জার্মানিতে অভিবাসীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ বিশেষ করে নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের কোলন, ড্যুসেলডর্ফ, ডর্টমুন্ড, হাম এবং ডুইসবুর্গের মতো বড় শহরগুলোতে৷ ঘুরতে বেরোলেই সেটা আজকাল সবার চোখে পড়ে৷
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ ইউরোপের রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, একথা বলেন রাজ্যটির শ্রম, সমাজকল্যাণ ও ইন্টিগ্রেশন বিষয়ক মন্ত্রী গুন্টরাম শ্নাইডার৷ তাঁর মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে এই দুই দেশ থেকে নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যে এসেছেন প্রায় ১২ হাজার অভিবাসী৷ এছাড়া, আগে থেকেই ঐ দুই দেশের প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি নাগরিক বাস করছেন এই রাজ্যে৷
অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই যেমন দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে নিজের দেশ ছেড়েছেন, তেমনই এঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু শিক্ষিত, যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ, যেমন ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ বা সেবক-সেবিকা, বলেন শ্নাইডার৷ তাঁর মন্ত্রণালয়ে যে হিসেব রয়েছে তাতে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে থেকে আসা প্রায় ১৩,৫০০ অভিবাসী চাকরি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
বিদেশিদের সমন্বয়সাধনকারী এই মন্ত্রী আরো জানান, বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া থেকে আসা এই সব মানুষের নিজের দেশে আর্থিক অবস্থা যে খুব খারাপ ছিল শুধু তাই নয়, তাঁদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান নেই এমন মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়৷ ফলে বর্তমানে জার্মানির শ্রম বাজারে তাঁদের তেমন চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷ বড় শহরগুলোর অভিবাসীদের জন্য চাকরি বা জার্মান সমাজে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়া বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ এবং এক্ষেত্রে, অর্থাৎ চাকরি পাওয়ার জন্য ভাষা শেখা অত্যন্ত জরুরি৷ তাই এসব অভিবাসীর জন্য রাজ্য সরকার আরো বেশি অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত৷ যেমন, ২০১৪ সালে শুধুমাত্র ডুইসবুর্গ শহরের অভিবাসীদের কল্যাণেই রাজ্য সরকার প্রায় ১২ মিলিয়ন ইউরো অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেছে বলে জানা গেছে৷
তাছাড়া, ডুইসবুর্গ শহরে অভিবাসীদের বাসস্থান নিয়েও রয়েছে বড় সমস্যা৷ বিশেষ করে গত কয়েক মাসে অনেকগুলো পরিবার একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে একসাথে থাকায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যা নিয়মিত পত্র-পত্রিকাগুলিতেও উঠে এসেছে৷ তাই অভিবাসীদের ঐ ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে অন্যান্য ছোট ছোট বাড়িতে পাঠানোর কাজ চলছে৷
ডুইসবুর্গ শহরের মতো নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে বসবাসকারী অভিবাসীদের নানা সুযোগ-সুবিধার দেওয়ার জন্য লাখ লাখ ইউরো দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে৷ অভিবাসীদের জন্য সামাজিক সুবিধা এবং ভাষাশিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ৭.৫ মিলিয়ন ইউরো দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ বলা বাহুল্য, বিদেশিদের জন্য জার্মানিতে চাকরি এবং সমাজে মিলেমিশে সুন্দরভাবে চলার জন্য জার্মান ভাষা জানার কোনো বিকল্প নেই৷