ভুল স্বীকার করল সিপিএম। তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণের ক্ষেত্রে।
বিজ্ঞাপন
সিপিএমের বিশেষত্ব হলো, তারা মাঝেমধ্যেই গুরুতর রাজনৈতিক ভুল করে। পরে পর্যালোচনা করে সেই ভুল স্বীকার করে। তারপর আবার ভুল করে। এর আগে নেতাজির মূল্যায়নে তারা ভুল করেছে, জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দিয়ে 'ঐতিহাসিক ভুল' করেছে, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের শাসন শেষ হওয়ার পর অনেক খামতি ও ভুলের কথা তারা স্বীকার করেছে। এবার রাজ্যের মানুষ তাদের শূন্য হাতে ফিরিয়েছে। তারপর রাজ্যে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র স্বীকার করেছেন, তৃণমূলকে বিজেমূল বলা, তাদের জনকল্যাণমুখি কর্মসূচির বিরোধিতা করা ভুল হয়েছিল।
বিজেমূল মানে হলো, বিজেপি ও তৃণমূল একসঙ্গে, অর্থাৎ, বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে ভিতরে ভিতরে আঁতাত আছে। বিজেপি-র সঙ্গে ঘনিষ্টতা বোঝাতে এই বিজেমূল শব্দটি ভোটের আগে ব্যবহার করতে শুরু করে সিপিএম। তা নিয়ে প্যারোডি করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে তা ঘুরতে থাকে। তাতেই সিপিএম নেতাদের মুখ উজ্জ্বল হয়। কিন্তু তারা এতদিনে বুঝতে পারলেন, তাদের ভাবনায় ভুল ছিল।
সূর্যকান্ত মিশ্র বুধবার সামাজিক মাধ্যমে সিপিএম কর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। সেখানেই তিনি মেনে নিয়েছেন দলের ভুলের কথা। তিনি যা বলেছেন তার মোদ্দা কথা হলো, তৃণমূলকে বিজেমূল বলা যেমন ঠিক হয়নি, তেমনই ভোটের আগে 'দিদিকে বল', 'দুয়ারে সরকার'-এর মতো বেশ কিছু প্রকল্প চালু করেছিলেন মমতা। সিপিএম তারও ভরপুর সমালোচনা করেছিল। বিদ্রুপ করেছিল। এখন সূর্যকান্তের উপলব্ধি, সেসব ভুল হয়েছিল। হুইলচেয়ারে বসা মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়েও তারা নানারকম কথা বলেছেন, সেগুলোও ঠিক হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে বাম জোটের ভোট-কৌশল
পশ্চিমবঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট গঠন করে লড়ছে বাম ও কংগ্রেস। সঙ্গে আছে আব্বাস সিদ্দিকির আইএসএফ। কী ভোট-কৌশল নিয়েছে তারা।
পশ্চিমবঙ্গে এর আগে বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক জোট হয়নি। এবার হয়েছে। ব্রিগেডের জনসভায় দেখা গেছে জোটের ছবি। সেই ব্রিগেডে সীতারাম ইয়েচুরি ভাষণ দিচ্ছেন।
ছবি: Sandip Saha/Pacific Press/picture alliance
বার্তা দেয়ার জন্য
এর আগে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করলেও ভোটের প্রচারে বাম ও কংগ্রেস নেতাদের এক মঞ্চে দেখা যায়নি। গত বিধানসভা নির্বাচনে একেবারে শেষে রাহুল গান্ধীর জনসভায় ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ফলে সমঝোতার বার্তা ঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তাতে ক্ষতি হয়েছে বাম-কংগ্রেসের। তাই এবার আঁটঘাট বেঁধে লড়াই।
ছবি: Sonali Pal Chaudhury/NurPhoto/picture alliance
সঙ্গী আইএসএফ
নতুন দল তৈরি করেছেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। দলের নাম ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। সিদ্দিকির দলকে জোটে নিয়েছে বাম ও কংগ্রেস। কারণ, তারা মুসলিম ভোট ভাগ হতে দিতে চায় না। মুসলিম ভোট পাওয়ার উপরই নির্ভর করছে মালদহ ও মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বামেদের জয়ের সম্ভাবনা।
ছবি: Naushad Bhai
সিদ্দিকিকে নিয়ে বিতর্ক
আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে। তুলেছেন আনন্দ শর্মার মতো কিছু নেতা। তারা বলছেন, সিদ্দিকি কট্টরপন্থি। তাই তার সঙ্গে জোট কংগ্রেসের আদর্শের বিরোধী। তার জবাব দিয়েছেন অধীর। ঘটনা হলো, সিদ্দিকি আলাদা লড়লে মুসলিম ভোট কাটতে পারেন। তাই নিজেদের স্বার্থেই কংগ্রেস তার সঙ্গে জোটে গেছে।
ছবি: Naushad Bhai
