তরুণ নির্মাতাদের কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকার পরামর্শ দিলেন ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বার্লিনালে এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস ফিপ্রেস্কি-র সদস্য হিসেবে ৬৮তম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ক্রিটিক জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আহমেদ মুজতবা জামাল৷
ডয়চে ভেলে:বার্লিনালেতে এ নিয়ে কতবার এলেন? কেমন লেগেছে এবারের উৎসব?
আহমেদ মুজতবা জামাল: এ নিয়ে আমার পাঁচবার আসা হলো৷ প্রথমবার এসেছিলাম ১৯৯৭ সালে৷ ১৯৯৮ তে ক্রিটিক্স জুরি হয়ে এসেছিলাম৷ এবারও ক্রিটিক্স জুরি হিসেবে এসেছি৷
এ বছর কী ধরনের চলচ্চিত্র এসেছে এবং কোনগুলো আপনার কাছে বেশি ভালো লেগেছে?
ফিপ্রেস্কিতে জুরি হওয়ার সুবাদে ফোরামের অনেক ছবি দেখার সুযোগ হয়৷ এখানে বড় বাজেটের বা বাণিজ্যিক কোনো ছবি থাকে না, তাই তরুণ প্রতিভাবান অনেক পরিচালক এখানে তাদের মুভিগুলো দেখানোর সুযোগ পান, যেগুলোর বেশ কয়েকটি আমাকে অভিভূত করেছে৷ তাদের চিন্তা ভাবনায় নতুনত্ব আছে৷ এরা ভবিষ্যতে বড় পরিচালক হবে বলে মনে করি আমি৷ ফোরাম থেকে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া একটি ছবির পরিচালক মুভিটি বানানোর পরে আত্মহত্যা করেন, তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর৷ তার ছবিটি অসাধারণ ছিল৷
বার্লিনালে ২০১৮: যৌনতার হলো জয়
এবারের বার্লিনালে পুরস্কারে বেশ কিছু বিষয়ে ছিল ভিন্নতা৷ সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেরা ছবির জন্য ‘গোল্ডেন বেয়ার’ জিতেছে ‘টাচ মি নট’৷ পুরস্কারগুলোতে ছিল নারীদের আধিপত্য৷
ছবি: Manekino Film, Rohfilm, Pink, Agitprop, Les Films de l'Etranger
সেরা ছবি: ‘টাচ মি নট’
কেবল দর্শকদের কাছেই নয়, এই ছবিটি যে সেরা হবে সেটা ছবির পরিচালকও ভাবতে পারেননি৷ শারীরিক নৈকট্য বা স্পর্শ নিয়ে ভীতি এবং তা থেকে উত্তোরণ এই ছবির মূল বক্তব্য৷ রোমানিয়ার নারী পরিচালক আদিনা পিনতিলির এই চলচ্চিত্রে যৌনতা নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে যে সেটা অনেক দর্শকের বিরক্তির উদ্রেক করেছে৷
ছবি: Getty Images/T. Niedermueller
গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার: ‘মাগ ’
‘মাগ ’ সিনেমার জন্য গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কারের ‘সিলভার বেয়ার’ জিতেছেন পোলিশ নারী পরিচালক মালগোরজাতা সুমোস্কা৷ এক উচ্ছল তরুণের দুর্ঘটনায় জীবনে কত নাটকীয় পরিবর্তন আসে তা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি৷
ছবি: Getty Images/T. Niedermueller
সেরা অভিনেত্রী: ‘দা হায়ারএসেস’-এর আনা ব্রুন
প্যারাগুয়ের এই চলচ্চিত্রে মূলত সেই দেশের রক্ষণশীল সমাজে নারীদের অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে৷ এই সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন আনা ব্রুন৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Schwarz
সেরা অভিনেতা: ‘দ্য প্রেয়ার’-এর অ্যান্থনি ব্যাজো
সেরা অভিনেতার সিলভার বেয়ার জিতেছেন ফরাসি অভিনেতা অ্যান্থনি ব্যাজো৷ মাদকাসক্ত এক যুবকের ভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয় দর্শকদেরও মন জয় করেছে৷
ছবি: Getty Images/T. Niedermueller
সেরা পরিচালক: ‘আইল অফ ডগস’-এর জন্য ওয়েস অ্যান্ডারসন
‘আইল অফ ডগস’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের সিলভার বেয়ার জিতেছেন মার্কিন পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন৷ অ্যানিমেশন এই ছবিটি সেরা ছবির পুরস্কার পাবে বলে ভেবেছিলেন বেশিরভাগ দর্শক৷ ছবিতে কুকুরের কণ্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা বিল মারে৷ পরিচালকের পক্ষে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন৷
ছবি: 2017 Twentieth Century Fox
সেরা স্ক্রিনপ্লে: মিউজিয়াম
মেক্সিকান পরিচালক আলোনজো রুইসপালকিওস সেরা স্ক্রিনপ্লে’র পুরস্কার জিতেছেন৷ ৮০'র দশকে মেক্সিকো সিটির একটি জাদুঘরকে কেন্দ্র করে এই ছবিটি নির্মিত৷
ছবি: Alejandra Carvajal
সেরা আন্তর্জাতিক স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র: ‘দ্য মেন বিহাইন্ড দ্য ওয়াল’
ইসরায়েলের নারী পরিচালক ইনেস মোলদাভস্কির এই ছবিটি গাজা সীমান্ত বরাবর দেয়ালকে ঘিরে৷ দেয়ালের দুই পারে মানুষের মধ্যে ফোন সেক্স নিয়েই এর কাহিনি৷
ছবি: Getty images/ T. Niedermueller
7 ছবি1 | 7
আপনারা যাঁরা বিচারক হিসেবে থাকেন, তাঁরা পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেন?
