সামাজিক মাধ্যমে বা অন্যত্র ভুয়া তথ্য দিলে জেল হবে তুরস্কে। আইন পাস পার্লামেন্টে। সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুয সবারই জেল হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে যিনি ভুয়া তথ্য দেবেন, তার ব্যক্তিগত সব তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
কাউন্সিল অফ ইউরোপ জানিয়েছে, ভুয়া তথ্য কাকে বলা হবে, সেই বিষয়টি বিলে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তাদের মতে, ২০২৩-এর জুনে তুরস্কে নির্বাচন। তার আগে এই আইন পাস করার অর্থ হলো, মানুষকে জেলের ভয় দেখানো এবং মানুষ যাতে নিজেরাই সমালোচনা থেকে বিরত থাকে তার ব্যবস্থা করা।
আইনের একটি অংশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠছে। সেখানে বলা হয়েছে, অনলাইনে তুরস্কের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিলে বা কোনো তথ্য যা জনমানসে ভয় তৈরি করতে পারে বা জনশৃঙ্খলার বিরোধী এমন কিছু লিখলে-- এক থেকে তিন বছরের জেল হবে।
প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) নেতা অ্যালটে বলেছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তুরস্ক অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে। এই আইন করার পর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার তালিকায় তুরস্ক থাকবেই না।
এর্দোয়ানকে হটাতে চান যারা
চলতি বছর জুনের মধ্যে তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা৷ ঐ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ান ও তার একেপি পার্টিকে হারাতে একটি বিরোধী জোট তৈরি হচ্ছে৷
ছবি: Alp Eren Kaya/Republican People's Party (CHP) /Handout/REUTERS
কেমাল কিলিচদারোলু
৭২ বছর বয়সি সাবেক আমলা কিলিচদারোলু তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি সিএইচপির প্রধান৷ এর্দোয়ান নিয়মিত যাদের সমালোচনা করতে পছন্দ করেন তাদের একজন কিলিচদারোলু৷ জাতীয় নির্বাচনে তার দলের ২২ থেকে ২৬ শতাংশ সমর্থন আছে বলে মনে করা হয়৷ ২০১৭ সালে তার দলের এক সাংসদকে জেল দেয়ার প্রতিবাদে আঙ্কারা থেকে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত মিছিল করে আলোচিত হন তিনি৷
ছবি: CHP
মেরাল আকসেনার
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আকসেনার তার দল এমএইচপি পার্টির (এর্দোয়ানের দলের জোটসঙ্গী) শীর্ষ নেতা দেভলেত বাচেলিকে হটানোর পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়ে ২০১৬ সালে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন৷ এরপর তিনি আইওয়াইআই (ভালো) পার্টি গঠন করে ২০১৮ নির্বাচনে সিএইচপির সঙ্গে জোট করেন৷ বর্তমানে ৬০০ আসনের মধ্যে ৩৬ জন সাংসদ তার দলের৷ তিনি তুরস্ককে আবারও সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিতে চান৷ ২০১৮ সালে এর্দোয়ান প্রেসিডেন্ট শাসন চালু করেন৷
ছবি: ANKA
একরেম ইমামোলু
২০১৯ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হলে প্রথম সেই ফল বাতিল করে দেয়া হয়৷ পরে আবারও নির্বাচন হলে ইমামোলু তাতেও জিতে যান৷ ৫১ বছর বয়সি ইমামোলু সিএইচপি দলের সদস্য৷ তার দল ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত হলেও মেয়র নির্বাচনের সময় তিনি কিছু রক্ষণশীল ভোটারদের টানতে সমর্থ হয়েছিলেন৷ ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন ইস্যুতে মাঝেমধ্যে এর্দোয়ানের সঙ্গে তার মতপার্থক্য হয়৷ আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারেন৷
ছবি: İBB
মানসুর ইয়াভাশ
