1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভূমির অধিকার চান যাঁরা...

সমীর কুমার দে, ঢাকা১৮ এপ্রিল ২০১৬

আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা শ্রমিকরা৷ এঁদের দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকা, যা অন্য যে কোনো শ্রমিকের মজুরির তুলনায় কম৷ তার ওপর নেই কোনো স্বাস্থ্য সেবা, নেই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত স্কুল৷ এমনকি যে জমিতে থাকেন, তা-ও চা বাগান মালিকের৷

বাংলাদেশের চা বাগান
ছবি: DW/K. Thaunaujam

দেড় শতাধিক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের চা-বাগানগুলোয় অবস্থান করা এই শ্রমিকরা তাই ভূমির অধিকার চান৷ চান কুপির বদলে বিদ্যুৎ, চান সন্তানদের স্কুলে পড়াশোনা করানোর অধিকার৷ তাই মজুরি বাড়ানোর দাবি করেছেন তাঁরা৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এ কথাগুলো জানান বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা স্বপন কুমার সাঁওতাল৷ অন্য শ্রমিক নেতাদের থেকে ভিন্ন তিনি৷ কারণ তিনি নিজেই কাজ করেন চা বাগানে, থাকেনও সেখানে৷

ডয়চে ভেলে: আপনার দৃষ্টিতে বর্তমানে চা শ্রমিকদের অবস্থা কেমন?

স্বপন কুমার সাঁওতাল: বর্তমানে চা বাগানে শ্রমিকদের অবস্থা বেশি ভালো না৷ তারা খুবই দুর্ভোগে আছেন৷ চা শ্রমিকদের ঘরে অনেক সমস্যা৷ আমরা যেটাকে ‘লেবার লাইন' বলি, সেখানে ৮ হাত বাই ১২ হাত এক-একজন চা শ্রমিকের ঘর৷ সেই ঘরে পরিবারের ৮ থেকে ১০ জনকে নিয়ে বসবাস করেন তাঁরা৷ মজুরির অবস্থাও বেশি ভালো না৷ ২০০৭ সালে বেতন ছিল দৈনিক ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে হয় ৬৯ টাকা এবং বর্তমানে হয়েছে ৮৫ টাকা৷

স্বপন কুমার সাঁওতাল

This browser does not support the audio element.

এই মজুরি দিয়ে আপনাদের কি চলে?

চলা মোটেই সম্ভব না৷ দেখা গেছে, একজন শ্রমিক কাজ করেন আর তাঁর ওপর পাঁচ থেকে ছ'জন নির্ভরশীল৷ বর্তমানে যে ৮৫ টাকা মজুরি, তা দিয়ে কোনো ক্রমেই চলে না৷ আসলে চা শ্রমিকদের অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ৷

মজুরির দাবি নিয়ে আপনাদের কোনো আন্দোলন হয়েছে?

মজুরির বিষয়টা নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি৷ আমরা চাচ্ছি কমপক্ষে ২০০ টাকা৷ তবে তারও বেশি ২৫০ বা ৩০০ টাকা দিলে আরো ভালো হয়৷ একজন শ্রমিক যে মজুরি পান, তা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না, সম্ভবও নয়৷ তাই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখতে স্কুলে পাঠাতে পারেন না তাঁরা৷ যুগ যুগ ধরে কম মজুরির কারণে বিভিন্ন দিক দিয়ে বঞ্চিত বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা৷

সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ আছে কি?

সুযোগ বলতে, বাংলাদেশে ১৬০টি চা বাগান আছে৷ সে'সব বাগেনের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব কম৷ এছাড়া মালিকদের পক্ষ থেকে কিছু বিদ্যালয় আছে ঠিকই৷ কিন্তু সেগুলো লেখাপড়ার অনুপযুক্ত৷ সেখানে লেখাপড়ার কোনো পরিবেশ নেই৷ একজন শিক্ষকের তিন থেকে চারশ' ছাত্র৷ ই অবস্থার মধ্যেই চলছে লেখাপড়া৷

আপনাদের নিজেদের জায়গা জমি আছে, না চা-বাগানের মধ্যে বসবাস করেন আপনারা?

চা বাগানের শ্রমিকরা ১৫০ থেকে ২০০ বছর ধরে চা-বাগানগুলোকে নিজেদের জমি মনে করেই বসবাস করছে৷ কিন্তু এখনো তাঁরা জমির মালিকানা পাননি৷ এখনো তাঁরা মালিকের অধিনেই রয়ে গেছেন৷

আপনার এলাকায় ক'টা চা বাগান আছে? আর সেখানে কর্মরতদের মধ্যে নারী-পুরুষের সংখ্যা কেমন?

মৌলভীবাজারে আছে ৯২টি চা বাগান, হবিগঞ্জে ২৪টা, সিলেটে ২০টা, চট্টগ্রামে ২২টা, রাঙামাটিতে ১টা, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় একটিসহ সারাদেশে মোট ১৬০টি চা বাগান আছে৷ এর মধ্যে শ্রমিক ১ লাখ ২২ হাজার, যা মোট জনসংখ্যা ৬ লাখের বেশি৷ শ্রমিকদের মধ্যে ৯০ ভাগই মহিলা শ্রমিক৷

উপজাতির সংখ্যা কেমন এই শ্রমিকদের মধ্যে?

