1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভালো সিনেমা, খারাপ সিনেমা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৫ জুন ২০১৭

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে হতাশা বহুদিনের৷ দর্শক হলে সিনেমা দেখতে যায়না– এটা এই শিল্পে জড়িতদের অনেক দিনের আক্ষেপ৷ আর দর্শকদের কথা– সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই, ভালো সিনেমা নেই৷ এ যেন অর্থনীতির দুষ্টচক্রের পুরনো গল্প৷

বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার?
ছবি: DW/M. Mamun

তবে এই সময়েও নিয়মিত সপরিবারে গিয়ে সিনেমা দেখেন শেরিফ আল শায়ার৷ একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ বিভাগের প্রধান তিনি৷ শায়ারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কেন হলে গিয়ে সপরিবারে সিনেমা দেখেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এই সময়ে বিনোদেন বলতে ফাস্ট ফুড সেন্টারে গিয়ে ফাস্ট ফুড আর কফি খাওয়া৷ কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে পার্কে নিয়ে গেছেন, খেলার মাঠে নিয়ে গেছেন৷ সিনেমা হলে নিয়ে গেছেন৷ বিনোদনের নানা মাত্রিকতা তাঁরা আমাকে দিয়েছেন৷ আমিও আমার সন্তান এবং পরিবারের সদস্যদের সেই বিনোদন দিতে চাই৷ তাই নতুন সিনেমা রিলিজ হলে তাদের গিয়ে হলে গিয়ে আমি দেখি৷'' 

Sherif Al Shire - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

শায়ার তার নিজম্ব অভিজ্ঞতায় জানালেন, ‘‘বছরে যদি ১০০ চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, তাহলে তার মধ্যে ৭/৮টি সিনেমা মৌলিক৷ বাকি সিনেমাগুলো প্রধানত ভারতীয় সিনেমার অনুকরণে হয়ে থাকে৷ আমাদের এখানে ভারতীয় সিনেমার অনুকরণ বা না নকল প্রবণতা এখনো প্রবল৷ তবে মৌলিক গল্পের সিনেমাও যে দর্শক টানবে তার নিশ্চয়তা সব সময় দেয়া যায় না৷ আয়নাবাজী সিনেমাটা মৌলিক গল্পের৷ আমার মনে হয়, এটা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির কারণে৷ কিন্তু মোরশেদুল ইসলামের  মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা ‘অনিল বাগচীর একদিন' দর্শকপ্রিয়তা পায়নি৷ হুমায়ূণ আহমেদের গল্পে তৈরি এই সিনেমাটি যেদিন আমি হলে দেখতে যাই, সেদিন আমিসহ দর্শক ছিলামা ৫ জন৷ কিন্তু সিনেমাটির প্রশংসা করেছেন সবাই৷ বিপরীতে  দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনার কমার্শিয়াল ছবি ‘শিকারী' রিলিজ হওয়ার দেড় মাস পরে গিয়েও আমি দেখি হল ভর্তি দর্শক৷ তাই মৌলিক ভাল সিনেমা বানালেই চলবে না, মার্কেটিংটাও বুঝতে হবে৷''

এর সঙ্গে হলের পরিবেশকেও গুরুত্বপূর্ণ বললেন শায়ার৷ তিনি বলেন, ‘‘বসুন্ধরা, যমুনা ফিউচার পার্ক বা শ্যামলি সিনেপ্লেক্সে দর্শক যান ভালো পরিবেশের কারণেই৷ আর কারওয়ান বাজারের সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া পূর্ণিমা সিনেমা হলে গিয়ে দুর্গন্ধের কারণে আমাকে ১৫ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে আসতে হয়৷''

১৯৫৩ সালে ‘মুখ ও মুখোশ' দিয়ে ছবি নির্মাণ শুরু হয় বাংলাদেশে৷ ১৯৫৪ সালে এটি মুক্তি পায়৷ বলা হয়ে থাকে,  ১৯৫৩ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আমাদের চলচ্চিত্র হিন্দি ও ঊর্দু ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতো৷ একটা সময় পর্যন্ত জহির রায়হান, ফতেহ লোহানী, শুভাষ দত্তরা সিনেমা নির্মাণ করতেন৷ স্বাধীনতার পর তখনকার শিল্পীদের দাবির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হিন্দি ও ঊর্দু ছবির আমদানি বন্ধ করে দেন৷ এরপর ৭০-এর  দশক জুড়ে মৌলিক ছবির বাজার ছিল গর্ব করার মতো৷ ৮০'র দশকের শেষের দিকে এসে নকল গল্পের ছবি প্রবেশ করে৷ ৯০ দশকের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল নকল গল্পের আধিপত্য৷ নব্বই দশকের শেষের দিকে, ১৯৯৭ সালের দিকে দেশীয় চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা প্রভাব বিস্তার করে৷ ২০০৮ সাল পর্যন্ত এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে৷

