ক্রেতা সুরক্ষা আদালত ভারতে ভোক্তাদের অধিকার অনেকটাই নিরাপদ করেছে৷ তবে এখনো অনেক পথ চলার বাকি৷
বিজ্ঞাপন
বছর পাঁচ-ছয় আগের কথা৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রী তখন প্রয়াত সাধন পাণ্ডে৷ মন্ত্রী মহোয়দয়ের সঙ্গে দহরম মহরম না থাকলেও সাংবাদিক হিসেবে সুসম্পর্ক ছিল৷ এক ব্যক্তিগত দরকারে পরামর্শ চাওয়ার জন্য ফোন করতে হয়েছিল তাকে৷ ওই ফোনকলের দিনকয়েক আগে একটি অনলাইন অ্যাপে একটি ইলেকট্রনিক গেজেট অর্ডার দিয়েছিলাম৷ জিনিসটি দ্রুত পৌঁছালেও ঠিকমতো কাজ করছিল না৷ অনলাইনে কেনার ফলে কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগও করে ওঠা যাচ্ছিল না৷ অগত্যা, সরাসরি ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রীরই দ্বারস্থ হওয়া গেল৷ কী করা উচিত?
মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মন্ত্রী পরামর্শ দিলেন, ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে গিয়ে অভিযোগ জানাতে৷ ভরসা দিলেন, মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই অতি দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্যরকম হয়নি৷ সত্যিই একমাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়৷ ইলেকট্রনিক গেজেটটি বদলে নতুন গেজেট পাঠিয়ে দেয় কোম্পানিটি৷
১৯৮৬ সালে ক্রেতা সুরক্ষা আইন তৈরি হয় ভারতে৷ ২০১৯ সালে আইনটির সংশোধন হয়৷ এই আইনের বলে ভারতে মূল আদালতের কাঠামোর বাইরে তৈরি হয়েছে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত৷ ভোক্তা সেখানে গিয়ে ক্রয় করা জিনিস নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারে৷ ক্রেতার অধিকার নিয়ে মামলা করতে পারে৷
প্রায় ১৪০ কোটির দেশে মূলস্রোতের আদালতে কী পরিমাণ চাপ, তা সকলেই জানেন৷ দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলার চাপ বিপুল৷ আগে ক্রেতার অধিকার সংক্রান্ত মামলার চাপও এই আদালতকেই সামলাতে হতো৷ কিন্তু ক্রেতা সুরক্ষা আদালত তৈরি হওয়ার পর বিষয়টি সহজ হয়েছে৷ শুধুমাত্র ক্রেতার সমস্যা নিয়ে তৈরি হওয়া আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হয় দ্রুত৷ অভিযুক্ত আদালতের নির্দেশ না মানলে তাকে গ্রেপ্তারও করা যেতে পারে৷
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী দীপাঞ্জন দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘গত কয়েক দশকে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত সত্যিই খুব দ্রুত উন্নতি করেছে৷ মানুষ এই আদালতে উপকার পাচ্ছে৷ যত দিন যাচ্ছে, ক্রেতারা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছেন৷'' দীপাঞ্জনের বক্তব্য, এই ধরনের আদালতে যাওয়ার জন্য উকিলের মর্জির উপরও নির্ভর করতে হয় না ক্রেতাদের৷ এই আদালতের নিয়ম-কানুনও সহজ৷ ভোক্তা খুব সহজে নিজে নিজেই মামলা ফাইল করতে পারেন৷
দীপাঞ্জনের সঙ্গে সহমত কলকাতা হাইকোর্টের আরেক আইনজীবী প্রসিত দেব৷ ক্রেতা সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাজ করেছেন৷ প্রসিতের বক্তব্য, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত থেকে মানুষ যে উপকার পাচ্ছেন, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু তার মতে, ‘‘উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সমাজের একটি অংশ এই ধরনের প্রকল্পের লাভ পাচ্ছেন৷ সাধারণ মানুষ এখনো ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের বিষয়ে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নয়৷ আর বাজারে তারাই সবচেয়ে বেশি ঠকেন৷'' প্রসিতের মতে, বিষয়টি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার, সেটা করতে পারলেই প্রকল্পটির স্বার্থকতা৷
বস্তুত, গত কয়েক দশকে একাধিক আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে৷ ভারতে সাহারার মতো চিটফান্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে সারদা, রোজভ্যালি৷ এর কয়েকটি মামলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে গিয়েছিল৷ আদালত রায়ও দিয়েছিল৷ কিন্তু পরে কলকাতা হাইকোর্ট এই বিষয়ে সমস্ত মামলার দায়িত্ব নির্দিষ্ট কমিশনের হাতে তুলে দেয়৷
আইনজীবীদের অনেকেরই বক্তব্য, এখনো গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন নামে এই ধরনের চিটফান্ড কাজ করছে৷ মানুষ সেখানে টাকা ঢালছেন, ঠকছেনও৷ কিন্তু ক্রেতা সুরক্ষা আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না৷ তারা জানেনই না এমন আদালতের কথা৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে না তুললে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি সফল হবে না৷
