মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প চড়া হারে শুল্ক বসানোর পর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।ছবি: Ron Sachs/MPI/Capital Pictures/picture alliance
বিজ্ঞাপন
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা মঙ্গলবার আবার শুরু হলো। ভারত সরকারিভাবে জানিয়েছে, দুই দেশের প্রধান আলোচকরা আবার কথা শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসানোর পর যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করা হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় সহকারি বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডান লিঞ্চ।
বিজ্ঞাপন
কী নিয়ে কথা হবে?
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব রাজেশ আগরওয়াল বলেছেন, ''আমরা ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের স্পষ্ট ছবি পেতে চাই। তাই এই আলোচনা হচ্ছে।''
এই আলোচনা শুধু মঙ্গলবারই হওয়ার কথা। এই আলোচনার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ঠিক হবে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের আলোচনা কবে শুরু হবে। রাজেশ আগরওয়াল বলেছেন, ''মঙ্গলবার দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্য আলোচনা হচ্ছে না। আমরা অবশ্যই বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করবো। তবে আমরা দেখবো, ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে বাণিুজ্যু চুক্তি সম্ভব কিনা।''
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি ৮১০ কোটি ডলার থেকে কমে ৬৮৬ কোটি ডলারে হয়েছে।
ভারতে যিনি এবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত হতে চলেছেন, সেই সার্জিও গোর সেনেটে বলেছেন, ভারতীয় বাণিজ্যমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রাজেশ আগরওয়াল বলেছেন, ''এই বিষয়েও কথা হতে পারে। তবে বাণিজ্য ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কোনো কথা হবে না।''
ট্রাম্পের শুল্কের চাপ বিশ্বব্যাপী যেমন প্রভাব ফেলতে পারে
ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ছবিঘরে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কোথায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তার বিস্তারিত...
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
শুল্কের ঘোষণা
২ এপ্রিল বিশ্বের সব দেশের পণ্য আমদানির উপর নানা হারে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ঘোষণার এক সপ্তাহ পর অবশ্য চীন, ক্যানাডা ও মেক্সিকো ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলোর উপর আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন ট্রাম্প৷ ৯০ দিন পর যদি এই শুল্ক তিনি আবার আরোপ করেন, তাহলে ভোক্তা পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি- সব জায়গাতেই এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের৷
ছবি: Jim Lo Scalzo/UPI Photo/Newscom/picture alliance
মার্কিন শুল্কের ইতিহিস
অ্যামেরিকার বাণিজ্যের শুরুর দিক থেকেই শুল্ক আরোপের ইতিহাস রয়েছে৷ দেশটি ১৮২০ সালে বিদেশি পণ্যের উপর ৩০ ভাগের মতো শুল্ক আরোপ করেছিল৷ ১৯৩০ সালে ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর গঠনের পর থেকে শুল্ক কমাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র৷ ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুল্ক নিয়ে চীনের সাথে বাদানুবাদ শুরু হয়৷ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে, অর্থাৎ, ১৮২০ সালের দুইশ বছর পর মার্কিন শুল্কের হার আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে৷
ছবি: Liu Jie/Xinhua/IMAGO
শুরু হয় ‘শুল্ক-যুদ্ধ’
ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করে, যা আগে ছিল ৩৪ শতাংশ৷ পাল্টা জবাব দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ চীনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ট্রাম্পের প্রাথমিক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের উপর শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নও৷ যদিও ট্রাম্পের স্থগিতাদেশের ঘোষণায় পিছু হটে ইইউ৷
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
তেলের দাম, শেযার বাজার
ট্রাম্পের ঘোষণার সাথে সাথেই অস্থিরতা দেখা যায় তেল ও শেয়ারের বাজারে৷ তেলের দাম কমেছে প্রতি ব্যারেলে ৫০ ডলার পর্যন্ত৷ ভয়াবহ পরিস্থিত তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারে৷ মন্দার আশঙ্কায় ট্রাম্পের ঘোষাণার প্রথম দুই দিনে শুধুমাত্র মার্কিন শেয়ারবাজার ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে৷
ছবি: Mark Ralston/AFP
অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা
পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হলে চলতি বছরের শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান জে পি মর্গ্যান জানায়, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পর চলতি বছরের শেষ নাগাদ মন্দার শঙ্কা ৬০ ভাগে দাঁড়িয়েছে৷ অর্থনৈতিক মন্দা চরম পর্যায়ে গেলে ভূগতে হবে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকেই৷
ছবি: Gregor Fischer/Getty Images
প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা
শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়বে আমদানি-রপ্তানিতে৷ এর ফলে বিভিন্ন দেশের আশানুরূপ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে৷ ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ইউরোপের দেশ ইটালি চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক দুই থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ছয়-এ নামিয়ে এনেছিল৷ অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ফলে চলতি বছর জার্মানির জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক এক ভাগে নেমে আসতে পারে৷
ছবি: natatravel/Depositphotos/IMAGO
ক্রেতাদের ভোগান্তি
শুল্ক আরোপের প্রভাব পণ্যের দামের উপর পড়বেই৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রবেশে অধিক শুল্কের মাশুল সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলবে৷ শুধু তাই নয়, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন শুল্ক বাড়ানোয় তার প্রভাবও ক্রেতাদের উপর পড়বে৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/IMAGO
ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদন
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাণিজ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এমনটাই মনে করেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনাভির্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জান-ইন চোং৷ এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী পণ্যের চাহিদার উপর প্রভাব ফলেবে, যার প্রভার পড়বে উৎপাদনে৷
ছবি: CFOTO/NurPhoto/IMAGO Images
বাজারে অবস্থান হারাতে পারে অনেক দেশ
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যাদের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, সেই দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাজারে তাদের অবস্থান হারাতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের৷ এর প্রভাব এমন দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে পড়তে পারে৷
ছবি: Joy Saha/ZUMA Press Wire/picture alliance
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্য জোটে প্রভাব
বাণিজ্য ক্ষত্রে অনিশ্চিয়তা ফলে অনেক দেশ নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী খুঁজে পাওয়ার দিকে ধাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের৷ এরই মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে চীনের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে অনেক দেশ- এমনটাই দাবি সিঙ্গাপুরের গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস-ইউসোফ ইশাক ইনস্টিটিউটের এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিনা ফং৷
ছবি: Ute Grabowsky/photothek/picture alliance
অসমান্তরাল বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে যেমন ক্ষতির মুখে ফেলবে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ঠিক ততটাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ এক নিবন্ধে বিজনেস হার্ভার্ড রিভিউ ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ৩৬০ ডিগ্রির বাণিজ্য যুদ্ধ বলে মন্তব্য করে৷
ছবি: Anna Moneymaker/Getty Images
11 ছবি1 | 11
কী হতে পারে?
ভারতে বণিকসভা ফিকি-র সাবেক পরামর্শদাতা অঞ্জন রায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এখন যা অবস্থা তাতে শুল্ক বসানোর ফলে দুই দেশের কিছুটা অসুবিধা হবে ঠিকই, তবে অর্থনীতিতে খুব বড় ধাক্কা লাগবে না। কারণ, এখন যে শুল্ক বসানো হয়েছে তা পণ্যের উপর। সার্ভিস সেক্টর বা পরিষেবা ক্ষেত্রে কিছু হয়নি। আর এই ক্ষেত্রের উপর যদি আঘাত আসে, তাহলে ভারতের অর্থনীতিতে তার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। অ্যামেরিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।''
অঞ্জন রায় মনে করেন, ''এখন শুল্কের জন্য বস্ত্র থেকে শুরু করে ভারতের কয়েকটি ক্ষেত্রে ধাক্কা লাগবে। তবে তা সামলে নেওয়ার ক্ষমতা ভারতের আছে।''
তার মতে, ''মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডলান্ড ট্রাম্প হলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি পরমুহূর্তে কী করবেন তা কেউ জানেন না। তিনি আজ এককথা বলছেন, একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কাল অন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি আনপ্রেডিকটেবল। সেজন্যই এই আলোচনায় কতটা ফল হবে তা আগে থেকে বলা যাচ্ছে না।''
অঞ্জন রায় কিছুদিন আগে অ্যামেরিকা থেকে ফিরেছেন। তিনি মনে করেন, সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে এই শুল্ক নিয়ে মাথাব্যথা খুব কম। যদি জিনিসের দাম বাড়ে বা পরিষেবা দামী হয়, বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন তারা ক্ষুব্ধ হতে পারে। না হলে বাণিজ্য চুক্তি, শুল্ক নিয়ে তারা মাথায় ঘামায় না।
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''যে পরিস্থিতিতে আলোচনা হচ্ছে, তা অনুকূল পরিবেশ নয়। দুই দেশের মধ্যেই একটা সন্দেহের পরিবেশ আছে। ভারত একটা রেডলাইন টেনে দিয়েছে। তারা রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করবে না। তারা কৃষি ও ডেয়ারি ক্ষেত্রকে খুলে দেবে না। তারপরেও আলোচনা সফল হতে পারে, যদি ট্রাম্প চান এবং মোদী কিছু ক্ষেত্রে শুল্কে ছাড় দেন। সেটা পরের কথা। তবে আলোচনা শুরু হয়েছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।''