মহাকাশ গবেষণায় ইউরোপ কী দিতে পারে? এশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উদ্ভাবন রয়েছে৷ যেমন, স্পেস এক্স-এর পুনর্ব্যবহারোপযোগী রকেট৷ স্পেনের এক নবীন স্টার্টআপ মহাকাশে পৌঁছানোর বিকল্প পথ নিয়ে কাজ করছে৷
কম খরচে মহাকাশযাত্রার লক্ষ্যে গবেষণা চালাচ্ছে স্পেনের পিএলডি স্পেসছবি: PLD Space
বিজ্ঞাপন
পর্দায় প্রচণ্ড ধোঁয়া আর উত্তেজনা এবং উচ্ছ্বাসে ভরা এক কাণ্ড! সব কৃতিত্ব কলেজ জীবনের দুই বন্ধুর৷ বছরখানেক আগে তাদের স্টার্টআপ পিএলডি স্পেস বেশ সাড়া জাগিয়েছিল৷ তাদের ছোট্ট রকেটের সফল উৎক্ষেপণ ইউরোপের বেসরকারি মহাকাশ খাতে এক নতুন মাইলফলক৷
পিএলডি স্পেসের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাউল ভের্দু এই বিষয়ে বলেন, ‘‘অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা৷ আমরা বিশ্বকে দেখিয়েছি যে, আমরা এমন কিছু করতে পারি যা তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব৷''
বেসরকারি মহাকাশ গবেষণার কেন্দ্র হচ্ছে আলিকান্তের কাছের এলছে৷ এই এলাকাটি মহাকাশ গবেষণার চেয়েও বেশি পরিচিত পাম ট্রির জন্য৷ সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতারা কলেজ জীবনের বন্ধু৷ রাউল ভের্দু বলেন, ‘‘আমরা স্পেস গিক ছিলাম৷ আমরা কলেজে মডেল রকেট বানাতে বানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্পেস এক্স এবং ব্লু অরিজিনের মতো প্রতিষ্ঠানের উত্থান দেখছিলাম৷''
রকেট ডিজাইনের লম্বা পথ
প্রকৃত রকেটের ডিজাইন করা অনেক লম্বা এবং বন্ধুর পথ৷ প্রতিষ্ঠাতারা প্রাথমিক তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন তাদের বন্ধু, প্রতিবেশী এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে৷ বেসরকারি এবং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকারীরা শুরুতে তাদের সহায়তা করেনি৷
পিএলডি স্পেসের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা রাউল ত্যরেস বলেন, ‘‘তারা বলেছিল এটা সম্ভব নয় কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা নেই৷ তাছাড়া এটা অনেক ব্যয়বহুল এবং জটিল৷ অন্যরা চেষ্টা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে৷ কিন্তু আমরা ঝুঁকি নিয়েছি৷''
তাদের অদম্য আগ্রহ এক পর্যায়ে বড় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে৷ ফলে প্রতিষ্ঠাতারা নিজেদের যন্ত্র তৈরির জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহে সক্ষম হন৷ কিন্তু চার বছর আগে পরীক্ষার সময় এটিতে বিস্ফোরণ ঘটে৷
রাউল ভের্দু বলেন, ‘‘এটা আসলেই আমাদের আস্থা এবং বিশ্বাস্যতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে কর্মী ছাঁটাই করি৷ যেকোনো উদ্যোক্তার জন্য বিষয়টি খুব কষ্টের৷''
ইয়োহানেস কেপলার: আধুনিক মহাকাশ গবেষণার পথপ্রদর্শক
গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়োহানেস কেপলারের জন্ম সাড়ে চারশো বছর আগে৷ বলা হয়ে থাকে, আধুনিক মহাকাশ গবেষণার ভিত রচিত হয়েছে তার হাত ধরে৷ কেপলার সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে ছবিঘরে....