৬৬ বছর বয়সি আইনজীবী ইয়াভাশ এক সময় এমএইচপি পার্টি করতেন৷ পরে তিনি কিলিচদারোলুর সিএইচপি পার্টিতে যোগ দেন৷ ২০১৯ সালে তিনি এর্দোয়ানের একেপি পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে রাজধানী আঙ্কারার মেয়র নির্বাচিত হন৷ মেয়র হিসেবে তিনি করোনা মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছেন৷ তাই জনমত জরিপে তাকে জাতীয় পর্যায়ে এর্দোয়ানের চ্যালেঞ্জার হিসেবে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Hilal Köylü/DW
আলি বাবাজান
একসময় এর্দোয়ানের ঘনিষ্ট ছিলেন ৫৪ বছর বয়সি বাবাজান৷ তিনি সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রীও৷ ২০১৯ সালে একেপি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন৷ এরপর ডেভা পার্টি গঠন করেন৷ আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে তিনি সংস্কারের ডাক দিয়েছেন৷ তিনি অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন৷ দায়িত্ব পালনের সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ভালো সখ্যতা ছিল তার৷
ছবি: Hilal Köylü/DW
আহমেট দাভুটোলু
২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এর্দোয়ানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি৷ তবে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি পরিচিতি পান৷ তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল ‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে শূন্য সমস্যা’৷ তবে আরব বসন্তের সময় তার মধ্যপ্রাচ্য কৌশল পথ হারিয়ে ফেলে৷ বর্তমান প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থারও ঘোর সমালোচক তিনি৷ ২০১৯ সালে একেপি থেকে পদত্যাগ করে তিনি গেলেচেক পার্টি গড়ে তোলেন৷
ছবি: Hilal Köyle/DW
6 ছবি1 | 6
কিন্তু এর্দোয়ানের দলের দাবি, ভুয়া ও ভুল তথ্যের স্রোত বন্ধ করার জন্য এই আইন দরকার ছিল। এই বিল সংবাদমাধ্যম বা বিরোধীদের চুপ করানোর জন্য করা হয়নি।
পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর বিলটি এখন প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য গেছে। তিনি অনুমোদন দিলেই তা আইনে পরিণত হবে।
নির্বাচনের আগে তুরস্ক
আগামী বছর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি তুরস্কে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে, এর্দোয়ান এবং তার দলের প্রতি জনসমর্থন কমছে।
মানবাধিকার সংগঠন কাউন্সিল অফ ইউরোপের পরামর্শদাতা ভেনিস কমিশন জানিয়েছে, এই আইনে অপরাধীদের জেলে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। এটাই মানুষকে ভয় পাইয়ে দেবে।
শুধু জেল নয় বিলে জরিমানার বিষয়টিও আছে। তাছাড়া সামাজিক মাধ্যমের সংস্থাগুলি অভিযুক্তের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে।
তুরস্কে ‘মাদ্রাসা’ নিয়ে ঠাট্টা করে পপ গায়িকা গৃহবন্দি
প্রথমে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেয়া হয়েছিল গুলসেনকে৷ এর প্রতিবাদে শুরু হলো বিক্ষোভ৷ তুর্কি পপ গায়িকাকে তারপর আর কারাগারে রাখা যায়নি৷ কী করেছিলেন গুলসেন? বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Depo Photos via REUTERS
জনপ্রিয় গায়িকা গুলসেন
পুরো নাম গুলসেন বায়রাক্তার চোলাকোগ্লু৷ ১৯৯৬ সালে প্রথম অ্যালবাম ‘বি আদম’ প্রকাশের পর অল্প সময়েই শ্রোতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন গুলসেন নামে৷ তখন বয়স সবে ২০ হয়েছে৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনপ্রিয়তার গ্রাফ যখন চড়ছে তখনই ঘর-সংসারে মন দিতে স্টেজ থেকে সাময়িক বিদায় না নিলে ৪৬ বছর বয়সি গুলসেনকে সারা বিশ্ব হয়ত আরো অনেক বেশি চিনতো৷
