ভোক্তার অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘কনজ্যুমার কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' বা সিসিএমএস৷
বিজ্ঞাপন
‘নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী' প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বুধবার ভোক্তা অধিকার দিবসেএ প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন করা হবে৷ এ বছর দেশের বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নানা আয়োজনে দিবসটি উদযাপন করা হবে৷
‘কনজ্যুমার কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' এর মাধ্যমে ভোক্তার অভিযোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে৷ ফলে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি ছাড়া অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ভোক্তার সশরীরে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন হবে না৷
পাশাপাশি ভোক্তার অভিযোগের বিপরীতে জরিমানা করা অর্থের ২৫ শতাংশ প্রণোদনা নগদের পরিবর্তে ডিজিটাল বা ই-পেমেন্টে পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ৷
এতোদিন শুধু ঢাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চলা ‘সিসিএমএস' ব্যবস্থা ১৫ মার্চ থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে পথচলা শুরু করবে৷ এতে সফলতা দেখা গেলে পুরো দেশে তা কার্যকর করা হবে বলে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান৷
ভোক্তা অধিকার দিবস সামনে রেখে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশী বলেন, "ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনা করে ২০০৯ সালে আইনটি হয়েছে৷ এখন এ আইনের সুবিধাটি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে৷ সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়েই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ভোক্তার অধিকারের বিষয়টি তাদের কাছে পৌঁছে দিতে৷”
ভোক্তা অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে এ দিবস পালন আরও যথাযথ হবে বলে মনে করেন তিনি৷
ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ' করা হয়৷ ২০১০ সালে এ আইনের আওতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর৷
প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভোক্তাদের কাছ থেকে অধিদপ্তর ৮৮ হাজার ৯১৮টি লিখিত অভিযোগ পেয়েছে৷ এরমধ্যে ৮৩ হাজার ৭৯৮টি বা ৯৪ দশমিক ২৪ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে৷
নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগের মধ্যে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার ৩২৮টি৷ অর্থাৎ মাত্র ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দণ্ড দিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর৷
ভোক্তা অধিকার ও প্রতারণা
পণ্য ও সেবা পেতে গিয়ে ভোক্তারা কী কীভাবে, কতটা প্রতারিত হন? অধিকার সম্পর্কে ভোক্তারা কতটা সচেতন? এসব বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শিখা রাণীর মাছ কেনা
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিখা রাণী তার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতারণার ঘটনা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে বাজার থেকে মাছ কিনি৷ দোকানি মাছের ওজন ১২০০ গ্রাম দেখিয়ে সে অনুযায়ী দাম নিলেও বাসার পাশের দোকানে মেপে দেখি ওজন ৯৫০ গ্রাম৷ এতে প্রায় ৫০ টাকা ক্ষতি হয়৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আসগর আলীর জমানো টাকা
ঢাকার শ্যামলীতে ভ্রাম্যমাণ ফুটপাথ দোকানি আসগর আলী জানান, তিনি যে বস্তিতে থাকেন, সেখানে একটি সমবায় সমিতিতে লাভের আশায় মাসিক ভিত্তিতে কিছু টাকা জমা রাখা শুরু করেন৷ প্রায় ১৫ হাজার টাকা জমা করার পর জানতে পারেন সেই সমবায় সমিতি ভুয়া, গ্রাহকদের কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তারা পালিয়ে গেছেন৷তিনি মনে করেন এতে ভোক্তা হিসেবে প্রতারিত হয়েছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আব্দুর রহমানের বাড়তি ভাড়া
পরিবারসহ ঈদের ছুটি শেষে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসেন মুদি দোকানি আব্দুর রহমান মোল্লা৷ তিনি জানান, তিনি যে পরিবহণে আসেন, সেখানে তার সাথে জনপ্রতি ৩৫০ টাকায় ভাড়া ঠিক হয়৷ কিন্তু পাশের সিটের সহযাত্রীর সাথে কথা বলে জানতে পারেন তার সাথে ৩০০ টাকায় ভাড়া ঠিক হয়েছে৷ তার প্রশ্ন, ‘‘এসব প্রতারণা দেখবে কে?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মিথ্যা অভিযোগে ঠকলেন সোহেল
ঢাকার গাবতলি বাস টার্মিনালের মেকানিক সহযোগী সোহেল আহমেদ বলেন, ‘‘এর আগে যাত্রাবাড়ীতে এক গ্যারেজে কাজ করতাম, সেখানে ৩ মাসের বেতন পাওনা ছিল৷ একদিন মালিক তার মোবাইল চুরির দায়ে আমাকে মিথ্যাভাবে ফাঁসিয়ে বেতন না দিয়েই চাকরি থেকে বের করে দেয়৷ আমি অনেক কান্নাকাটি করেও তার মন গলাতে পারিনি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সুফিয়ার সন্তানের চিকিৎসা