ছবি: Fine Art Images/Heritage Images/picture alliance
ভুর্টেমব্যার্গ থেকে মহাকাশে
ইয়োহানেস কেপলার ১৫৭১ সালে জার্মানির ভুর্টেমব্যার্গের ভাইল ডেয়ার স্টাটে জন্মগ্রহণ করেন৷ দ্রারিদ্র্য আর অসুস্থতায় কেটেছে তার শৈশব৷ কিন্তু স্কুলজীবন থেকেই তিনি পড়াশোনায় মনযোগী ছিলেন৷ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে জায়গা ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ট্যুবিঙেনে৷ সেখানেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাসের কাজ নিয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি৷ কয়েকশো বছর পর কেপলারের নিজের নামেই হয়েছে গ্রহ আর মহাকাশযানের নামকরণ৷
ছবি: NASA/JPL
পথপ্রদর্শক
তিনি একাধারে একজন গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষি৷ ১৭ শতকে ইউরোপ বিজ্ঞান চর্চার বিপ্লবে তার ভূমিকা অসামান্য৷ গ্রহীয় গতিসূত্রের জন্য বিখ্যাত এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী তার কাজ দিয়ে ভবিষ্যৎ জ্ঞান চর্চার পথ উন্মোচন করেন৷ তার আবিষ্কারের উপর দাঁড়িয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম পুরোধা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রও৷
ছবি: Pictures From History/CPA Media/picture alliance
মায়ের গ্রেপ্তার
কেপলার এমন এক সময় জন্ম নেন যখন তার চারপাশের সমাজ নানা সংঘাত, রোগ আর জাদুবিশ্বাসে জর্জরিত ছিল৷ ১৬২০ সালের আগস্টে তার মা কাথেরিনা গুল্ডেনমানকে জাদুচর্চার অভিযোগে গেপ্তার করা হয়৷ পরে আইনজীবীদের সাথে কেপলার নিজেও যুক্তি উপস্থাপন করে তার মাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সমর্থ হন৷ ১৬২১ সালের অক্টোবরে তিনি মুক্ত হন৷
ছবি: Mary Evans Picture Library/picture-alliance
গ্রহের গতি
গ্রহের গতির তিনটি সূত্র দেন ইয়োহানেস কেপলার৷ মহাবিশ্ব ও মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে নতুন চিন্তার খোরাক তুলে দেন তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে৷ তার উপর ভিত্তি করেই ১৬৮৪-৮৫ সালে মহাকর্ষ তত্ত্ব দেন বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন৷
ছবি: Knut Niehus/chromorange/picture alliance
কেপলার মহাকাশযান
কেপলারের অন্যতম সৃষ্টি ‘অ্যাস্ট্রোনোমিয়া নোভা’ গ্রন্থের চারশো বছর পূর্তি হয় ২০০৯ সালে৷ সে বছর ইউরোপীয়ন স্পেইস এজেন্সি মহাকাশের একটি স্বয়ংক্রিয় স্থানান্তর যানের নামকরণ করেন তার নামে (এটিভি-২ ইয়োহানেস কেপলার)৷ আধুনিক যুগের মহাকাশ গবেষণার পথ প্রদর্শক হিসেবে কেপলারের প্রতি এই সম্মাননা জানান তারা৷
ছবি: ESA/D.Ducros/picture alliance/dpa
কেপলার-১৬৪৯৬
