সেই চিংড়ি যদি আবার অরগ্যানিক হয়, অর্থাৎ রাসায়নিক কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই চাষ করা হয়ে থাকে, তাহলে পশ্চিমে তার চাহিদা হবে যেমন, দামও হবে তার তিনগুণ বেশি৷
বিজ্ঞাপন
চিংড়ি চাষি তান বিয়েত হো ভালো করেই জানেন যে, সন্ধ্যার দিকে আরো বেশি চিংড়ি জালে ওঠে৷ ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা চিংড়িগুলো কিলবিল করছে৷ চিংড়িগুলো কোনোরকম রাসায়নিক কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই বড় হয়৷ অন্যান্য চাষিরা যেমনটা করে থাকেন, হো তেমন করেন না বলে তিনি তাঁর চিংড়িগুলোকে অরগ্যানিক চিংড়ি বলতে পারেন৷
হো জানালেন, ‘‘একটি বড় চিংড়ির কারখানার সঙ্গে আমার চুক্তি আছে: তারাই আমার অরগ্যানিক চিংড়িগুলো কিনে নেবে৷ কারখানার দালালরা এসে আমার ভেড়ি দেখে যাবেন৷ তাঁরা পরিদর্শন করার পর আমি সরাসরি আমার চিংড়ি তাদের বিক্রি করতে পারব৷ এখন যা পাই, তার চেয়ে দশ শতাংশ বেশি দাম পাবো৷''
গত ২৫ বছর ধরে চিংড়ির চাষ করে তান ভিয়েত হো সংসার চালাচ্ছেন৷ হো-র চার সন্তান, নাতিনাতনি তেরোটি৷ রোজ রাতে সকলে একসঙ্গে খেতে বসেন৷ পরদিন ভোরবেলা হো আবার পরখ করে দেখছেন: জালে ৯ কিলো চিংড়ি উঠেছে! দারুণ৷ হো বললেন, ‘‘আমি এত মাছ ওঠায় খুব খুশি৷ এ রকম মাছ উঠতে থাকলে আমি কোনো না কোনো দিন একটা নতুন বাড়ি বানাতে পারব, আমার নাতি-নাতনিদের পড়াশোনার খরচ দিতে পারব৷''
সুন্দরী বন সুন্দরবন
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ বাংলাদেশ ও ভারতজুড়ে বিস্তৃত এ বনের মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিশ্ব ঐতিহ্য
বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬০১৭ কিলোমিটার৷ আয়তনের প্রায় ৭০ ভাগ স্থল আর ৩০ ভাগ জল৷ পুরো সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো অসংখ্য নদী আর খাল রয়েছে৷ জীববৈচিত্রে ভরপুর সুন্দরবনকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখির বসবাস এই বনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
বাঘের পায়ের ছাপ
সুন্দরবনের কটকা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য৷ সেখানেই দেখা মেলে বেঙ্গল টাইগারের পায়ের ছাপ৷ এ বনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ডোরাকাটা বাঘ৷ জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের অভাব আর চোরা শিকারসহ নানা কারণে দিন দিন এখানে কমে আসছে বাঘের সংখ্যা৷ বন বিভাগের মতে, সুন্দরবনে বর্তমানের বাঘের আনুমানিক সংখ্যা ৫০০৷ ২০০৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাঘশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা ছিল ৪৪০৷
ছবি: DW/M, Mamun
অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রা হরিণ
সুন্দরবনের কটকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চিত্রা হরিণ৷ সুন্দরবনের সর্বত্রই এ প্রাণীটির দেখা মেলে৷ চিত্রা আর মায়া – এ দুই ধরণের হরিণ আছে সুন্দরবনে৷ তবে সবচেয়ে বেশি আছে চিত্রা হরিণ৷ ৩০ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণের বসবাস সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
যার নামে সুন্দরবন
সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছই চির সবুজ ম্যানগ্রোভ শ্রেণির৷ এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী৷ এ গাছের নামেই বনের নামকরণ৷ এছাড়া এই বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছেস যার মধ্যে ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ৮৭টি একবীজপত্রী ও ২৩০ প্রজাতি দ্বিবীজপত্রী৷ সারা পৃথিবীজুড়ে যে ৫০ প্রজাতির প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় বাংলাদেশের সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ
প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসেন সুন্দরবন ভ্রমণে৷ ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ লাখ ২০ হাজার ৪১৪ জন পর্যটক বেড়াতে এসেছেন এখানে, যাঁদের মধ্যে বিদেশি পর্যটক ৩ হাজার ৮৫৪ জন৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিচিত্র সাপ
