ইউটিউব, ফেসবুকে মাঝেমাঝেই ঝড় তোলে কিছু শিরোনাম৷ হাজার-হাজার ক্লিক, লাখ-লাখ ভিউ পায় সেগুলো৷ খবরগুলো করোনাকেন্দ্রিক, তবে গুজবভিত্তিক৷
বিজ্ঞাপন
পেশার খাতিরে আজকাল ইউটিউবে একটু বেশিই সময় দিতে হয়৷ কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কোন ধরনের ভিডিও বেশি চলছে, কেনো বেশি চলছে সেগুলো ঘাঁটার, বোঝার চেষ্টা করি৷ বর্তমানে সেরকমই এক টপিক হচ্ছে করোনা৷
এই টপিকে যাতে ভুয়া খবর বেশি না ছড়ায় সেজন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভিডিও প্লাটফর্ম ইউটিউব৷ মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি করোনা সংক্রান্ত ভিডিও প্রমোশনের জন্য নেয় না৷ অর্থাৎ কেউ চাইলেও বৈধ পথে ইউটিউবে করোনা সংক্রান্ত ভিডিও পয়সা দিয়ে প্রমোট করতে পারবে না৷
ভুয়া খবরের প্রসার রোধে ইউটিউবের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে৷ এমনটাও দেখা যাচ্ছে যে করোনা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে এমন ভিডিও ইউটিউবে তেমন একটা সাড়া পাচ্ছে না কারণ প্রতিষ্ঠানটি সেটিকে স্বয়ংক্রিয় প্রথম পাতায় কিংবা ‘রেকমেন্ডেশনে' যায়গা দিচ্ছে না৷ কিন্তু ইউটিউবের এসব উদ্যোগ গুজব বা ভূয়া খবর রোধে কতটা সহায়ক হচ্ছে?
কয়েকটি ভিডিওর শিরোনাম পড়ুন:
- ‘‘করোনা কার তৈরি? বলে দিলেন ব্রিটিশ বক্সার! জাতিসংঘে চীনকে নিয়ে এ কেমন দাবি আইসিজির!’’
- ‘‘চীন কি ইচ্ছাকৃত ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস?|| চীনের এতো বড় ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে কত বড় কারণ?’’
- ‘‘এই ১৫ তথ্যই প্রমাণিত করে চীন সারা বিশ্বকে ধ্বংস করে দেবে খুব শীঘ্রই|| চীনের ষড়যন্ত্রে জ্বলছে বিশ্ব’’
- ‘‘কোরোনায় ইহুদিদের এ কি হাল!! প্রবাসীদের সু-খবর দিলো সৌদি !! দেশবাসীর প্রতি খালেদা জিয়ার পরামর্শ’’
- ‘‘চীনের মুসলমানের জন্য আশির্বাদ করোনা ভাইরাস! আজ তারা প্রকাশ্য নামাজ পড়ছে’’
এসব শিরোনামের ভিডিওগুলোর কোনটিরই ভিউ চার লাখের কম নয়, মন্তব্য হাজার হাজার৷ অথচ ভিডিওগুলো শুধু গুজব কিংবা ভুয়া বা অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরিতে৷ এসব ভিডিও-র মানও বলার মতো নয়৷ অথচ মানুষ সেসব দেখছে, এবং ছড়িয়েও দিচ্ছে৷ এমনকি ইউটিউবের নানা উদ্যোগও ভিডিওগুলোর প্রচার থামাতে পারছে না৷
শুধু ইউটিউব কেন, ফেসবুকেও দেখছি করোনা ভাইরাস নিয়ে নানা রকম গুজব মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে৷ অমুক দেশের তমুক করোনা নিয়ে দিয়েছেন বিস্ফোরক তথ্য – এমন রিপোর্ট বা ভিডিও আমার ইনবক্সেও জড়ো হচ্ছে৷ অথচ সেই তমুক ব্যক্তিটি হয়ত এমন কেউ যার করোনা নিয়ে কথা বলার কোন যোগ্যতা বা অবস্থান – কোনটিই নেই৷ আর তিনি এমন কিছু বলেছেন যেটা বাস্তবসম্মত বা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে না হলেও সাধারণ মানুষ শুনতে চান৷
সাধারণ মানুষের এই শোনার আগ্রহের সঙ্গে গুজব বা ভুয়া খবর ছড়ানোর একটি সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি৷ আপনি যতই সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ দেন না কেন, সমাজের একটি অংশ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে করোনা হচ্ছে এক জীবাণু অস্ত্র যা চীনের তৈরি কিংবা বিধর্মীদের মারতে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছে এই ভাইরাস৷ ফলে, কেউ যখন তাদের সেই বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কিছু প্রকাশ করছেন, সেটা হয়ে যাচ্ছে ভাইরাল৷
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে গড়ে ওঠা এই বিশাল সংখ্যার ভুয়া খবর, গুজবে বিশ্বাসী পাঠক, দর্শকদের কিভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা যায় সেটা মাঝেমাঝে ভাবি৷ কিন্তু, সুনির্দিষ্ট কোন সমাধান পাইনা৷ হয়ত সঠিক তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া একটি সমাধান হতে পারে৷ আপনার কাছে কি আর কোন সমাধান আছে?
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