সকলকে সঙ্গে নিয়ে
বাম নেতারা এবার সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চান। তাই ব্রিগেডের সভায় সব দলের নেতা ভাষণ দিয়েছেন। এমনকী জোটের আসন ঘোষণার কাজও তারা একসঙ্গে করতে চান। তাই সিপিএম সহ বাম দলগুলির এবং আইএসএফের প্রার্থী ঘোষণার সময়ও কংগ্রেসের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ছবি: UNI
বিকল্প হওয়ার লক্ষ্যে
বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট তৃণমূল ও বিজেপি-র বিকল্প হতে চায়। তারা যে শক্তিশালী তা বোঝানোর চেষ্টা চলছে। গতবার বামেরা কংগ্রেসের থেকেও কম আসন পেয়েছিল। তাই বিধানসভায় বিরোধী নেতার পদ পেয়েছিলেন কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান। এবার তারা আসন বাড়াতে চাইছে। তৃণমূল ও বিজেপি-র বিকল্প হতে চাইছে জোট।
বাম প্রার্থী তালিকায় নতুন মুখদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। একগুচ্ছ তরুণ নেতা ও নেত্রীকে প্রার্থী করা হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতা-নেত্রীদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই উদ্যোগ বামেদের।
ছবি: Payel Samanta/DW
কংগ্রেসে অধীরই প্রধান
কংগ্রেসের রাজ্য নেতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় এবং আসন জেতানোর ক্ষমতার নিরিখে সব চেয়ে এগিয়ে অধীর চৌধুরী। তিনি নিজের জেলা মুর্শিদাবাদে সব চেয়ে জনপ্রিয় নেতা। অন্য জেলাতেও তার জনসভায় ভালো ভিড় হচ্ছে। কংগ্রেস প্রার্থীদের জেতানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধেই নিতে হচ্ছে অধীরকে।
ছবি: Zumapress/Imago Images
জোট কি পারবে?
বামেদের নেতৃত্বে সংযুক্ত মোর্চা কি সাধারণ মানুষের সমর্থন পাবে? হারাতে পারবে বিজেপি ও তৃণমূলকে? বামেদের ডাকা ব্রিগেডের সভায় প্রচুর ভিড় হয়েছে। তা দেখেই জোট ভোটে সাফল্য পাবে এমন কথা বলা যায় না। জোটের সামনে খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ। তৃণমূলের প্রধান বিকল্প এখন বিজেপি। এই দুই দলকে পিছনে ফেলে জোট এগিয়ে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। তবে ওই দুই দল গরিষ্ঠতা না পেলে, তখন জোটের গুরুত্ব খুবই বেড়ে যাবে।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
9 ছবি1 | 9
সূর্যকান্ত বলেছেন, তারা প্রচুর চিঠি পাচ্ছেন। অনেক চিঠিতে কুৎসিত গালাগালিও থাকছে। কিন্তু সেসব কিছুই ফেলে দিচ্ছেন না।
ঘটনা হলো, আজ বিধানসভায় সিপিএমের আসন শূন্য। প্রভাব কমতে কমতে তারা এখন এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এখন ভুলস্বীকার করছে তারা। কিন্তু বারবার তো সেই ভুলের ফাঁদেই জড়িয়ে পড়ছে সিপিএম! প্রবীণ সাংবাদিক ও সাবেক সিপিএম হোলটাইমার আশিস গুপ্ত মনে করেন, ''এই ভুল তো আজকের নয়। ২০০৬ সালে বিপুল ভোটে জিতে আসার পর যাদের সাম্রাজ্য ২০১১ সালে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়, যারা নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে পারে না, তাদের সঙ্গে তো অনেকদিনই সাধারণ মানুষের যোগ ছিন্ন হয়ে গেছে।''
আশিসের মতে, আগে তারা সব বাড়ি বড়ি গিয়ে ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা চাঁদা নিতেন। চাঁদা নেয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ভাবনা জানা যেত, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। সেসব অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে। পার্টির কর্মীরা আর মানুষের কাছে যান না। তিনি মনে করেন, কিছু ছাত্রছাত্রী পার্টির প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে, হবেও। কিন্তু তাদের দিয়ে গ্রামে গঞ্জে পার্টিকে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তারা শহরের দিকে কাজ করতে পারে। আর মানুষের সঙ্গে থেকে রাজ্য জুড়ে কাজ করে ভুল না করে পার্টিকে দাঁড় করনোর কাজটা এখন খুবই কঠিন।