শরণখোলা রেঞ্জের একটি জঙ্গলে গ্রিন ক্যাট স্নেক বা সবুজ ফনিমনসা সাপ৷ কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ ছাড়াও সুন্দরবনে দেখা যায় কিং কোবরা বা রাজগোখরা, রাসেলস ভাইপার, পিট ভাইপার, পাইথন, ব্যান্ডেড ক্রেইড ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M, Mamun
কুমির দর্শন
জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ – সুন্দরন নিয়ে এরকম প্রবাদ বহুকালের৷ সুন্দরবনের হারবাড়িয়া এলাকার একটি খালে লোনা জলের এই কুমিরটিকে দেখা গিয়েছিল৷ সুন্দরবনের মহা বিপন্ন এ প্রাণীটি আকারে সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়৷ লোনা পানির কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছরের মতো৷
ছবি: DW/M, Mamun
হরিণের বন্ধু
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে তোলা বানরের ছবি৷ সুন্দরবনে চিত্রা হরিণের পর সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ প্রাণীটি৷ সুন্দরবনে বানরকে হরিণের সুহৃদ বলা হয়৷ গাছের ডাল ভেঙ্গে হরিণকে পাতা খেতে বানর সহায়তা করে থাকে৷ এছাড়া বাঘের আগমনের খবরটিও সবার আগে হরিণকে দেয় বানর৷
ছবি: DW/M, Mamun
জঙ্গল উপভোগ
সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যের ছোট খালে ঘুরে জঙ্গল উপভোগ করছেন পর্যটকরা৷ সকাল এবং বিকেলে এসব খালে বেড়ানোর সময় অনেক বন্য প্রাণীর দেখা মেলে৷
ছবি: DW/M, Mamun
ভ্রমণতরী
সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে একটি বেসরকারি সংস্থার ভ্রমণতরী৷ সুন্দরবন দেখতে আসা বিদেশি পর্যটকদের বেশির ভাগই আসেন বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থাগুলোর সহায়তায়৷ এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগেরও অভাব অনেক৷
ছবি: DW/M, Mamun
পণ্যবাহী জাহাজের কারণে ডলফিনের মৃত্যু
সুন্দরবনের ভেতরে জঙ্গল ঘেঁষে চলাচল করছে বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ৷ এ সব জাহাজের উচ্চ শব্দ যেমন বন্যপ্রাণীদের বিরক্তির কারণ হয়, তেমনি এসব জাহাজের সৃষ্ট ঢেউ ভাঙন ধরায় সুন্দরবনে৷ এ সব জাহাজের প্রোপেলারের আঘাতে প্রায়ই ডলফিনেরও মৃত্যু ঘটে৷
ছবি: DW/M, Mamun
অপরূপ সূর্যাস্ত
সুন্দরবনের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে সূর্যাস্তের ছবি তুলছেন এক পর্যটক৷
ছবি: DW/M, Mamun
রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই এগিয়ে চলছে রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ৷ এতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হয় বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও মানব বসতির ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় না৷ অথচ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের সংরক্ষিত ও স্পর্শকাতর স্থানের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার৷
ছবি: DW/M, Mamun
13 ছবি1 | 13
কিলো প্রতি বাগদা চিংড়ির দাম পাওয়া যায় প্রায় দশ ইউরো৷ সে সব চলে যায় প্রধানত ইউরোপ বা অ্যামেরিকায়৷ সেখানেও অরগ্যানিক খাবার-দাবারের দাম বাড়ছে৷ ইউরোপের বাজারে এক কিলো অরগ্যানিক চিংড়ি বিক্রি হয় ৩০ ইউরো মূল্যে৷
ম্যানগ্রোভ ও চিংড়ি চাষ
প্রতিবেশী এক চিংড়ি চাষির ভেড়িতে ঠেসমূল বা শ্বাসমূল ম্যানগ্রোভ বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে৷ অতীতে বহু মাছচাষি তাদের ভেড়ি থেকে গাছপালা তুলে ফেলেছিলেন৷ এখন ঠিক তার উলটো প্রচেষ্টা চলেছে৷ চা মাউ প্রদেশের বনবিভাগের কর্মকর্তা মান মিন তা জানালেন, ‘‘ম্যানগ্রোভের সঙ্গে ভেড়িতে মাছচাষ, বিশেষ করে চিংড়িচাষের একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে৷ সামুদ্রিক প্রাণিদের থাকা-খাওয়া ও প্রজননের জন্য ঠেসমূল অরণ্য একটা সুযোগ্য পরিবেশ৷ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট গরমকালে জলের তাপমাত্রা কম রাখতে সাহায্য করে৷''
ম্যানগ্রোভ দিয়ে ভিয়েতনামের উপকূল রক্ষার চেষ্টা চলেছে৷ থুই থি বিচ নুইয়েন চিংড়ি চাষিদের ম্যানগ্রোভ প্রকল্পের প্রধান৷ তিনি বললেন, ‘‘এই অঞ্চলে একটানা উপকূলের ক্ষয় চলেছে৷ ১৯৯৩ সাল যাবৎ আমরা ৭০০ মিটার উপকূলভূমি হারিয়েছি, অর্থাৎ বছরে ৩০ মিটার করে৷''