এক এক ফেস্টিভ্যালের এক এক ক্যারেক্টার থাকে৷ ১৯৯৮ সালে আমি যখন প্রথম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আসি, তখন সেন্ট্রাল দ্য ব্রাজিল, ওয়াল্টার সিলেসের একটা মুভি সেবার গোল্ডেন বেয়ার পায় বার্লিনালেতে৷ আমি যে বিভাগের জুরি ছিলাম, সেখানে বললাম এই মুভিটাকে পুরস্কার দিতেই হবে৷ ডিরেক্টর ম্যালকম ছিলেন আমাদের জুরি চেয়ারম্যান৷ তিনি বললেন, এই ছবি বার্লিন বেয়ারসহ অনেক পুরস্কার পাবে, তাই অন্যরকম একটা ছবি নির্বাচন করো, যেটা তৃতীয় বিশ্বের তরুণ কোনো প্রতিভাবান নির্মাতার, যার হয়তো প্রথম ছবি, তাকে প্রমোট করো৷ তখন আমরা জাপানের একটা ছবিকে অ্যাওয়ার্ড দেই৷ ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট, লাইটিং, অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, ছবি বানানোর উদ্দেশ্য – নানা বিষয় নিয়ে জুরিরা ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করে ঠিক করি কাকে দেয়া উচিত এবং কেন৷
বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ভিন্নতাটা কোথায়?
কান, বার্লিন, ভেনিস – এগুলোর একটা আলাদা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে৷ এদের জায়গা কেউ নিতে পারবে না৷ এছাড়া আছে টরন্টো ফেস্টিভ্যাল৷ বার্লিনালের বিশেষ সুনাম আছে ফোরামের জন্য৷ উলরিক গ্রেগর এর প্রতিষ্ঠাতা৷
বার্লিনালের প্যানারোমাতে ট্রান্সজেন্ডারদের উপর মুভিগুলো প্রাধান্য দেয়া হয়৷ তবে একেক ফেস্টিভ্যালে এর একেকটা ধরন থাকে৷ বার্লিনালেরও ভিন্নতা রয়েছে সেই জায়গায়৷ এটার কোনো বৈশ্বিক ফর্ম নাই৷ ঢাকা ফেস্টিভ্যালে যেমন আর্ট হাউস ফিল্মগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়৷
এবারের উৎসব কেমন দেখলেন?
