সাবেক কূটনীতির রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছে ভারত। বড় মঞ্চের চেয়ে ভারতের কাছে এখন অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ ছোট ছোট জোট।
বিজ্ঞাপন
ভারতে নির্বাচনের আবহে এক অনুষ্ঠানে সদ্য় অবসরপ্রাপ্ত এক কূটনীতিকের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ হলো। স্বাভাবিকভাবেই কূটনীতিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ। আর তার হাত ধরে নানাবিধ কূটনৈতিক জোট। কেবলমাত্র সেদিনের সেই কথপোকথন তুলে দিলেই এদিনের এই লেখা সম্পূর্ণ হতো। কিন্তু যেহেতু একান্ত আলাপচারিতায় গোপনীয়তার দায় ছাড়াই কথাগুলি বলেছিলেন ওই কূটনীতিক, তা-ই তার নাম বা উদ্ধৃতি ব্যবহার করব না এই লেখায়। কিন্তু তার কথার স্পিরিটগুলি ধরার চেষ্টা করবো।
গোড়াতেই বলে নেওয়া ভালো, প্রাতিষ্ঠানিক যে জোটগুলি ঐতিহাসিককাল থেকে বিশ্ব কূটনীতিতে আলোচিত হয়ে আসছে, তা যে কতটা অকেজো হয়ে পড়েছে বর্তমান দুনিয়ায়, সে কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করেছিলেন ওই কূটনীতিক। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন জাতিসংঘ এবং সার্কের প্রসঙ্গ। তিনি যখন জাতিসংঘের সমালোচনা করছেন, মনে পড়ছিল, কয়েকমাস আগে দিল্লিতে জি-২০ চলার সময় আরেক ভারতীয় কূটনীতিক রিভা গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ''জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার আয়তন। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়েছে এই মঞ্চ। আর সে কারণেই আরো নতুন নতুন বিষয়ভিত্তিক মঞ্চের প্রয়োজন বাড়ছে।''
খানিকটা রিভার লাইনেই কথা বলছিলেন অন্য কূটনীতিক। বলছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন সার্কের চেয়ে কোয়াডের গুরুত্ব বেশি। অথবা সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের! তার কথার ভিতর থেকে আসলে যে স্পিরিটটি বার হয়ে আসছিল, তা হলো, বড় মঞ্চ নয়, ছোট ছোট ভূরাজনৈতিক বিষয়ভিত্তিক জোটই এই সময়ের কূটনীতির অন্য়তম চালিকাশক্তি। আপাত চোখে অনেক সময়েই মনে হয়, এই ধরনের ছোট ছোট জোটগুলি আসলে এক ধরনের কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। কিন্তু আপাত চোখে যা স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলে মনে হয়, তা আসলে নয়া ভূরাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের ব্যালান্স বা ভারসাম্য় তৈরি করে। ভারতীয় কূটনীতি এখন সেই ভারসাম্য়ের খেলাটিই খেলতে চাইছে।
ভারতে নতুন সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলি অপেক্ষা করছে
পরপর তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী৷ কিন্তু তার ও সরকারের সামনে প্রচুর চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷
ছবি: RAJAT GUPTA/EPA
বেকার-সমস্যা
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিকদের নিয়ে প্রকাশ করা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এই বছর জানুয়ারি থেকে মার্চে সারা দেশের শহরগুলিতে ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে ১৭ শতাংশ বেকার৷ গোটা ১২ রাজ্যে বেকারের সংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি এবং একটি রাজ্যে তা ৩০ শতাংশের বেশি৷ ফলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা নতুন সরকারের কাছে খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: DW
ছোট ও মাঝারি শিল্পের অবস্থা
ভারতে ছোট ও মাঝারি শিল্প ১১ কোটি মানুষকে কর্মসংস্থান দেয়৷ কিন্তু ধীরে ধীরে ছোট ও মাঝারি শিল্পের অবস্থা খারাপ হচ্ছে৷ ফলে সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে না৷ চাপ গিয়ে পড়ছে কৃষি, নির্মাণ ও অনানুষ্ঠানিক খাতে৷ সেখানেও কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব বেশি বাড়ছে না, কাজের মানও বাড়ছে না৷ ফলে নতুন সরকারের সামনে ছোট ও মাঝারি শিল্পকে চাঙা করার চ্যালেঞ্জ থাকছে৷
ছবি: Manish Kumar/DW
দক্ষ শ্রমিকের চ্যালেঞ্জ
বড় শিল্পগুলিতে অটোমেশন ও রোবট ব্যবহার বাড়ছে৷ সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে৷ এই অবস্থায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে৷ ফলে স্কিল ডেভলাপমেন্ট কর্মসূচি খুবই জরুরি৷ ভারতে এই কর্মসূচি চলছে৷ বণিকসভা সিআইআই-এর রিপোর্ট বলছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রের চাহিদা মেটাতে গেলে ৩০ কোটি দক্ষ শ্রমিক চাই৷ প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায়চৌধুরী বলেছেন, ‘‘দক্ষ শ্রমিক এখন বাজারে আসছে, কিন্তু তারা সংস্থার চাহিদা মেটাতে পারছে না৷’’
ছবি: AP
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ
গতবছর হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, সিকিম-সহ বিভিন্ন জায়গায় ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘ ফাটা বৃষ্টির ফলে চকিত বন্যা হয়েছে৷ হিমাচলে ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে রাজ্য সরকারের দাবি৷ কিছুদিন আগে মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতে একদিনে রেকর্ড বৃষ্টি হয়ে শহর ডুবেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে ভারত৷ বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারতে অসুবিধায় পড়বে গরিবরা৷ অপুষ্টি বাড়বে৷
ছবি: DW
গরম বাড়ছে
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গরমের তীব্রতা বাড়ছে৷ দিল্লির তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে৷ দেশের একটা বড় অংশ তাপপ্রবাহের মধ্যে পড়েছে৷ এপ্রিলে বিদ্যুতের চাহিদা নয় দশমিক চার শতাংশ বেড়েছে৷ জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: Sudipta Das/NurPhoto/IMAGO
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা
কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলি গরিবদের জন্য বিমা প্রকল্প এনেছে৷ কিন্তু স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এখনো অবহেলিত৷ গ্রামের দিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সুযোগসুবিধার একান্ত অভাব৷ ভালো চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ পাওয়া যায় না৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলি অত্যন্ত ব্যয়বহুল৷ ১৪০ কোটি মানুষের জন্য ভালো স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলা সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: Nehal Johri/DW
জিনিসের দাম কমানো
এবারের লোকসভা ভোটে বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ জিনিসের দাম নিয়ে অসন্তোষের কথা বলেছেন৷ ২০২৩-২৪ সালে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছিল এক দশমিক চার শতাংশে৷ এবারও গমের উৎপাদন আগেরবারের তুলনায় কম হবে বলে মিল মালিকদের সংগঠন জানিয়ে দিয়েছে৷ ডাল, তৈলবীজ, মশলার ক্ষেত্রেও একই সাবধানবানী শোনা যাচ্ছে৷ এই অবস্থায় দাম কমানোটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: Avijit Ghosh/REUTERS
কৃষকদের দাবি মেটানো
লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার কৃষক বিক্ষোভ হয়েছে৷ কৃষকদের দাবি, ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্যকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে৷ অর্থাৎ, কেউ যদি সরকারের বেঁধে দেয়া দামের থেকে কম দাম দিয়ে ফসল কেনে তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে৷ প্রধানমন্ত্রী মোদী কৃষকদের এই দাবি মানতে এতদিন রাজি হননি৷ এবার কৃষকদের দাবি মানা বা তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করাটা নিঃসন্দেহে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: Elke Scholiers/Getty Image
8 ছবি1 | 8
দুইটি উদাহরণ দেওয়া যাক-গত কয়েকবছরে কোয়াড নিয়ে ভারত অত্য়ন্ত সরব। কোয়াড অর্থাৎ, অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের জোট। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই জোটের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্ল্যাসিকাল কূটনীতি বলবে, এই জোট আসলে চীনের সামনে একটি ব্য়ারিকেড তৈরির জন্য় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কথা ভুল নয়। কোয়াড নিয়ে বিশ্ব মঞ্চে বার বার নিজের অসম্মতি জানিয়েছে চীন। এই জোটের যৌথ সমুদ্র মহড়া নিয়ে নালিশও করেছেন শি জিনপিং। কিন্তু এই জোটে অংশ নেওয়ার অর্থ কি ভারত সার্বিকভাবে একটি চীন-বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে? ক্ল্যাসিকাল কূটনীতি সেদিকে ইঙ্গিত করলেও নয়া কূটনীতি তা বলবে না। নয়া কূটনীতি তখন সামনে নিয়ে আসবে সাংহাই কোঅপারেশনের অঙ্ক। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে এই জোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভারত। আর এখান থেকেই তৈরি হয় ভারসাম্য়ের নতুন তত্ত্ব। যেখানে কারও সঙ্গে না থেকেও আসলে সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার একটা অবস্থান তৈরি করা।