চা বাগানে ৯৩টি জাতির মানুষ বাস করেন৷ এর মধ্যে রয়েছে রিলে, হাজরা, হারাম, সাঁওতাল, সাধু, টগর, মুন্ডাসহ বিভিন্ন ধরনের উপজাতি৷

চা বাগানে আপনাদের শ্রমিকদের কতগুলো সংগঠন আছে?

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে চা শ্রমিক ইউনিয়ন একটি বৃহত্তম সংগঠন৷ এই সংগঠনের কাজ মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের যে চুক্তি, সেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করা বা সেমিনার করা – এই ধরনের কোনো কাজ তারা করে না৷ আমার সংগঠন থেকে আমরা শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করার কিছু কাজ করছি৷

আমরা মাঝে মধ্যেই দেখি, চা শ্রমিকদের যে সংগঠন সেই সংগঠনের নেতারা নিজেদের মধ্যে অন্তর-কলহে জড়িয়ে বিভিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছেন৷ সেক্ষেত্রে আপনারা নিজেরাই যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তাহলে শ্রমিকদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করবেন কিভাবে?

বাংলাদেশ চা শ্রমিকদের সংগঠন আছে একটাই৷ এছাড়া স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন নামে আর একটি সংগঠন আছে, যেটা দ্বিতীয় শ্রেণির শ্রমিকদের কর্মচারী সংগঠন৷ আমাদের এখানে অন্য কোনো শ্রমিক সংগঠন আর নেই৷

আপনারা যে চা বাগানে থাকেন, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন?

চা বাগানের বাইরে যে রাজনৈতিক নেতারা আছেন, তাঁদের কারণে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি৷ রাজনীতির সঙ্গে চা বাগানের শ্রমিকরা বিশেষভাবে জড়িত না৷ এই সব নেতারা নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর অত্যাচার করে৷ বিশেষ করে নারীরা গ্রামে কাজ করতে গেলে, তাঁদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে৷

আপনারা তো জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতাদের ভোট দেন৷ তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বলেন বা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন – সব জায়গায়-ই তো আপনাদের ভোটাধিকার আছে৷ তা আপনাদের দাবির কথা কি কখনও রাজনৈতিক নেতাদের বলেছেন?

নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক নেতারা আমাদের আশ্বাস দেন৷ কিন্তু নির্বাচন যখন শেষ হয়ে যায়, অর্থাৎ যখন তাঁরা পাশ করে যান, তখন কিন্তু আমাদের কথায় কান-মাথা নাড়েন না৷ বরং তাঁরা আমাদের ক্ষতি-ই করেন৷ যেমন ধরেন, চা বাগানের মধ্যে ছোট ছোট ছড়া আছে৷ সেগুলো থেকে তাঁরা ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করেন৷ পাশাপাশি চা বাগানে যে ছায়াবৃক্ষ থাকে, সেগুলো তাঁদের মাস্তান বাহিনী এসে কেটে নিয়ে যায়৷ কয়েকদিন আগে আমাদের চাঁনপুর বাগানে ইকোনোমিক জোন করার নামে তাঁরা সেটা দখল করতে চেয়েছিলেন৷ আমরা দেড়শ' বছর ধরে কৃষি ফসল করে খাচ্ছি৷ এতে হাজার হাজার মানুষের বেকারত্ব দূর হচ্ছে৷ এরপরেও জমি নেয়ার পাঁয়তারা করছেন তাঁরা৷ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সে'সব দখল করে নেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে৷

চা শ্রমিকদের পক্ষে সরকারের কাছে আপনার দাবি কী?

একাত্তর সালে চা শ্রমিকরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ চা বাগানে শ্রমিকদের ওপর অনেক নির্যাতন হয়৷ ইতিমধ্যে আমাদের দু'জন নারীকে প্রধানমন্ত্রী বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়েছেন৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় লালখান চা বাগানে আমাদের ১১ জনকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ যুদ্ধের শুরুর সময় তেলিয়াপাড়ায় অনেক শ্রমিক মারাও যান৷ আসলে একাত্তরের স্বাধীনতায় চা শ্রমিকদের ভূমিকা কম ছিল না৷ যেহেতু এই সরকার স্বাধীনতার পক্ষের সরকার, তাই এই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের ভূমির অধিকার দেন৷ আমাদের পূর্বপুরুষরা যে যেই জমিতে বসবাস করতেন, তাঁদের নামে সেই জমিটা লিখে দেন৷ চা বাগানে বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু মজুরির ইস্যু আছে৷ দরকার আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্কুলের৷ শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়ে স্কুলে যেতে হয়৷ ফলে অনেকেই স্কুলে যায় না৷ তাই দূর্গম এলাকাগুলোতে সরকার যদি প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দেয়, তাহলে আমাদের সন্তানরা কাছাকাছি স্কুল পেলে লেখাপড়া করার সুযোগটা অন্তত পাবে৷

স্বপন কুমার সাঁওতালের সাক্ষাৎকারটি আপনাদের কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