১৬৩০ সালে নভেম্বরে জ্বর আক্রান্ত হন এই বিজ্ঞানী৷ সে বছরের ১৫ নভেম্বর ৫৯ বছর বয়সে বর্তমান জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের রেগেন্সবুর্গে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ রোমান শাসনামলে ৩০ বছরব্যাপী চলা যুদ্ধে তার সমাধিটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ তবে মহাজাগতিক গবেষণা আর মহাবিশ্বে নতনু গ্রহের সন্ধানে তিনি আজো পথ প্রদর্শক হয়ে আছেন৷ পৃথিবী থেকে ৩০১ আলোকবর্ষ দূরে কেপলার-১৬৪৯৬ (ছবিতে) তেমনই একটি৷
ছবি: NASA/UPI Photo/Newscom/picture alliance
6 ছবি1 | 6
নিরলস চেষ্টা
দলটি অবশ্য আশা ছাড়েনি৷ পরের পরীক্ষা নিখুঁত হওয়া অবধি চেষ্টা চালিয়ে গেছে৷ ফলে তাদের সন্তুষ্টি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷
আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ায় তারা আরো বড় কিছু করতে উদ্যোগী হয়েছেন৷ বর্তমানে তারা মিউরা ৫ নিয়ে ব্যস্ত - এটি এমন এক রকেট যা ৬০০ কেজি অবধি পণ্য পরিবহণে সক্ষম হবে৷ এক বছরের মধ্যে এই রকেট তৈরি সম্পন্ন করতে চায় আড়াইশ কর্মীর দলটি৷ পিএলডি স্পেসের সহপ্রতিষ্ঠাতার দাবি তারা এক্ষেত্রে ইউরোপের নেতা৷
রাউল ভের্দু বলেন, ‘‘আমরা আমাদের শিল্পে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সেবা প্রদান করি৷ অন্যভাবে বললে আমরা আমাদের শিল্পের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান৷ কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই প্রথম লঞ্চটিতে আমরা সর্বাধুনিক এবং নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি৷''
এবং তাদের উচ্চাকাঙ্খা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি৷ আগামী বছরগুলোতে পিএলডি স্পেস আরো ভারী যান কক্ষপথে পাঠাতে চায়৷ ২০২৮ সাল নাগাদ তাদের রকেট আর পানিতে নয় বরং স্পেস এক্সের মতো উলম্বভাবে মাটিতে অবতরণ করবে৷ আর তাতে তাদের ব্যবসা আরো লাভবান হবে৷ এমনকি তারা মহাকাশচারীদেরকেও মহাকাশে পাঠাতে চান৷ লিন্স প্রকল্পের আওতায় পাঁচজনকে বহনে সক্ষম রকেট তৈরি করা হচ্ছে৷
পিএলডি স্পেসের রাউল ভের্দুর কথায়, ‘‘আমাদের পরিকল্পনা শুনতে পাগলাটে মনে হবে পারে কিন্তু এগুলোতে ঝুঁকি কম৷ কারণ, আমরা ধাপে ধাপে আগাচ্ছি৷ মিউরা ১ থেকে মিউরা নেক্সট এবং পরর্বতী ধাপ৷ চূড়ান্ত অধ্যায় হবে ক্রুসহ লঞ্চ৷ কিন্তু এটা কালকেই নয়, দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে হবে৷ বিষয়টি শুধুমাত্র কোনো নিজস্ব ভাবনা নয়, বরং বাজারের চাহিদার জবাব৷''
এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পিএলডি স্পেসের কাজ দেখাতে হবে৷ ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ মিউরা ৫ লঞ্চ করতে চায় তারা৷ এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার চেষ্টার করার মতো তহবিল তাদের আছে৷ তবে সফল হলে ৬০০ মিলিয়ন ইউরোর ব্যবসা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷
বেজোস, ব্র্যানসন, মাস্ক: মহাকাশে কে জিতছেন?
