১৯৫২ সালে ভারতে যখন প্রথম লোকসভা ও বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়, তখন ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ছিল ২১ বছর। তার ৩৬ বছর পর রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন আইনমন্ত্রী বি শঙ্করানন্দ সংবিধানের ৬১তম সংশোধন বিল নিয়ে আসেন। সেই বিলে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দেয়ার বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করার প্রস্তাব ছিল। সেই বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাস হয় এবং পশ্চিমবঙ্গসহ ২০টি রাজ্য সরকার বিলটি অনুমোদন করে। তারপর থেকে ভারতে সব ক্ষেত্রে ভোটের বয়স হলো ১৮ বছর।
কেন ভোট দেয়ার বয়স কমানোর প্রস্তাব করছেন, বিলে তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন শঙ্করানন্দ। তিনি বলেছিলেন, সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচনে প্রাপ্তবয়স্করা ভোট দেবেন। দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশেই ১৮ বছর বয়সে ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে। ভারতেও অনেক রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনে ১৮ বছর বয়সে ভোট দেয়ার নিয়ম চালু করেছে।
তিনি আরো জানিয়েছিলেন, আমাদের দেশে তরুণরা শিক্ষিত ও সচেতন। দেশের তরুণদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেয়া দরকার। তারা যাতে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে, তাদের মনোভাবের প্রতিফলন যাতে ঘটে, তার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। এখনকার তরুণরা রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি সজাগ। তাই ভোট দেয়ার বয়স ২১ থেকে ১৮ করা হোক।''
এখানে শঙ্করানন্দ ‘শিক্ষিত' কথাটি উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, ভারতে সংবিধান চালু করার সময়ে সকলের জন্য ভোটের সমান ভোটাধিকার নিয়ে যে সমালোচনা হয়েছিল তার কথা।
পশ্চিমা দেশগুলির সমালোচনা
ভারতে সংবিধান তৈরির জন্য কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধানসভা গঠন করা হয়েছিল। প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধিরা সেখানে ছিলেন। প্রতিটি বিষয় নিয়ে সেখানে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তারপর সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংবিধান প্রণেতারা অনেক ভেবেচিন্তে সকলের জন্য সমান ভোটাধিকারের সিদ্ধান্ত নেন। লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই যে কোনো নির্বাচনে একটি ভোট দিতে পারবেন, তার মূল্য সমান হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে প্রার্থী জিতবেন। পশ্চিমা দেশগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় পরে ভোটাধিকার পেয়েছেন। ভারতে তা হয়নি।
১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান চালু হওয়ার পরেই শুরু হলো সমালোচনা। একের পর এক পশ্চিমা পণ্ডিত বলতে শুরু করলেন, ভারত ভয়ংকর ভুল করলো। এখানে সব মানুষকে ভোটের সমানাধিকার দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। ভারতের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত, অধিকাংশ মানুষ গরিব, তারা তো বুঝতেই পারবে না কাকে ভোট দেবে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতা দখল করবে। তাই এই সিদ্ধান্ত একেবারেই ঠিক হলো না।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি সেসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ''এশিয়ায় প্রজাতন্ত্রগুলি নতুন তৈরি হয়েছে। সেখানে স্বৈরাচারী বা গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের প্রবণতা থাকবে। উচ্চকাঙ্খী স্বৈরাচারী মানুষদের তো পুরষ্কৃত করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।''
আইনজীবী, শিক্ষাবিদ আইভর জেনিংসের মতো মানুষরাও বলতে লাগলেন, সীমাবদ্ধ ভোটাধিকার চালু করা হলে ঝুঁকি অনেকটা কম হবে। সরাসরি নির্বাচন না করে পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। আরো পিছিয়ে থাকা জনজাতিরা কী করে ভোট দেবেন, তা নিয়েও সাহেব পণ্ডিতরা অনেক আলোচনা করেছিলেন।
সেই সব আশঙ্কা, তত্ত্ব, মতামতের গোড়ায় জল ঢেলে দিয়ে 'অশিক্ষিত' ভারতীয় ভোটদাতারা প্রমাণ করে দিয়েছেন, তথাকথিত কেতাবী শিক্ষার সঙ্গে রাজনীতিবোধকে এক করে দেখাটা মুর্খামি। ১৯৫২ সালে যখন লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন শুরু হলো, তখন ওই তথাকথিত 'অশিক্ষিত' মানুষরা বারবার তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দিলেন।
আসলে ভারতীয় সংবিধান যখন ১৯৫০ সালে চালু হলো, তখন দেশে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। সেজন্যই পশ্চিমা দেশগুলি থেকে ‘গেলো, গেলো' রব উঠেছিল। কিন্তু এই ভোটদাতারাই একের পর এক নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা, বোধ, বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে যে ভোটদাতারা বিপুলভাবে কংগ্রেসকে জিতিয়েছিলেন, তারাই জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা গান্ধীকে শাস্তি দিয়েছিলেন। আবার তিন বছর পর লোকসভার ভোট হলো। তখন তারা আবার বিপুলভাবে ইন্দিরাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ক্ষমতায়।
২০০৪ সালে এনডিএ যখন ভেবেছিল, তারা আবার ক্ষমতায় আসবে, তখন ভোটদাতারা ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল ইউপিএ-কে। একবার নয় দুইবার। ২০১৪ সালে আবার বিজেপি তথা এনডিএ-কে ক্ষমতায় নিয়ে এলেন ভোটদাতারা। ২০২৪ সালে সেই বিজেপি-র আসনসংখ্যা আবার কমিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষোভপ্রকাশ করতে ছাড়েননি ভোটদাতারা।
রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে তো আরো চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটেছে। দেশের তিনটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরা তোবামপন্থি দলগুলিকে শাসনক্ষমতায় বসিয়েছে। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলিতে বামেরা তেমন সাফল্য পাননি। আবার পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ধরে শাসন করার পর তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে ও এআইএডিমকে ক্ষমতায় এসেছে। রাজস্থানে একবার কংগ্রেস এরবার বিজেপি-কে বেছে নিয়েছেন ভোটদাতারা। আবার এরকমও হয়েছে, একইসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট হয়েছে, ভোটদাতারা রাজ্যে একটা দলকে বেছেছেন, কেন্দ্রে অন্য দলকে।
তাই আর যাই হোক না কেন, ভারতের মানুষ ভোটাধিকার তাদের বিবেচনাবোধ অনুসারে প্রয়োগ করেছেন। তাই বিশ্ব যখন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স মোটামুটিভাবে ১৮ বলে মেনে নিয়েছে, তখন ভারতও ভোটের বয়স কমিয়েছে। এই নমনীয়তা তারা দেখাতে পেরেছেন। ভারতীয়রা এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিকড় অনেকটা গভীরে প্রবেশ করেছে বলে, আশপাশের অনেক দেশে সেনাশাসন হলেও ভারতে কখনো তা হয়নি। জরুরি অবস্থার ব্যতিক্রম বাদ দিলে ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের রায় ও গণতাস্ত্রিক ব্যবস্থা অমান্য করার কথাও কেউ ভাবেন না।