1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভুয়ো সিম দিয়ে হাজার কোটির প্রতারণা

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভুয়ো সিমে ছড়াচ্ছে প্রতারণার জাল। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে ফাঁদ পেতে মানুষকে ঠকাচ্ছে প্রতারকরা। ডিজিটাল অ্যারেস্ট থেকে সেক্সটরশন, বাদ নেই কিছুই।

বিভিন্ন কার্ডের মাধ্যমে প্রতারণা
অনলাইন প্রতারণা চক্র ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গেছবি: Pramod Deithe/Hindustan Times/Getty Images

বিভিন্ন মোবাইল সংস্থা যে সিম কার্ড বাজারে বার করে, সেগুলি ভুয়ো নথি দিয়ে  তুলে নিচ্ছে প্রতারকরা। সেই সিম কাজে লাগিয়ে চলছে অবৈধ কারবার। যার নামে সিম, তিনি কিছুই জানতেও পারছেন না।

নেতাকে হুমকি ফোন

গত সপ্তাহে মালদার ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীকে 'ডি কোম্পানি' পরিচয় দিয়ে ফোন করে এক দুষ্কৃতীরা। ২০ লাখ টাকা চাওয়া হয় তৃণমূলের এই নেতার কাছ থেকে, যিনি অতীতে রাজ্যের মন্ত্রীও ছিলেন। এই ঘটনার পুলিশি তদন্তে একাধিক সন্দেহভাজনের কথা উঠে আসে।

এর মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য, যে সিম ব্যবহার করে কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করা হয়েছিল, সেটি ছিল কলকাতার কোনো বাসিন্দার নামে। অথচ সেই সিম বিক্রি করে  মালদার কালিয়াচক থানা এলাকার এক ব্যবসায়ী। কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে টাকা চেয়েছিল শাহাদাত শেখ। তাকে সিম দিয়েছিল ওয়াসিম আক্রম নামে সুজাপুরের ব্যবসায়ী। দুজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

এই ইংরেজবাজার ব্লকের মহদিপুরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সীমান্ত  এই সীমান্তবর্তী এলাকায় ওপারের সিম ব্যবহার করেও অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

উত্তর থেকে দক্ষিণ

ভুয়ো নথি দিয়ে সিমকার্ড অ্যাক্টিভেট করার পরে সেগুলি চড়া দামে সাইবার অপরাধীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে ৬৮১টি ভুয়া সিম অ্যাক্টিভেট করা হয়েছে। এই দুষ্কর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা পুলিশ তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে কোচবিহার থেকে।

তদন্তে উঠে এসেছে, বিভিন্ন পয়েন্ট অফ সেলস থেকে এই সিম অ্যাক্টিভেট  করে প্রতিটি তিন হাজার টাকায় সাইবার অপরাধীদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এই জেলারও একটা বড় অংশ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। এই সুযোগে চক্রের সঙ্গে জড়িতরা সহজেই গা ঢাকা দিচ্ছে ওপারে।

সম্প্রতি একই ঘটনা সামনে এসেছে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায়। সেখানকার পুলিশ সিট গঠন করে সিম জালিয়াতির তদন্ত চালাচ্ছে। এই ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা একটা বড় চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকে। সেই চক্রের হাত ছড়িয়ে রয়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে।

অনলাইন প্রতারণা এড়াতে সুরক্ষার সন্ধান

04:03

This browser does not support the video element.

সোমবার রাতে কেষ্টপুর থেকে দু'জনকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ। ধৃতরা অনির্বাণ সাহা এবং তার স্ত্রী দেবলীনা চক্রবর্তী। বেলেঘাটা থেকে রিপন সাহা ও শোভন দেবনাথকে ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয়। এই দু'জনের কাছ থেকে আটটি মোবাইল ফোন, ২৩৭টি সিম কার্ড, পাঁচটি বায়োমেট্রিক মেশিন উদ্ধার করা হয়। এদের জেরা করে আরো চারজনকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ধৃতেরা হলো সজল মন্ডল, রাজেশ মাহাতো, মোহাম্মদ রেজা, অরিজিৎ রায়।

কলকাতা পুলিশের জয়েন্ট সিপি ক্রাইম রূপেশ কুমার বলেন, "কলকাতায় সিমকার্ডচক্রের আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক সিম কার্ড, বায়োমেট্রিক মেশিন ও মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।"

তার কথায়, "সাধারণ মানুষের নামে সিমকার্ড ইস্যু করা হচ্ছে এবং সেগুলি সাইবার জালিয়াতদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নানা রকম জালিয়াতি হচ্ছে এর মাধ্যমে। ইনভেস্টমেন্ট বা লোন ফ্রড, ডিজিটাল অ্যারেস্ট ইত্যাদি। এ সব কিছুই সেই সমস্ত সিম কার্ডকে ব্যবহার করে হচ্ছে।"

রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে

সাইবার অপরাধ এখন কেবল ব্যাঙ্কিং লেনদেন বা সেই ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। ডিজিটাল অ্যারেস্ট বা সেক্সটরশনের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগটুকু জানাতে দ্বিধা করছেন।