ক্ল্যাসিকাল জোটগুলি এই অবস্থানের জায়গাটি তৈরি করতে পারেনি। সেখানে সবটাই অনেকবেশি মেরুকৃত। সম্প্রতি রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান এবং ইসরায়েল-হামাস দ্বন্দ্বে সেই মেরুকরণ আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছে। ভারত খুব সতর্কভাবে এই মেরুকরণের রাস্তা এড়িয়ে একটি তৃতীয় পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। আর এইটাই এই মুহূর্তে ভারতের কূটনৈতিক লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য়ে পৌঁছাতে ভারত ব্য়বহার করছে ছোট ছোট বিষয়ভিত্তিক জোটগুলিকে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথম সরকারে আসেন, তার কিছু বছর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার অ্যামেরিকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু চুক্তি বা নিউক ডিল সই করেছিল। ভারতে পরমাণু গবেষণার দ্বার যেমন খুলে দিয়েছিল এই চুক্তি, তেমনই ভারতকে পরমাণু শক্তি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছিল। উল্লেখ্য, পরমাণু পরীক্ষা এর অনেক আগে করলেও ভারতের উপর জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই চুক্তি সেখান থেকে উত্তরণ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই চুক্তির ক্ষেত্রেও ভারত সাবেক জোট বা মঞ্চকে ব্যবহার না করে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার উপর জোর দিয়েছিল অনেক বেশি।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেই প্রথম শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কের সমস্ত নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন ভারতের 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতি। অর্থাৎ, কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। ১০ বছরে সেই পথেই কি চলেছেন মোদী? একদিকে এই প্রশ্নের উত্তর যেমন 'হ্যাঁ', তেমন অন্যদিকে 'না'।
গত ১০ বছরে মোদীভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিকে একটি পপুলার ডিসকোর্সে নিয়ে গেছেন। এটি আর কেবল কূটনীতির আলিন্দে আলোচনার বিষয় নয়। দেশের মানুষ এখন এনিয়ে কথা বলেন, আলোচনা করেন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে ডায়াস্পোরার সঙ্গে দেখা করেন মোদী। তাদের নিয়ে সভা করেন। এবং ক্রমে যে বার্তাটি তিনি তৈরি করে ফেলেছেন, তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ ভারত নয়, ভারতীয় কূটনীতির মূল আধারটি হলো হিন্দুত্ববাদ। যে কারণে অন্য় দেশে গিয়ে মন্দির উদ্বোধনকেও ভারত এখন কূটনীতির অংশ বলে মনে করে। ভারতের এই হিন্দুত্ববাদী পররাষ্ট্রনীতি একদিকে যেমন 'বিশ্বগুরু'র ধারণা তৈরি করেছে, আবার অন্য়দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ক্ষোভের কারণও হয়েছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ মালদ্বীপ। যে মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তারাই সে দেশ থেকে ভারতকে সেনা ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি চীনপন্থি হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। চীন লাদাখ এবং অরুণাচলে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। আবার এই পরিস্থিতিতেই করোনার টিকা সবার আগে এই প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে দেয় ভারত। যে মালদ্বীপের সঙ্গে এত বৈরিতা, সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নিজের তৃতীয় দফার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান মোদী। অর্থনৈতিকভাবে যে শ্রীলঙ্কা অনেক বেশি চীন অভিমুখী হয়ে পড়েছিল, অর্থনৈতিক সংকটে তার পাশে দাঁড়ায় ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত যেভাবে তেল কিনেছে, পাকিস্তান কীভাবে তা কিনতে পারে, সে পরামর্শ চাওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে। আর এই প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনেই কোনো না কোনোভাবে কাজ করেছে ছোট ছোট বিষয়ভিত্তিক জোট বা মঞ্চের গুরুত্ব।
বর্তমান কূটনীতিকেরা মনে করেন, ভারসাম্য়ের এই কূটনীতি ভারতকে বিশ্বের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তবে একই সঙ্গে একথাও সত্যি, ভারসাম্য়ের এই অবস্থান এক অতি সূক্ষ্ম সুতোর উপর দাঁড়িয়ে। সামান্য চ্যূতি ঘটলেই ভারত বড়সড় বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অ্যামেরিকা বা ইউরোপ যে ভালো চোখে দেখছে না, তা একবার নয়, বার বার বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে ভারতকে। আবার অ্যামেরিকার সঙ্গে অতি বন্ধুত্ব রাশিয়া বা চীন যে ভালো চোখে দেখছে না, তা-ও স্পষ্ট। আর এই বৃহত্তর ভারসাম্য়ের কূটনীতির উপরেই দাঁড়িয়ে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বা আরো ছোট করে বললে, ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলে ভারতের গুরুত্ব। এই ভারসাম্য়ের তত্ত্বই শেষপর্যন্ত ঠিক করবে ভারত কতদূর পর্যন্ত 'বিশ্বগুরু' হতে পারবে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ন্যাটো
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ৩২টি পশ্চিমা রাষ্ট্রের সামরিক জোট ন্যাটোর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, আবার ফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি।
ছবি: Gints Ivuskans/Getty Images/AFP
ন্যাটোয় ঢুকবে ইউক্রেন?
ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। কিন্তু দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করে রাশিয়ার আক্রমণের পর, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইউক্রেনের প্রতি ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সদস্যপদ প্রাপ্তি এখনও অনেক দূরের পথ। অনেক দেশই মনে করে এমন পদক্ষেপ রাশিয়াকে আরো উসকে দিতে পারে। তাছাড়া দেশটির বিভিন্ন নীতি এখনও ন্যাটোর মানে পৌঁছায়নি বলেও মনে করে অনেক দেশ।
ছবি: Artur Widak/NurPhoto/picture alliance
ন্যাটোর নতুন সদস্য
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলা দুই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোয় যোগ দিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত ফিনল্যান্ডের। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ড আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, এমন ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা থেকেই মূলত নিরপেক্ষতা নীতি ভেঙে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোতে যোগ দেয় দেশটি। সুইডেন জোটে যোগ দেয় ২০২৪ সালের মার্চে।
ছবি: Pond5 Images/IMAGO
পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর উপস্থিতি
রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কায় রয়েছে পূর্ব ইউরোপের নানা দেশ। পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশে ন্যাটোর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। ন্যাটো জানিয়েছে, এর মাধ্যমে জোটটি আবারও স্পষ্ট করছে, 'জোটের এক সদস্যের ওপর আক্রমণের মানে সবাইকে আক্রমণ'। পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশে ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া।
ছবি: U.S. Army/Zuma/imago images
বাল্টিকে সবচেয়ে বড় মহড়া
বাল্টিক সাগর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ১৯৭১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক মহড়া করে আসছে ন্যাটো। এই মহড়াকে সংক্ষেপে বলা হয় বাল্টোপস। ২০২৪ সালের ৭ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাল্টোপসের ৫৩তম সংস্করণ ন্যাটোর ইতিহাসে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। ২০টি দেশ থেকে আসা নয় হাজার সৈন্য অংশ নেন এতে। ৩০টি যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও স্থল ও আকাশপথেও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
নড়বড়ে মার্কিন অবস্থান
২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে ইউরোপে ন্যাটোর সহযোগীদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ন্যাটোর চুক্তি অনুসারে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের জিডিপির দুই শতাংশ ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বাজেট হিসাবে দেয়ার কথা। বেশিরভাগ দেশই তা না করায় যুক্তরাষ্ট্রকেই জোটের প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ বহন করতে হয়। এ নিয়ে সমালোচনা করায় জোটের অংশীদারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
ছবি: Nicholas Kamm/AFP
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার জিততে পারেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ন্যাটোর সদস্যদের নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্য ভাবিয়ে তুলেছে অনেককে। ফেব্রুয়ারিতে প্রচারণায় তিনি বলেছেন, কোনো দেশ বাজেট বরাদ্দ না করলে তাদের আক্রমণে তিনি রাশিয়াকে 'উৎসাহিত' করবেন। এই মন্তব্যকে 'ভয়াবহ এবং অনাকাঙ্খিত' বলে নিন্দা জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এসব মন্তব্যে 'ন্যাটোর সদস্যরা ঝুঁকিতে পড়ছে' বলে মন্তব্য করেছেন ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/E. Vucci
শীর্ষে সম্ভাব্য পরিবর্তন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে জোটের নতুন প্রধান নিয়োগ দেয়া হতে পারে। বর্তমান প্রধান নরওয়ের ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গের মেয়াদ বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। তবে এবার সে পদে বিদায়ী ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বেশ এগিয়ে রয়েছেন। হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাকে সরাসরি সমর্থনও জানিয়েছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নানা বিষয়ে সহজে বোঝাপড়ার করার ইতিহাস রয়েছে তার।
ছবি: NATO
ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে ইউরোপের নিরাপত্তা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সংকটে পড়েছিল। এরপরই ইউরোপের রাজনীতিতে জোরেসোরে উচ্চারিত হতে থাকে ন্যাটোর বিকল্প একটি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের মূলে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ। তবে এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা এ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনায় পৌঁছাতে পারেননি।