে যাচ্ছে
ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে একটি দ্বীপ মাজুলী৷ ভারতের আসাম রাজ্যের এই দ্বীপটি বিশ্বের অন্যতম বড় ‘নদী-দ্বীপ’৷ কিন্তু এটা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে৷
ছবি: DW/B. Das
বিশ্বের অন্যতম বড় নদী-দ্বীপ
ভারতের আসাম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে অবস্থিত মাজুলী বিশ্বের অন্যতম বড় ‘নদী-দ্বীপ’৷ কিন্তু ভূমিক্ষয়ের কারণে মাজুলীর আয়তন দিন দিন ছোট হয়ে আসছে৷
ছবি: DW/B. Das
সমৃদ্ধ সংস্কৃতি
মাজুলী দ্বীপটি নিও-বৈষ্ণব সংস্কৃতি সমৃদ্ধ৷ সেখানে এই সম্প্রদায়ের অনেকগুলো আশ্রম রয়েছে৷ প্রায় এক লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের বাস এই নদী-দ্বীপটিতে৷
ছবি: DW/B. Das
ছোট হয়ে আসছে মাজুলী
মাজুলী দ্বীপটির আকার একসময় ছিল প্রায় সাড়ে ১২শ’ বর্গকিলোমিটার৷ কিন্তু দিন যত যাচ্ছে দ্বীপের আকার তত কমছে৷ বর্তমানে এটি তার আগের আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে৷
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল৷ কিন্তু ১৯৫০ সালের ভূমিকম্পটি সব পাল্টে দিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা৷ সেই সময়ের ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় দ্বীপটির চারপাশের ভূমি ক্ষয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/B. Das
বছর বছর বন্যা
প্রায় প্রতি বর্ষা মরসুমেই মাজুলীতে বন্যা হয়৷ এতে বহু প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকে৷ ফলে সেখানকার অনেক বাসিন্দাই এখন মূল ভূখণ্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন৷
ছবি: DW/B. Das
নিষ্ক্রিয় সরকার
মাজুলীর স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক দিন ধরে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না৷ এছাড়া দ্বীপটির বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়েও সরকার ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/B. Das
7 ছবি1 | 7
গঙ্গা অববাহিকা উন্নয়ন প্রকল্পের যৌক্তিকতার বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সুগত হাজরা বললেন, জরুরি যে জায়গাটাতে সবথেকে বেশি অভিঘাত পড়বে, তা হলো এক অভিন্ন ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটিজি তৈরি করা৷ বেসিনের উজানের দিকে নয়, ভাটির দিকে যেখানটায় ভারত ও বাংলাদেশ শেয়ার করে৷ যেখানটায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বে সবথেকে বেশি৷ যেখানকার সমস্যাগুলি মোটামুটি একই ধরণের৷ সুতরাং দেশ-ভিত্তিক ম্যানেজমেন্ট না করে যদি ডেলটা বা বেসিন-ভিত্তিক ম্যানেজমেন্ট গড়ে তোলা যায়, তাহলে উভয় দেশ উপকৃত হবে সবথেকে বেশি বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চলে৷ যৌথ ম্যানেজমেন্টে জলের লবনাক্ততা কম করতে, জৈব-বৈচিত্র্য, ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণে, মত্সচাষ ও তাজা জলের মাত্রা বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সহায়ক হবে৷ সামগ্রিক প্রভাব পড়বে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর৷ মূলত ইকো-সিস্টেমে যুক্ত হবে এক নতুন মাত্রা৷ সেটাই হবে সবথেকে বড় লাভ উভয় দেশের, ডয়চে ভেলেকে বললেন সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক সুগত হাজরা৷
এই প্রসঙ্গে তিনি তুলে ধরলেন এক কালের গুরুত্বপূর্ণ ইছামতী নদীর উদাহরণ৷ বললেন, ইছামতী নদী এমনই একটা নদী যা ভারত ও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একবার ঢোকে একবার বের হয়৷ শেষে নদীবক্ষেই চিহ্নিত হয় দুদেশের সীমান্ত৷ এই নদীকে যদি যৌথ ম্যানেজমেন্টে পুনরুজ্জীবিত করা যায়, তাহলে ইলিশ মাছ থেকে শুরু করে অনেক সুফল ভাগ করে নেওয়া সম্ভব উভয় দেশের পক্ষে৷ ব-দ্বীপ অঞ্চলের সহায় সম্পদ শেয়ার করাই হবে আসল লক্ষ্য৷ কাজেই যৌথ ম্যানেজমেন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গঙ্গা অববাহিকা উন্নয়ন প্রকলের৷ যেমন, মেকং নদী ৭টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, সেখানে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সহমতের ভিত্তিতে যৌথ ম্যানেজমেন্ট বিশেষ দরকার৷ তবে তিস্তা জলবন্টন প্রকল্পের সঙ্গে গঙ্গা অববাহিকা উন্নয়ন প্রকল্পের তুলনা চলে না৷ চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পৃথক৷ মুশকিল হচ্ছে, এর বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষ করে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্রক্রিয়াগত নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে৷ জল সংক্রান্ত ইস্যুগুলি পড়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে৷