আমি বার্লিনে এলে অবাক হয়ে যাই৷ কারণ, বাংলাদেশে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে তেমন লোক হয় না৷ বার্লিনে দর্শক দেখে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত৷ এত দর্শক দেখে আমি আনন্দিত যে, ফিল্মের জন্য এখনো মানুষ আছে৷ তারা ছবি দেখছে৷ অনেক বড় বড় ফেস্টিভ্যালে গিয়ে দেখেছি দর্শক নাই, অথচ বার্লিনে প্রচুর দর্শক, এটা বার্লিনের একটা সম্পদ৷
রথ দেখা, কলা বেচা
বার্লিনালেতে সিনেমা দেখার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু দেখার ও করার সুযোগ আছে৷ আছে সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা৷ এসব নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/A. Parvez
মেকআপ
বার্লিনালের পার্টনার লরেয়াল প্যারিস গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিনামূল্যে মেকআপের সুযোগ দিচ্ছে৷ তবে এজন্য আপনাকে আগে থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হবে৷
ছবি: DW/A. Parvez
বই কেনা
বার্লিনালের অন্যতম ভেন্যু হলো সিনেম্যাক্স৷ এর একেবারে নিচের তলায় যাওয়ার সিঁড়ির মাঝখানে ছোট্ট এই বইয়ের দোকান৷ সব সিনেমা নিয়ে৷ তবে বেশিরভাগই জার্মান বই৷
ছবি: DW/A. Parvez
খাওয়ার গাড়ি
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গত কয়েক বছর ধরে রন্ধন শিল্পের উপর নাকি ছবি রাখা হয় বিশেষ বিভাগে৷ তো সেটাকে কেন্দ্র করেই এই ভ্যান গাড়িগুলো৷ এখানে মেক্সিকান, জার্মানসহ কয়েক রকমের খাবার আছে৷ তবে দোকানগুলো খোলে সাড়ে ১১ টার পর৷ ছবিটা এর আগে তোলা৷
ছবি: DW/A. Parvez
শপিংমলে বার্লিনালে
মূল ভেন্যুর কাছেই একটা বেশ বড় শপিংমল৷ তার ভেতরে গেলে বার্লিনালে ছাড়া আর কিছুই আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না৷
ছবি: DW/A. Parvez
টিকেট
শপিংমলে যেহেতু মানুষ বেশি আসে, তাই এখানে সিনেমার সময়সূচি টাঙানো আছে, আর আছে টিকেট কেনার বুথ৷
ছবি: DW/A. Parvez
স্যুভেনির
বার্লিনালের অন্যতম আকর্ষণ হলো এই দোকান৷ বার্লিনালে লেখা বা ভাল্লুকের লোগো সম্বলিত বিভিন্ন জিনিস কিনতে পাওয়া যায় এখানে৷ দামটা একটু বেশি৷
ছবি: DW/A. Parvez
রেডকার্পেটের নীচে প্রেস লাউঞ্জ
বার্লিনালে পালাসটে রেডকার্পেট যেখানে হয়, তার নীচের তলায় প্রেস লাউঞ্জ৷ এখানে বসে সাংবাদিকরা বেশ আরামে কাজ করতে পারে৷ তবে এখানে নিজের ল্যাপটপ বা ফোন এনে কাজ করতে হবে৷
ছবি: DW/A. Parvez
গ্র্যান্ড হায়াৎ-এ লেখালেখির জায়গা
এই ঘরটা শুধু সাংবাদিকদের জন্য৷ এখানে কম্পিউটার আছে, যেখানে মোটামুটি সব দেশের ভাষায় লেখা যায়৷
ছবি: DW/A. Parvez
সিনেম্যাক্সের রেডিও কক্ষ
সিনেম্যাক্সের দ্বিতীয় তলায় এই রুমে বার্লিনালে চলাকালীন প্রতিদিন রাতে রেডিও আইনসএর অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হতো৷ উৎসবে অংশ নেয়া অতিথিরা সেখানে কথা বলতেন৷ এই ছবিটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পরপর হয়েছিল৷ সেখানে স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের তিন বিজয়ী কথা বলছেন৷
ছবি: DW/A. Parvez
9 ছবি1 | 9
বাংলাদেশে কি ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে? বর্তমান অবস্থাটা কী?
বাংলাদেশে এখন ২০-২৫ জন ফিল্ম মেকার আছে, যারা আগামী ৫-১০ বছর বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াবে৷ বাংলাদেশে সৌখিন ফিল্মমেকার ৫০ হাজার৷ এর মধ্যে ৫ হাজার প্রফেশনাল৷ এফডিসির অবস্থা খুব শোচনীয়৷ তাই ডিজিটালি যারা ছবি নির্মাণ করছে, তারা বেশ ভালোভাবেই করছে৷ ঢাকায় প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম নিয়ে বিভাগ হয়েছে, যেখানে এ বিষয়ে পড়ানো হয়৷ আমি মনে করি, বাংলাদেশে ফিল্মের ভবিষ্যৎ খুবই ভালো৷
বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
বাংলাদেশে তরুণদের জন্য পরামর্শ হলো, সৎ ও ভালো ভালো ছবি বানান, কোনো জালিয়াতি না করে সোজা রাস্তায় হাঁটলে কেউ আপনাকে আটকে রাখতে পারবে না, বিশ্ব আপনাকে চিনবে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, একটা ছবি ভালো হলে নির্মাতাদের এত অহংকার হয় যে, এরপরের ছবিগুলো ভালো হয় না৷ ঢাকায় অন্তত ১০ জন নির্মাতা আছেন, যাঁরা বলেন, তাঁদের চেয়ে ভালো নির্মাতা এদেশে নেই৷ যারা ভালো ছবি বানাতে চায়, তাদের জন্য পৃথিবী খোলা আছে৷
(আহমেদ মুজতবা জামাল, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির প্রধান৷ এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক ১৯৯৪ সাল থেকে ফিপ্রেস্কির সঙ্গে যুক্ত৷ এ পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিশ্বখ্যাত প্রায় ২৫টি উৎসবে৷)