1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভার্চুয়্যাল বনাম একচুয়্যাল রিয়েলিটি

সঙ্গীতা ইমাম, শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
সঙ্গীতা ইমাম
২৫ আগস্ট ২০২৩

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমা এ সময়ে আমরা নিজেদের হাতে বানানো একটি বুদ্বুদ বলয়কেই প্রকৃত পৃথিবী মনে করছি। এ যেন গল্পে পড়া সেই কুয়োর ব্যাঙের মতো।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমার এ সময়ে আমরা নিজেদের হাতে বানানো একটি বুদ্বুদ বলয়কেই প্রকৃত পৃথিবী মনে করছিছবি: Imago/Westend61

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টুইটার, টিকটকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবর্তিত আমাদের জীবন। 

জীবনের ব্যাপক অর্থ আজ গন্ডিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়্যাল জগতের লাইক-শেয়ার-কমেন্টে। বই থেকে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে, পারিবারিক সম্পর্ক-দায়িত্ব থেকে; এমনকি সন্তান-সন্ততি থেকে আজ দূরে সরিয়ে নিচ্ছে এইসব নব্য নেশা, যার পোশাকি নাম সামাজিক যোগাযোগ।

মানুষের মানবিকতা আর মূল্যবোধ আজ হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জৌলুশে। মানুষ এখন দায়-দায়িত্বহীনভাবে যে কোনো ঘটনা কেবল প্রকাশ করতেই বেশি আগ্রহী। সামনে দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে কাতরাতে দেখলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছবি তুলতে আর লাইভ করতে। এতে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষটি বাঁচুক কী মরুক, তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না। একই ঘরে বসে আছি, সামনে চলছে টেলিভিশন আর পরিবারের সদস্যরা যার যার হাতে যন্ত্র নিয়ে নিমগ্ন; ঘরে টেলিভিশনের ব্যর্থ বিনোদন। টিএসসি কিংবা মধুর ক্যান্টিনে আড্ডার চেহারাটাই পাল্টে গেছে আজকাল। আড্ডা মানে তুমুল হর্ষধ্বনি, প্রাণখোলা হাসি বা তর্কের যুদ্ধ; কিন্তু আজকাল আড্ডাজুড়ে থাকে পিন পতন নীরবতা। বেলাশেষের খাবার টেবিলেও প্রত্যেক সদস্যের হাতে মোবাইল, কী খাচ্ছেন জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতেও পারবেন না অনেকে। অথচ একসময় এই খাবার টেবিলই ছিল সারাদিন কে কী করেছেন সেই সুখ-দুঃখের আলাপচারিতার ক্ষেত্র। এ থেকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বন্ধুদের মধ্যে, বাবা মায়ের কাছে অচেনা হয়ে যাচ্ছে সন্তানেরা। বাবা মায়ের মনোযোগ না পেয়ে অভিমানী সন্তান দূরে সরতে সরতে অনেক সময় আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে। এসব সংবাদ গণমাধ্যমেও আসছে।

চারপাশের অনেক বয়স্ক বা মাঝ বয়সীদের মধ্যে দেখছি ফেসবুককে জীবনের ধ্যান জ্ঞান মনে করে এখানে যে যা বলছেন তাকেই ধ্রুব বলে বিশ্বাস করে এক অলীক জগতে বসবাস করছেন। ফেসবুকের বন্ধুরা কাউকে কাউকে নানা উপাধি দিয়ে যেভাবে মাথায় তোলেন এইসব ভক্ত গুণগ্রাহীদের কিন্তু কোনো প্রয়োজন বা বিপদে খুঁজে পাওয়া যায় না একমাত্র ফেসবুক কমেন্ট সেকশন ছাড়া। কিন্তু যাকে প্রশংসায় আকাশে তুলেছেন তিনি তো এদেরকে নিজের শক্তি জেনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব পাথুরে মাটিতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন তিনি একলা। ফেসবুক যেনো এক এক ভুলের স্বর্গ, এক কল্পলোকের বদ্বুদ।