অ্যামাজনের জেফ বেজোস, ভার্জিনের রিচার্ড ব্র্যানসন ও টেসলার ইলন মাস্ক মহাকাশে পর্যটন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন৷ এ লক্ষ্যে তারা কতদূর এগোলেন তা জানা যাবে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Virgin Galactic
নিউ শেপার্ড
এটি অ্যামাজনের জেফ বেজোসের ‘ব্লু অরিজিন’ কোম্পানির বাহন ‘নিউ শেপার্ড’৷ এতে করে আগামী ২০ জুলাই অরবিটে ঘুরে আসবেন বেজোস, তার ভাই মার্ক ও আরেকজন৷ অনলাইনে নিলামের মাধ্যমে টিকিট পেয়েছেন ঐ ব্যক্তি, যার নাম এখনও প্রকাশ করা হয়নি৷ টিকিটের দাম পড়েছে ২৩৮ কোটি টাকার কিছু বেশি৷ একটি রকেট নিউ শেপার্ডকে উপরে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবে৷ এরপর নিউ শেপার্ড ক্যাপসুলটি প্যারাসুটের সহায়তায় পৃথিবীতে ফিরে আসবে৷
ছবি: Isaiah J. Downing/REUTERS
টিকিটের দাম
২০১৮ সালে রয়টার্স জানিয়েছিল নিউ শেপার্ডে উঠতে একজনকে কমপক্ষে এক কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ করতে হবে৷ রকেট থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নিউ শেপার্ড প্রায় ১০ মিনিট অরবিটে থাকবে৷ এসময় যাত্রীরা ওজনহীন অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন৷ নিউ শেপার্ডে ছয়জন যাত্রী যেতে পারবেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/Blue Origin/AP
ভিএসএস ইউনিটি
এটি রিচার্ড ব্রেনসনের ভার্জিন গ্যালাকটিকোর মহাকাশে যাওয়ার প্লেন৷ ভিএমএস ইভ নামের একটি বড় ক্যারিয়ার এয়ারক্রাফটে করে ভিএসএস ইউনিটিকে উপরে নিয়ে যাওয়া হবে৷ ভিএসএস ইউনিটি স্পেস প্লেনে ছয়জন বসতে পারবেন৷ এর মধ্যে দুজন ক্রু, বাকিরা যাত্রী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Virgin Galactic
টিকিটের দাম
ভার্জিন গ্যালাকটিক ইতিমধ্যে ৬০০-র বেশি টিকিট বিক্রির আবেদন পেয়েছে৷ প্রতিটির দাম প্রায় দুই কোটি সাড়ে ১২ লাখ টাকা৷ ২০২২ সালে তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে৷ ওড়া শুরু থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা পর্যন্ত সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা৷ এর মধ্যে কিছুক্ষণ ওজনহীন অবস্থার স্বাদ পাবেন যাত্রীরা৷ টিকিটের দাম ক্রমান্বয়ে ৩৪ লাখ টাকায় কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে ভার্জিন৷
ছবি: AFP/VIRGIN GALACTIC
স্পেসএক্স ড্রাগন
এটি টেসলার ইলন মাস্কের মহাকাশ যান৷ ইতিমধ্যে নাসার নভচারীরা এটিতে চড়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস-এ গেছেন৷ তবে এই সেপ্টেম্বরে ড্রাগনে চড়ে চার ব্যক্তির মহাকাশে যাওয়ার কথা রয়েছে যাদের কেউ পেশাদার নভচারী নন৷ তারা মহাকাশে তিনদিন থাকবেন৷ আইএসএস-এর চেয়ে বেশি উঁচুতে তারা যাবেন বলে জানা গেছে৷ বিলিওনেয়ার উদ্যোক্তা ও জেট পাইলট জারেড আইজ্যাকম্যান এই চারজনের টিকিট কেটেছেন৷
ছবি: NASA/AP Photo/picture alliance
চাঁদের কাছাকাছি
স্পেসএক্স ড্রাগনে সর্বোচ্চ সাতজন বসতে পারবেন৷ স্পেসএক্সের একেকটি মিশন তিন থেকে চারদিনের হতে পারে৷ ইলন মাস্ক সম্প্রতি জানিয়েছেন, তারা স্টারশিপ নামে একটি রকেটের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছেন যেটিত করে ২০২৩ সালে জাপানি বিলিওনেয়ার ইয়ুসাকু মেজাওয়াকে চাঁদের কাছাকাছি ঘুরিয়ে আনা হবে৷