ঢাকার দনিয়ার বাসিন্দা সুফিয়া বেগম তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, জন্মের পরপরই শিশুটির জন্ডিস ধরা পড়ে৷ স্থানীয় এক বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হলে তারা সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করছিল এবং টাকার অঙ্ক বাড়াচ্ছিল৷ এদিকে বাচ্চার অবস্থা অবনতি হওয়ায় আত্মীয়দের পরামর্শে বাচ্চাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ এখন বাচ্চা অনেকটাই সুস্থ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফল কিনে ঠকলেন জব্বার
ঢাকার কারওয়ানবাজারে তালা-চাবির মিস্ত্রী জব্বার মন্ডল জানান, গত ঈদে তিনি লঞ্চে করে ভোলায় শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যান৷ যাওয়ার সময় বিভিন্ন ফলমূল কিনে নেন লঞ্চঘাট থেকেই৷ বাড়িতে নিয়ে দেখেন, এর অধিকাংশই পচা ও নষ্ট৷ তিনি বলেন, এমন বাজে অভিজ্ঞতা তার পরিচিত আরো অনেকেরই আছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আহমেদুলের দু’বার ‘দণ্ডি’
একটি ব্যাংকে পিয়ন হিসেবে কর্মরত আহমেদুল ইসলাম জানান, কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে যান এই ভেবে যে, চেকারের কাছ থেকে টিকিট কিনবেন৷ পরে ট্রেনে কোচ অ্যাসিস্টেন্ট তার কাছ থেকে টাকা নেন, কিন্তু কোনো টিকিট দেন না৷ পরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নামলে গেইটে আবারো তার কাছ থেকে জরিমানাসহ টিকিটের টাকা নেয়া হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাশুকের ইন্স্যুরেন্স অভিজ্ঞতা
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক মাশুক শাহরিয়ার বলেন, মিল্কভিক হেলথ লিমিটেড নামের এক হেলথ ইন্সুরেন্স কোম্পানি চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে ‘ক্যাশ ব্যাক অফার’ সহ নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়৷ কিন্তু সেখানে রেজিস্ট্রেশন করার পর জানা যায়, তাদের নানারকম শর্তের কথা৷ এমনকি সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও কেটে নেয় তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সালেহার জামা বিড়ম্বনা
ঢাকার মিরপুর ১৩ নম্বরের মিডএশিয়া গার্মেন্টসের কর্মী সালেহা খাতুন বলেন, গত রোজার ঈদে তিনি তার মেয়ের জন্য গুলিস্তানের একটি দোকান থেকে জামা কেনেন৷ কেনার সময় জামা মাপে না হলে তা বদলে দেবার কথা থাকলেও পরে দোকানদার কথা রাখেননি৷ টাকাও ফেরত দেননি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন প্রতারণার শিকার সৈকত
একটি পণ্য ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান সৈকত ইসলাম বলেন, ৩ মাস আগে অনলাইনে তিনি একটি হেডফোন কেনেন৷ পণ্যটি গ্রহণ করার পর দেখা যায় সেটি নষ্ট৷ পরে সেই অনলাইন পেজে এটি নিয়ে অভিযোগ জানালে তারা দুর্ব্যবহার করেন এবং পেজ থেকে ব্লক করে দেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পণ্য কিনে লাঞ্ছিত নাসির
একটি বিদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাসির উদ্দিন জানান, ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে গতমাসে তিনি একটি স্মার্টফোন কেনেন৷ ৭ দিনের মধ্যে বড় সমস্যা হলে সেটি পালটে দেবার কথা ছিল৷ কেনার ৩ দিনের মধ্যেই সমস্যা দেখা দেয়৷ কিন্তু তিনি দোকানে নিয়ে গেলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা
ফেসবুকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পেজে শত শত অভিযোগ দেখা যায় ভুক্তভোগীদের৷ সেখানে সাব্বির আহমেদ নামের একজন মন্তব্য করেন, ‘‘এনারা ভালো কাজ করলেও জনবল যথেষ্ট নয়৷ দেশের আনাচেকানাচে প্রতি পদে যারা প্রতারণা করছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
12 ছবি1 | 12
এই সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে জরিমানা হিসেবে আদায় করা হয়েছে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা৷
আর বিভিন্ন বাজারে অভিযানের সময়ে জরিমানা হিসেবে আদায় করা হয়েছে ১০২ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা৷ এ দুটি খাত মিলিয়ে জরিমানার মোট পরিমাণ ১০৮ কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা৷
ভোক্তাদের মধ্যে ৮ হাজার ১৯৭ জন অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ১ কোটি ৪৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা৷
ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভোক্তাদের কাছ থেকে ১৬ হাজার ৫৪টি অভিযোগ পেয়ে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১১ হাজার ৪৮৭টি বা ৭১ দশমিক ৫৫ শতাংশের৷
নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগের মধ্যে ৬২১টি প্রতিষ্ঠান বা ৫ দশমিক ৪০ শতাংশকে জরিমানা করা হয়েছে, যার অর্থের পরিমাণ ৪৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা৷