অধুনা কিছু ফেসবুক সেলিব্রেটি তৈরি হয়েছেন যাদের সকল ভাষণ, আন্দোলন আর প্রচার সবই ফেসবুকনির্ভর। যে আন্দোলনে ফেসবুকে বড় বড় বাতেলা দেন, জনমত গঠন করেন, সে আন্দোলনে রাজপথে বা প্রতিবাদে সশরীরে তাঁর ছায়াটি পর্যন্ত দেখা যায় না। তবে অন্যের তোলা ছবি বা ফটোশপ ছবি ঠিকই পাওয়া যায় তাঁর ওয়ালে। আবার এদের একদল নিজের অনলাইন জনপ্রিয়তাকে অস্ত্র করে গুজব প্রচারও করে যাচ্ছেন, যা দেশে বা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। মিথ্যার এ প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ সমাজ নানা ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কম সচেতন জনগণকে বিপথে চালিত করছে এ ধরনের অনৈতিক কাজ।

স্বল্প আয়ের বা স্বল্প শিক্ষত তরুণেরা টিকটক নামের ভাইরাসের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার স্বপ্নে বিভিন্ন রকম অসামাজিক ভিডিও বানিয়ে প্রচার করে অর্থ উপার্জন করছে। কিশোর-কিশোরীরা এতে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। কিশোরীরা নানা অঙ্গভঙ্গি ও অশ্লীল ছবি প্রদর্শন করে বিপদ ডেকে আনছে নিজের জীবনে। কিশোররা বিভিন্ন ক্রাইম করে তার ভিডিও ভাইরাল করছে বিপদ না বুঝে। এতে করে একটা প্রজন্ম বিপথে চলে যাচ্ছে।

আমিনিজেই কিছু কিশোরকে জানি যারা লেখাপড়া, কাজকর্ম বাদ দিয়েছে টিকটকে উপার্জনের নেশায়। এ নেশা কোন মতেই মাদকের চেয়ে কম বিপদজনক না। এরাই ক্রমে মাদকসেবীতে পরিণত হয়।

সঙ্গীতা ইমাম, সংস্কৃতিকর্মীছবি: Sangeeta Imam

কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করে অনলাইন একটি কার্ড বা ইভেন্ট তৈরির একটি প্রচলন আজকাল শুরু হয়েছে। ব্যাপারটি ভালো। বেশ প্রচার হয় অনুষ্ঠানটির। বার্তাটি অনেকের কাছে পৌঁছানো যায়। কিন্তু going আর interested এর সংখ্যা যদি মিলনায়তনে উপস্থিতির সাথে মিলাতে চান, তবে ভুল করবেন আয়োজক। আর সেই সংখ্যা অনুযায়ী আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলে তো অবশিষ্ট খাবার এতিমখানায় পাঠাতে হবে।

প্রশ্ন হলো, তাই বলে কি আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করবো না? এর কি কোনো ভালো প্রভাব নেই? অবশ্যই আছে। সবকিছুই নির্ভর করে কীভাবে মাধ্যমগুলো আমরা ব্যবহার করবো তার ওপর। নতুন পাঠক্রমে শিক্ষার্থীদের গুগল, ইউটিউব ব্যবহার করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। কম্পিউটার ব্যবহার করে প্রজেক্ট, প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হয়। এমতাবস্থায় শিশু-কিশোরদের কী করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা কম্পিউটার ব্যবহার থেকে দূরে রাখবো? দূরে রাখলে বিশ্ব বাস্তবতায় তারা পিছিয়ে পড়বে।

একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি যেহেতু এখন পাঠ্যক্রমে আইসিটি নামে একটি বিষয় আছে, সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বিধি, অনলাইনে গুজব চেনার উপায় জানা, ফেইক নিউজ চিহ্নিত করা এ ধরনের সময়োপযোগী বিষয় সংযুক্ত করা উচিত। প্রজন্মকে বিভিন্ন অশুভ প্রলোভন থেকে মুক্ত রেখে সঠিক পথে পরিচালিত করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

আইসিটি এক্টে বন্দি করা কোন সমাধান নয়। এসব বিধিতে যথার্থ অপরাধীর চেয়ে নিরপরাধ বা না বুঝে ভুল করা মানুষই ধরা পড়েন বেশি। সে কারণে সকল বয়সী মানুষকে যথাযথভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের শিক্ষা দেয়া জরুরি।

সঙ্গীতা ইমাম বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মী
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