ছবি: Depo/AP/picture alliance
একটি খবরকে ঘিরে তোলপাড়
গত বুধবার এর্দোয়ানপন্থি হিসেবে পরিচিত এক গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় গুলসেনের একটি ভিডিও৷ ভিডিওটি চার মাস আগের৷ সেই ভিডিওর সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে৷
ছবি: ANKA
ভিডিওতে যা ছিল
গত এপ্রিলে এক অনুষ্ঠানে গান গাইছিলেন গুলসেন৷ গানের ফাঁকে ফাঁকে নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন, নানা বিষয়ে মজাও করছিলেন৷ এক সময় স্টেজে উপস্থিত নিজের ব্যান্ডের এক মিউজিশিয়ানকে দেখিয়ে গুলসেন বলে ওঠেন, ‘‘ ও আগে এক ইমাম হাতিপ (স্কুল)-এ পড়তো৷ ওর মধ্যে আজ যেটুকু বিকৃতি দেখা যায়, তা সেখান থেকেই এসেছে৷’’
ছবি: ANKA
ইমাম হাতিপ এবং এর্দোয়ান-সংযোগ
তুরস্কে ইসলাম ধর্ম পড়ানোর স্কুলগুলোকে বলা হয় ইমাম হাতিপ৷ তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ানও দেশের প্রথম সারির একটি ইমাম হাতিপে লেখাপড়া করেছেন৷ সাবাহ পত্রিকার ওয়েবসাইটে গুলসেনের চার মাস আগের সেই ভিডিও প্রকাশ করা হলো বুধবার৷ সঙ্গে সঙ্গেই তৎপর হলো পুলিশ৷ বৃহস্পতিবারই গ্রেপ্তার হলেন গুলসেন৷ অভিযোগ- তিনি ঘৃণা ছড়িয়েছেন, উসকানি দিয়েছেন৷
ছবি: ullstein bild - Reuters/MURAD SEZER
আসল কারণ অন্য?
গুলসেনকে গ্রেপ্তার করায় সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ গুলসেন স্বাধীনচেতা বলে, এলজিবিটি+দের অধিকারের বিষয়েও সোচ্চার হয়ে এর্দোয়ান এবং তার একে পার্টির চক্ষুশূল হয়েছেন বলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা৷ বিক্ষুব্ধরা বলেন, এর্দোয়ান এবং তার সরকার যে বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি তা খুব স্পষ্ট, কারণ, ভিডিও প্রকাশের পর কয়েকজন মন্ত্রীও এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে টুইট করেছেন৷
ছবি: Anka
কারামুক্ত, তবে মুক্ত নয়
বৃহস্পতিবার ঘৃণা ছড়ানো এবং উসকানির অভিযোগে গ্রেপ্তারের পরই গ্রেপ্তারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা করেন গুলসেনের আইনজীবীরা৷ সোমবার মামলার শুনানি হয়৷ শুনানি শেষে গুলসেনকে কারাগার থেকে মুক্ত করে ঘরে বন্দি রাখার রায় দেয় আদালত৷
ছবি: Depo Photos via REUTERS
6 ছবি1 | 6
সামাজিক মাধ্যমে কড়াকড়ি
২০১৬ সালে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের প্রায় সব সংবাদপত্র ও টিভি এখন সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
কিন্তু সামাজিক মিডিয়াগুলি ব্যতিক্রম। পরে ফেসবুক, টুইটারের মতো বড় সংস্থাগুলিকে তুরস্ক একজন স্থানীয় প্রতিনিধি রাখতে বাধ্য করেছে, যিনি দ্রুত স্থানীয় আদালতের নির্দেশ মানবেন এবং আপত্তিকর পোস্ট মুছে দেবেন।
এর্দোয়ানের যুক্তি, তুরস্কের সমাজের উপর ভুাল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরের কুপ্রভাব পড়ছে। গত ডিসেম্বরে তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যম গণতন্ত্রের প্রধান বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে তুরস্ক ১৪৯ নম্বরে। এই বছরের গোড়ায় রিপোটার্স উইথআউট বর্ডার এই তালিকা প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, তুরস্ক হামেশাই সাংবাদিকদের জেলে পাঠায়।
গত জুলাইয়ে তুরস্কের রেডিও ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট লাইসেন্সের সমস্যার কথা বলে জার্মান সরকারি ব্রডকাস্টার ডয়চে ভেলেকে ব্লক করেছে।