বুড়িগঙ্গা রক্ষায় উদ্যোগ আছে, সাফল্য নেই
যে নদীর তীরে বাংলাদেশের রাজধানীর অবস্থান, সেই নদীর অবস্থা ক্রমশ নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে৷ বিষাক্ত আবর্জনা মিশে ইতোমধ্যে নদীর পানি ধারণ করেছে কৃষ্ণবর্ণ, নদী পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে৷ এই নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিবর্ণ বুড়িগঙ্গা
যে বুড়িগঙ্গা এককালে ঢাকার রূপ বাড়িয়েছে, সেই বুড়িগঙ্গা আজ বড় বিবর্ণ৷ ঢাকা শহরের চাপ আর নিতে পাচ্ছে না এই নদী৷ রাজধানীর অধিকাংশ আবর্জনা গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়৷ ফলে নদীর পানি ধারণ করেছে কৃষ্ণবর্ণ৷ তবুও অত্যাচার থেমে নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আবর্জনার ভাগাড়
বুড়িগঙ্গা এখন কার্যত আবর্জনার ভাগাড়৷ প্রতিদিন ঠিক কি পরিমাণ ময়লা, আবর্জনা বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় তার একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়৷ তবে পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গৃহস্থালী ও কল-কারখানার সাত হাজার টনেরও বেশি বর্জ্যের ৬৩ ভাগ বিভিন্নভাবে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে৷
ছবি: AP
হাজারিবাগের আবর্জনার গন্তব্য বুড়িগঙ্গা
হাজারিবাগে অবস্থিত দু’শোর বেশি চামড়া কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার ঘন লিটার দূষিত আবর্জনা বের হয়৷ এই আবর্জনায় হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম রয়েছে, যার কারণে ক্যানসার হতে পারে৷ অথচ এই সব বর্জ্যই বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে মেশে৷
ছবি: Blacksmith Institute
বার বার সময় নিচ্ছেন মালিকরা
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা-র সমন্বয়কারী ইকবাল হাবিব সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ২০০৩ সালে হাইকোর্ট হাজারিবাগের চামড়া কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে বলেছেন৷ এরপর সরকার এবং ট্যানারি মালিকরা মিলে অন্তত ১০ বার সময় নিয়েছে৷ এতে প্রমাণিত হয়, সরকার বা ট্যানারি মালিক কেউই এ ব্যাপারে আন্তরিক নয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ময়লা জলে কাপড় ধোয়া
বিষাক্ত বর্জ্য, তেল আর রাসায়নিক পদার্থ মিলে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে৷ তারপরও এই পানি ব্যবহার করা হচ্ছে ধোঁয়ামোছার কাজে৷ ছবিতে বুড়িগঙ্গার ময়লা জলে কাপড় পরিষ্কার করেছেন এক ধোপা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীর্ণ বুড়িগঙ্গা
দখলের কারণেও শীর্ণ হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা৷ এই নদীর ৪ হাজার দখলদারকে ২০১০ সালের শুরুর দিকেই চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন৷ তবে চিহ্নিত হলেও অবৈধ দখলদারদের উদ্ধার অভিযান আজও গতি পায়নি৷
ছবি: dapd
গতি পাচ্ছে না পর্যটন
দূষিত পানি এবং দুর্গন্ধের কারণে বুড়িগঙ্গা নদী ভ্রমণ থেকেও বিরত থাকছেন পর্যটকরা৷ ফলে এখাত থেকে অর্থ উপার্জনের উপায় থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না৷ পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাও বুড়িগঙ্গার মাঝিদের উপার্জনের উপর প্রভাব ফেলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চল্লিশ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন লেড ও ক্যাডমিয়ামসহ ৬ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে৷ তা শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, আশেপাশের ৫৬ কিলোমিটার নদীকে দূষিত করছে৷ আর এই দূষিত পানির কারণে ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
এই প্রকল্পের চিন্তাভাবনা প্রথম মাথায় আসে ২০১১ সালে সাবেক কংগ্রেস-জোট সরকারের আমলে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে৷ বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী হাসিনার আগামী দিল্লি সফরে মোদীর সঙ্গে বৈঠকে গঙ্গা বেসিন উন্নয়ন প্রকল্পটি আলোচনার শীর্ষ আলোচ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত৷ হাসিনার দিল্লি সফরের দিনক্ষণ এখনও চুড়ান্ত হয়নি৷ গত বছর তাঁর আসার কথা ছিল কিন্তু তা পিছিয়ে যায়৷