এই সাইবার প্রতারণার চক্র ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। এই ধরনের অপরাধের ঘাঁটি হিসেবে আগে চিহ্নিত ছিল বিহারের জামতাড়া। এখন সাইবার অপরাধীদের সদর দপ্তর হয়ে উঠেছে রাজস্থান। পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যের ভরতপুর, আলওয়ার, নুহ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রতারণা পরিচালিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই-সহ বিভিন্ন জায়গার পুলিশ বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে। তাদের তদন্তে উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গে সক্রিয় থাকা সিম চক্রের কথা। পুলিশি অভিযানে সাইবার অপরাধীদের হেফাজত থেকে হাজার পাঁচেক সিম উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে দেড় হাজার সিম পশ্চিমবঙ্গের।

হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশ সীমানায় চলেছে বিশেষ অভিযান। যে সিম এই অভিযানে প্রি-অ্যাক্টিভেটেড অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি কিভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এত দূরের রাজ্যে যাচ্ছে? তদন্তকারীদের দাবি, মূলত পণ্যবাহী ট্রাক চালকদের হাত দিয়ে পাচার করা হচ্ছে সিম।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট জালিয়াতি করার একটা রাস্তা হচ্ছে আধার কার্ড: পল্লবকুমার ঘোষ

This browser does not support the audio element.

কোন কৌশলে সিম নকল

এই জালিয়াতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারো আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে সিম সংগ্রহ করা। কীভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে?

ফিঙ্গারপ্রিন্ট ক্লোন করে সিমকার্ড তোলা হচ্ছে। সেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে একাধিক সিম কার্ড তোলা হয়। বিদেশের কল সেন্টারেও এই সিম কার্ড বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সূত্রের খবর, ঝুপড়ি এলাকা থেকে এই ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো নেওয়া হয়। টেকনিক্যাল কারণে সিম কার্ড ইস্যু হয়নি বলে দেওয়া হয় সেখানকার বাসিন্দাদের। সিম না নিয়ে তারা চলে যান। অথচ সিমকার্ড তৈরি হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কপি করার জন্য আঠা দেওয়া হয়। এই আঠাতে আঙুলের ছাপ মজুত রয়ে যায়।

কীভাবে সিম কেনার সময় সতর্ক থাকতে হবে, সে উপায় বাতলাচ্ছেন পুলিশ কর্তা থেকে সাইবার বিশেষজ্ঞরা।

জলপাইগুড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৌভনিক মুখোপাধ্যায় বলেন, "বায়োমেট্রিক দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে দু'বার করে ছাপ না দিতে হয়। দোকানদার যে মোবাইল দেখে আপনাকে বলছেন যে বায়োমেট্রিক হয়নি, সেটা আপনার দেখে নেওয়া দরকার। তাতে যদি দেখেন যে সত্যি হয়নি, তবেই দেবেন, নইলে নয়।"

এখন কলকাতার অনেক জনবহুল জায়গায়, স্টেশনের কাছে, কিছু খুচরো ব্যবসায়ী পথের ধারে টেবিল পেতে বসে সিম বিক্রি করেন। এ ব্যাপারে পুলিশ কর্তার সতর্কবার্তা, "রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখান থেকে সিম নেওয়া এড়িয়ে চলুন। স্থানীয় বিশ্বাসযোগ্য দোকান অথবা ডিস্ট্রিবিউটরের বড় দোকান থেকেই সিম কিনুন। নিজের ডকুমেন্ট কোথাও দিতে গেলে স্বাক্ষর করুন ও তারিখ লিখুন এমনভাবে যাতে ডকুমেন্টের উপর স্বাক্ষর দেখা যায়। সেই ডকুমেন্ট যাতে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না হয়, সেটা আপনাকেই নিশ্চিত করতে হবে।"

আঙুলের ছাপের সঙ্গে আধার কার্ড নিয়েও সচেতন থাকতে হবে। রাজ্য পুলিশের সাবেক আইজি পল্লবকুমার ঘোষ বলেন, "ফিঙ্গারপ্রিন্ট জালিয়াতি করার একটা রাস্তা হচ্ছে আধার কার্ড। আধার নম্বর জোগাড় করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট জালিয়াতি করা সম্ভব। তাই 'এম আধার' অ্যাপ ব্যবহার করে বায়োমেট্রিক ব্লক করে রাখা যায়। এতে কোনো ব্যক্তি কারো আধার দিয়ে বায়োমেট্রিক ব্যবহার করতে পারবেন না। পাসওয়ার্ড মনে রেখে আধার কার্ডে বায়োমেট্রিক ব্লক করে রাখতে হবে। প্রয়োজনমতো সেটা আনব্লক করে নেওয়া যেতে পারে। এমনকী আদালতের দলিলে যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকে, অপরাধীরা দুর্নীতি করে সেই দলিল থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নকল করে নিচ্ছে। আদালত এ ব্যাপারে অবহিত আছেন। এবং যাতে এই পদ্ধতিতে দুর্নীতি না হয় সেটা তারা রোখার চেষ্টা করছেন।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