Mahmood Manjoor - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

চলচ্চিত্র এবং বিনোদন সাংবাদিক মাহমুদ মানজুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন মৌলিক সিনেমা হাতে গোনা৷ বছরে বড়জোর তিন-চারটি মৌলিক সিনেমা হয়৷ এখানকার অধিকাংশ সিনেমাই হিন্দি, তেলেগু বা তামিল সিনেমার নকল৷ গান থেকে শুরু করে গল্প পোস্টার, সিকোয়েন্স সবই নকল৷ সিনেমার পোস্টারে ঋত্বিক রোশনের ফিগারের ওপর শাকিব খানের মাথা বসিয়ে দেয়া হয়৷''

এমন হবার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘প্রযোজক হয়তো কোনো একটি হিন্দি সিনেমা দেখে তার মতো করে একটি বাংলা সিনেমা বানাতে চাইছেন৷ তিনি যেহেতু বিনিয়োগ করবেন, পরিচালককে তা-ই করতে হবে৷ এছাড়া ভালো স্ক্রিপ্ট এবং পরিচালকেরও অভাব আছে৷''

২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যোগ হয় ডিজিটাল প্রযুক্তি৷ এ সময় ‘খোঁজ দ্য সার্চ'সহ বেশ কিছু বিকল্পধারার ছবি নির্মিত হয় ডিজট্যাল ফরম্যাটে৷ ২০১২ সালে এসে জাজ মাল্টিমিডিয়া দেশীয় চলচ্চিত্রে প্রায় ৫০টি সিনেমা হলে ডিজটাল প্রযুক্তি স্থাপন করে৷ এখন দেশের প্রায় শতভাগ সিনেমা ডিজিট্যাল প্রযুক্তিতে নির্মিত ও প্রদর্শিত হয়৷

সিনেমা হল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন ভালো সিনেমা নেই বলে হলে দর্শক আসে না৷ নানা কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমরা আর আগের মতো ব্যবসা করতে পারি না৷ আগে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স ছিল৷ এখন ভ্যাট দিতে হয়৷''

‘ভালো সিনেমা' সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যে ছকি দর্শক টানে, তেমন ছবি৷ নাচ গান তো থাকতেই হবে, তার সঙ্গে গল্পও ভালো থাকতে হবে৷''

২০১৪ সাল থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে নতুন একটি ধারা চালু হয়৷ শুরু হয় ঢাকা-কলকাতার যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ৷ অভিযোগ রয়েছে, চলমান যৌথ প্রযোজনার নামে টলিউড দখল করতে চায় বাংলাদেশের বাজার৷ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক মাহমুদ মানজুর বলেন, ‘‘ দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় ছবি করার নামে আসলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কোনো উন্নতি হচ্ছে না৷ ভারতে কোলকাতার বাংলা সিনেমা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় তারা এখন বাংলাদেশের বাজার দখল করতে চাইছে৷ সেখানকার শিল্পীরাও তাদের কাজের জায়গা খুঁজছেন বাংলাদেশে৷''

Hasibur Reza kallol - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশে এখন বছরে ৫০ থেকে ৬০টা ছবি মুক্তি পায়৷ ঈদকে সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি ছবি মুক্তি পায়৷ তবে প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরে ১০টির বেশি ছবি ব্যবসা করতে পারে না৷ আর এই ব্যবসাও খুব বেশি না৷

একটি সিনেমা তৈরি করতে এখানে ৬০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হয়৷ তবে যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলোতে ৫ থেকে ৭ কোটি টাকাও খরচ হয়৷ মূল শিল্পীদের (নয়াক-নায়িকা) পারিশ্রমিক দুই লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত৷ তবে একমাত্র ব্যবসাসফল নায়ক শাকিব খান আগে ৩০ লাখ নিতেন, এখন ২০-২৫ লাখেও কাজ করেন৷

তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা হসিবুর রেজা কল্লোল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে৷ ভারতের বাংলা ছবি আমদানি করে এখানকার হল বুক রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে৷ আর সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সঙ্গে যদি হয়, তাহলে যৌথ প্রযোজনার ছবি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে৷''

