1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্যোগবাংলাদেশ

ভূমিকম্প মোকাবেলার পরিকল্পনা আছে, বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে নানা সময় নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে৷ নতুন করে দুই হাজার কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে৷ কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা- বিল্ডিং কোডই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না৷

ঢাকা শহর৷
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা শহরে যদি সাত মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয় তাহলে ৭২ হাজার ভবন তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বসে পড়বে৷ ছবি: Farjana K. GODHULY/AFP

সর্বশেষ জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে সারা দেশে ছয় কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে৷ ১১ লাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা স্থাপনা, ৪০২টি খাদ্য গুদাম, ১৪টি গ্যাস ফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল, এক হাজার আটটি কল্যাণ কেন্দ্র, দুই হাজার ৮০০ উচ্চ বিদ্যালয়, এক হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছয় হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, এক হাজার ৬০০ কি. মি. জাতীয় মহাসড়ক, সাত হাজার ৪০০ কি.মি. স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার ব্রিজ, এক হাজার ৫০০ কি. মি. রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এই প্রতিদেনটি তৈরি করেছে৷ সেখানে বাংলাদেশে যে ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতির অভাব রয়েছে তা-ও স্বীকার করা হয়েছে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ -উপাচার্য ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘ঢাকা শহরে যদি সাত মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়, তাহলে ৭২ হাজার ভবন তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বসে পড়বে৷ এতে ব্যাপক প্রাণহানি ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটবে৷’’

তিনি জানান, ‘‘গবেষণায় দেখা গেছে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৪০ ভাগ মানুষ নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করে বেরিয়ে আসতে পারেন৷ আর যে ৬০ ভাগ আটকা পড়েন, তাদের ৫০ ভাগকে স্থানীয় মানুষ বা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার করেন৷ বাকি ৫০ ভাগকে উদ্ধার করতে বিভিন্ন সংস্থার প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী লাগে৷ সেটাই হলো বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷ তাদের উদ্ধার করা এবং নিরাপদে রাখা...৷’’ তার কথা, ‘‘মনে রাখতে হবে ভূমিকম্পে হাসপাতাল, সড়ক, আশ্রয়স্থল সবই বিধ্বস্ত হয়৷ তাই প্রয়োজন উদ্ধারকারী ও প্রচুর পরিমাণে খোলা জায়গা, যেখানে তাঁবু খাটিয়ে মানুষকে রাখা হবে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের এই প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়, তবে ২০০৯ সালের আগে কোনো প্রস্তুতিই ছিল না বলা চলে৷ পরবর্তী সময়ে ৫০ হাজারের মতো ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে৷ আর আমার জানা মতে, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ইকুইপমেন্ট দেয়া হয়েছে৷ একলাখ তাঁবুও কেনা হয়েছে৷’’

বাংলাদেশে ২০০৯ সালে সিডিএমপি ( কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট) ও জাইকার উদ্যোগে ভূমিকম্প নিয়ে একটা সমীক্ষা হয়েছে৷ এরপর আর সার্বিক কোনো জরিপ হয়নি৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘‘ওই জরিপে তখন বলা হয়েছিল, ঢাকা শহরে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৭২ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হবে৷ এক লক্ষ ৫৮ হাজার বাড়ি-ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তিন লাখের বেশি মানুষ মারা যাবে৷ আরো লাখ লাখ লোক আহত হবে৷ এরপর এত বছরে আরো তো অনেক ভবন হয়েছে৷ ফলে ঝুঁকি আরো বেড়েছে৷ সরকার এই ঝুঁকি মোকাবেলায় দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে৷’’

ঝুঁকির বিপরীতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভূমিকম্প প্রস্তুতির দুইটি অংশ৷ একটি হলো সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন এবং দেশকে ভূমিকম্প সহনীয় করা৷ আমরা দুই ধরনের প্রস্তুতিই নিচ্ছি৷’’

এজন্য ঢাকা শহরকে আটটি জোনে ভাগ করে ৩৬ হাজার আরবান ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে৷ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসে দুইটি আলাদা টিম করা হয়েছে, যারা আরবান সার্চ ও রেসকিউ টিম৷ তাদের আধুনিক ইকুইপমেন্ট দেয়া হয়েছে৷ আরো আসছে৷

ঢাকাকে আটটি জোনে ভাগ করে ৩৬ হাজার আরবান ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে: প্রতিমন্ত্রী

This browser does not support the audio element.

ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সেন্টারের নির্মান কাজও আগামী মাস থেকে শুরু হচ্ছে বলে জানান তিনি৷ এখান থেকে কো-অর্ডিনেটেড কমান্ড ও মনটরিং করা হবে৷

তিনি বলেন, ‘‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড যেটা করা হয়েছে, তা কঠোরভাবে অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর সরকারি পুরোনো ভবনগুলোকে যাচাই করে রেট্রোফিটিং-এর মাধ্যমে শক্তিশালী করার কাজ শুরু হয়েছে৷ বেসরকারি বাড়ির মালিকদেরও নিজস্ব উদ্যোগে এটা করতে হবে৷’’

ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এক হাজার ৩শ' ৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের কাজ শুরু হয়৷ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর বর্তমান ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল কিনা সেজন্য সব ভবন অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা, মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া, ভবন নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় রোধে ভবনের নকশা অনলাইনে দেয়া, ভূমিকম্প বিষয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বাড়ি নির্মাণে বাধ্য করা এবং ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সব উপকরণ পরীক্ষার জন্য রিসার্স ট্রেনিং টেস্টিং ল্যাবলেটরি স্থাপন করা৷

আরবান রেসিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালী বলেন, ‘‘আগামী অক্টোবরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে৷ প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজ (পর্যায়) দরকার৷’’ তিনি জানান, রাজধানীতে ভূমিকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে৷ প্রাথমিক সমীক্ষায় স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালসহ সরকারি  তিন হাজার ২৫২টি ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ৫৭৯টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২২টি ভবন ভেঙে ফেলতে হবে৷ তাছাড়া ২২৯টি ভবন সংস্কার করে ভূমিকম্প সহনশীল উপযোগী করতে হবে৷ প্রকল্প পরিচালক জানান, রাজধানীর ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবন চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়নি৷ প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজে এটা করা হবে৷ ৯০ শতাংশ ভবনের সমীক্ষা এখনো বাকি আছে৷ বিশ্বব্যাংকের কাছে দ্বিতীয় ফেজের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে৷ এটা অনুমোদন হলে আগামী অক্টোবর মাস থেকে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের সমীক্ষাও শুরু করা হবে৷

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজউকের আওতাধীন ৬৬ শতাংশ ভবনই নিয়ম-বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে৷ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত রাজউকের আওতাধীন এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দুই লাখ চার হাজার ১০৬টি ভবনের ওপরে জরিপ করা হয়েছে৷ এতে পূর্ব নির্মিত এক লাখ ৯৫ হাজার ৩৭৬টি ভবনের মধ্যে এক লাখ ৩১ হাজার ৫৮৩টি (৬৭.৩৫ শতাংশ) ভবনে বিভিন্ন ধরনের ব্যত্যয় পাওয়া গেছে এবং নির্মাণাধীন আট হাজার ৭৩০টি ভবনের মধ্যে তিন হাজার ৩৪২টি (৩৮ শতাংশ) ভবনের অনুমোদিত নকশায় ব্যত্যয় পাওয়া গেছে৷ জরিপ করা ভবনের মধ্যে মোট এক লাখ ৩৪ হাজার ৯২৫টিতে (৬৬ শতাংশ) অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে৷

ঢাকায় প্রতিদিনই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদের জন্য রাজউকের আটটি টিম কাজ করে: উজ্জল মল্লিক

This browser does not support the audio element.

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জল মল্লিক বলেন, ‘‘নতুন যেসব বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে, সেগুলো বিল্ডিংকোড মেনেই করা হচ্ছে৷ সমস্যা হচ্ছে, ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবন নিয়ে৷ তবে বিল্ডিংগুলো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে না তা তদারকি করার মতো জনবল এখনো রাজউকের নেই৷ এ কারণে বিষয়টি তদারকির জন্য বিল্ডিং রেগুলেশন অথরিটি হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু তা এখনো হয়নি৷’’ তার কথা, ‘‘আমাদের হিসেবে ঢাকা শহরে এখন ২১ লাখ ভবন আছে৷ এর মধ্যে শতকরা এক ভাগও যদি বিল্ডিং কোডের বাইরে থাকে, সেটাও অনেক৷ তাহলে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতেই পারছেন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের লোকবল কম থাকলেও ঢাকা শহরে প্রতিদিনই রাজউকের আটটি টিম কাজ করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদের জন্য৷ হয়ত প্রচারের অভাবে সেটা চোখে পড়ে না৷’’

বর্তমান পরিস্থিতি

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ ২০২২ অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরী এলাকায় মোট রাস্তার মাত্র ১০ শতাংশের প্রস্থ ২০ ফুট বা তার বেশি৷ অর্থাৎ, ৯০ শতাংশ রাস্তা ২০ ফুটের কম চওড়া৷

এসব অপ্রশস্ত রাস্তা ভূমিকম্প বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বড় বাধা তৈরি করবে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ১৩ হাজার কর্মী আছে৷ আরো জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ সারাদেশে ভলান্টিয়ার আছে ৪০ হাজারের মতো৷ সব উপজেলায়ই এখন আমাদের স্টেশন আছে৷ কিন্তু আমাদের বাইরে সেনাবাহিনিসহ আরো অনেকের উদ্ধারকারী দল আছে৷ আমাদের ইকুইপমেন্ট আছে৷ তবে বড় কথা হলো, মানুষকে সচেতন করা৷ সেজন্য আমরা নানা ধরনের প্রচার করছি৷’’

ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে এমন শীর্ষ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়৷ জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ, অপ্রশস্ত সড়ক অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবই এ ঝুঁকি তৈরি করেছে৷

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেস, ‘‘শুধু ঢাকা নয়, বাইরে আরো অনেক শহর ঝুঁকিতে আছে৷ আসলে এখন আমাদের লোকাল ভলান্টিয়ার তৈরির ওপর জোর দিতে হবে৷ কারণ, তারাই সবার আগে উদ্ধার কাজে নামতে পারে৷’’

প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের উদ্ধারকারীরা এখন তুরস্কে কাজ করছেন৷ আমরা ভূমিকম্প সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক জোটেও যোগ দিচ্ছি, যাতে দুর্যোগের সময় সবার সহযোগিতা পাই৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