৭ই আগস্ট প্রথমবারের মতো তিনদিনের সফরে নতুন দিল্লিতে এলেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল৷ মনমোহন সিং সরকারের আমলে ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় ভাটা পড়েছিল৷ তা বিপরীতমুখী করাই হেগেলের এ সফরের প্রধান অ্যাজেন্ডা৷
বিজ্ঞাপন
নতুন মোদী সরকারকে কাছে পেতে বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন৷ সপ্তাহ খানেক আগে দিল্লি ঘুরে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি৷ আর এবার এসেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল (বানাভেদে হাগেল)৷
মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস-জোট সরকারের আমলে ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নানা বাধা-বিপত্তিতে ভুগছিল৷ দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতা একটা জায়গায় এসে আটকে ছিল৷ হেগেল সেটা সরিয়ে তাতে গতি আনার চেষ্টা করবেন৷ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেবার পর, ভারতের প্রতিরক্ষা বাজারকে প্রধানত ‘পাখির চোখ' করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের প্রস্তাব নিয়ে তিনি আলোচনা বসবেন দিল্লির রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে৷
প্রতিরক্ষা সওদায় কী কী থাকতে পারে
২২টি আপাক জঙ্গি হেলিকপ্টার৷ ১৫টি ভারি ওজন বহনক্ষম চিনুক হেলিকপ্টার, সমুদ্র সীমার জন্য চারটি পি-৮১ নজরদারি বিমান৷ এ সবের মোট মূল্য ধরা হয়েছে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার৷ তবে ১৪৫টি খুব হাল্কা ওজনের এম-৭৭৭ হাউৎজার কামান কেনার চুক্তি আপাতত ঝুলে থাকবে বেশি দাম চাওয়ায়৷
ভারত মনে করে, এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধার্য প্রায় ৬৫ কোটি ডলার খুবই বেশি দাম৷ ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি গত মাসে সংসদে জানান যে, এম-৭৭৭ হাউৎজার কামানের বেশি দাম চাওয়ার জন্য তা আটকে আছে৷ যুক্তরাষ্ট্র দামের বিষয়ে নতুন কোনো প্রস্তাব দেয়নি৷ বিক্রেতা মার্কিন কোম্পানিগুলির কাছ থেকেও নতুন করে সাড়া পাওয়া যায়নি৷ অতি হাল্কা হাউৎজার কামান ছাড়া অন্যগুলি কেনার সবুজ সংকেত দিতে বসেছিল প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহণ বোর্ডের বৈঠক৷ অত্যাধুনিক ‘জ্যাভেলিন' ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্র কেনার চুক্তি চূড়ান্ত হয়নি৷ উল্লেখ্য, ভারতের সমরাস্ত্র জোগানদার প্রধান দেশ হলো রাশিয়া, ইসরায়েল ও ফ্রান্স৷ এখন সেই বাজারে ভাগ বসাতে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া৷
প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে হেগেলের বৈঠক
বৈঠকে তিনি দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় নতুন মাত্রা দেবার বার্তা দেবেন বলে মনে করেন দিল্লির প্রতিরক্ষা মহল৷ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র হবে একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দু'দেশের অভিন্ন স্বার্থ জড়িত৷ সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করবেন হেগেল৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
এক্ষেত্রে রয়েছে প্রচুর সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ৷ যেমন যৌথ সামরিক মহড়া, প্রতিরক্ষা বাণিজ্য৷ শুধু সমরাস্র বিক্রি নয়, ভারতে তার যৌথ উৎপাদন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টিও এই সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হবে৷ আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটনে মোদী-ওবামা শীর্ষ বৈঠকের অ্যাজেন্ডা ওপরের দিকে স্থান পাবে দু'দেশের প্রতিরক্ষা সহয়োগিতা৷ শুধু প্রতিরক্ষা নয়, সন্ত্রাস-বিরোধী কার্যকলাপ দমনে গোয়েন্দা তথ্যাদি দিয়েও সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র৷ ৮ই আগস্ট শুক্রবার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগেলের বৈঠক হবে প্রধানমন্ত্রী মোদী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে৷
প্রসঙ্গত, হেগেলের সঙ্গে ভারতে এসেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পুনীত তলওয়ার৷ দিল্লির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে জোরদার হয়ে উঠছে দেখে চীনের কপালে পড়েছে ভাঁজ৷ তারা নজর রাখছে সামরিক সহযোগিতার দিকে৷ আর আগামী মাসে দিল্লি আসছেন চীনা প্রেসিডেন্ট৷