আক্ষেপ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সিনেমার শিল্পী, কলা-কুশলীরা বেকার হয়ে পড়ছেন৷ একটি চক্র তাদের লাভের জন্য বাংলাদেশের সিনেমা চলে না– এই কথা বলে অন্যদের বাজার দিয়ে দিতে চাইছে৷''
বাংলাদেশে ৯০-এর দশকে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১২০০৷ এখন তা কমে ২৫০ থেকে ৩০০-তে নেমে এসেছে৷ হল মালিকরাও ব্যাবসা করতে পারছেন না৷

অনেকে সিনেমা হল বন্ধ করে দিয়ে মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্ট, শপিং কমপ্লেক্স  তৈরি করেছেন৷ দেশে এখন ৩০০ সিনেমা হল থাকলেও সব মিলিয়ে ১০০ হলেও দর্শকের জন্য ভালো পরিবেশ নেই৷ তবে সিনেপ্লেক্সগুলোর পরিবেশ ভালো৷

Mia Alauddin - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

অভিযোগ রয়েছে, সিনেপ্লেক্সগুলো ৪০০ টাকার টিকিটে প্রযোজককে দেয়া হয় মাত্র ৩৭ টাকা৷ হলগুলো গড়ে ১০০ টাকার টিকিটে প্রযোজককে দেন ১১ টাকার মতো৷ বাকি টাকার ব্যয় দেখানো হয় ভ্যাট, হল রক্ষণাবেক্ষণ, এসিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধায়৷ সিনেমা হল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা নির্ভর করে হলের ওপর৷ একেক হলে প্রযোজকদের একেক রকম মুনাফা দেয়া হয়৷''

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয় ভালো সিনেমা তৈরির জন্য অনুদান দেয় প্রতিবছর৷ এফডিসির মাধ্যমে সিনেমার মান উন্নয়নে কাজের কথা বলা হচ্ছে৷ তারপরও পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না৷ তামিল-তেলেগু ছবির নকল এখানে যেন জেঁকে বসেছে৷

আরপরও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মৌলিক ছবি দর্শকদের নাড়া দিয়েছে৷ ব্যাচেলর, থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার, মনপুরা, আয়নাবাজীর নাম সেক্ষেত্রে বলাই যায়৷ এছাড়া  অজ্ঞাতনামা, জালালের গল্প, আন্ডারকনস্ট্রাকশন, অনিল বাগচির একদিন, বাপজানের বায়োস্কোপ-এর মতো ছবিগুলোও সাড়া ফেলেছে৷

চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখানে ভালো সিনেমা হয় না এটা একটা ঢালাও মন্তব্য৷ এখানে ভালো সিনেমা হয়, আবার খারাপ সিনেমাও হয়৷ পৃথিবীর সব দেশেই ভালো সিনেমা খারাপ সিনেমার চেয়ে কম৷ তাই আমি ঢালাও মন্তব্য মানতে রাজি নই৷  গত ৫-৭ বছরে ভালো কিছু ছবি তৈরি হয়েছে৷ সমালোচকরা সেগুলোর প্রশংসা করেছেন৷ দেশে-বিদেশে দর্শকরা খুব পছন্দ করেছেন৷ আবার এমন কিছু ছবিও দর্শকরা খুব পছন্দ করেছেন যেগুলো ক্রিটিক্যালি ভালো নয়৷''

Farooki - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তিনি বলেন, ‘‘সব ছবি হিট হয় না৷ বছরে হাতে গোনা কয়েকটি ছবিই হিট হয়৷ ভারেতও তাই৷ আমরা প্রায়ই শুনি দর্শক হলে যায় না৷ আমি যখন থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার বানাই, প্রথমে টেলিভিশনে দেখাই৷ অনেকে বললেন, না, না এইসব সিনেমা তো দর্শক হলে গিয়ে দেখবে না৷ কিন্তু বাস্তবে যখন হলে দিই, তখন দর্শক হলে যায় এবং দেখে৷ তারপর তো ইতিহাস৷ আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার৷ আমরা এখানে যে নতুন গল্পগুলো উপহার দিচ্ছি নতুন ধারার, এসবের দর্শক আছে৷ দর্শক এটা দেখতে যায়– এই জিনিসটা বুঝতে হবে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা যারা সিনেমা বানাই, তাদেরও খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা যেন জীবনের বিচিত্র সব গল্প তুলে আনি৷ এক জায়গায় আটকে থাকলে চলবে না৷ এখানে যেমন শিকারী লাগবে, তেমন আয়নাবাজী লাগবে৷ লাগবে থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বার৷ ছবিটা দেখে দর্শকরা যেন বোঝে আপনি ছবিটি কেন বানিয়েছেন৷ হল থেকে ছবিটি যেন দর্শকের বাসা পর্যন্ত আসে৷ তাহলেই হবে৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