ফেরা যাক সাধন পাণ্ডের কথায়৷ ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার পর এক আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, মন্ত্রিসভার অনেক পদের চেয়ে এই পদটি দেখতে ছোট লাগে৷ ততটা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নয়৷ কিন্তু কাজ করতে পারলে এই দপ্তরের মন্ত্রী সবচেয়ে বেশি মানুষের হৃদয় জয় করে ফেলতে পারেন৷ উপভোক্তার কাছাকাছি থাকতে পারা সবসময়ই ভালো৷
কথাটি যে সত্য, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷
ভোক্তা অধিকার ও প্রতারণা
পণ্য ও সেবা পেতে গিয়ে ভোক্তারা কী কীভাবে, কতটা প্রতারিত হন? অধিকার সম্পর্কে ভোক্তারা কতটা সচেতন? এসব বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শিখা রাণীর মাছ কেনা
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিখা রাণী তার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতারণার ঘটনা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে বাজার থেকে মাছ কিনি৷ দোকানি মাছের ওজন ১২০০ গ্রাম দেখিয়ে সে অনুযায়ী দাম নিলেও বাসার পাশের দোকানে মেপে দেখি ওজন ৯৫০ গ্রাম৷ এতে প্রায় ৫০ টাকা ক্ষতি হয়৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আসগর আলীর জমানো টাকা
ঢাকার শ্যামলীতে ভ্রাম্যমাণ ফুটপাথ দোকানি আসগর আলী জানান, তিনি যে বস্তিতে থাকেন, সেখানে একটি সমবায় সমিতিতে লাভের আশায় মাসিক ভিত্তিতে কিছু টাকা জমা রাখা শুরু করেন৷ প্রায় ১৫ হাজার টাকা জমা করার পর জানতে পারেন সেই সমবায় সমিতি ভুয়া, গ্রাহকদের কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তারা পালিয়ে গেছেন৷তিনি মনে করেন এতে ভোক্তা হিসেবে প্রতারিত হয়েছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আব্দুর রহমানের বাড়তি ভাড়া
পরিবারসহ ঈদের ছুটি শেষে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসেন মুদি দোকানি আব্দুর রহমান মোল্লা৷ তিনি জানান, তিনি যে পরিবহণে আসেন, সেখানে তার সাথে জনপ্রতি ৩৫০ টাকায় ভাড়া ঠিক হয়৷ কিন্তু পাশের সিটের সহযাত্রীর সাথে কথা বলে জানতে পারেন তার সাথে ৩০০ টাকায় ভাড়া ঠিক হয়েছে৷ তার প্রশ্ন, ‘‘এসব প্রতারণা দেখবে কে?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মিথ্যা অভিযোগে ঠকলেন সোহেল
ঢাকার গাবতলি বাস টার্মিনালের মেকানিক সহযোগী সোহেল আহমেদ বলেন, ‘‘এর আগে যাত্রাবাড়ীতে এক গ্যারেজে কাজ করতাম, সেখানে ৩ মাসের বেতন পাওনা ছিল৷ একদিন মালিক তার মোবাইল চুরির দায়ে আমাকে মিথ্যাভাবে ফাঁসিয়ে বেতন না দিয়েই চাকরি থেকে বের করে দেয়৷ আমি অনেক কান্নাকাটি করেও তার মন গলাতে পারিনি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সুফিয়ার সন্তানের চিকিৎসা
ঢাকার দনিয়ার বাসিন্দা সুফিয়া বেগম তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, জন্মের পরপরই শিশুটির জন্ডিস ধরা পড়ে৷ স্থানীয় এক বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হলে তারা সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করছিল এবং টাকার অঙ্ক বাড়াচ্ছিল৷ এদিকে বাচ্চার অবস্থা অবনতি হওয়ায় আত্মীয়দের পরামর্শে বাচ্চাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ এখন বাচ্চা অনেকটাই সুস্থ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফল কিনে ঠকলেন জব্বার
ঢাকার কারওয়ানবাজারে তালা-চাবির মিস্ত্রী জব্বার মন্ডল জানান, গত ঈদে তিনি লঞ্চে করে ভোলায় শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যান৷ যাওয়ার সময় বিভিন্ন ফলমূল কিনে নেন লঞ্চঘাট থেকেই৷ বাড়িতে নিয়ে দেখেন, এর অধিকাংশই পচা ও নষ্ট৷ তিনি বলেন, এমন বাজে অভিজ্ঞতা তার পরিচিত আরো অনেকেরই আছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আহমেদুলের দু’বার ‘দণ্ডি’
একটি ব্যাংকে পিয়ন হিসেবে কর্মরত আহমেদুল ইসলাম জানান, কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে যান এই ভেবে যে, চেকারের কাছ থেকে টিকিট কিনবেন৷ পরে ট্রেনে কোচ অ্যাসিস্টেন্ট তার কাছ থেকে টাকা নেন, কিন্তু কোনো টিকিট দেন না৷ পরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নামলে গেইটে আবারো তার কাছ থেকে জরিমানাসহ টিকিটের টাকা নেয়া হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাশুকের ইন্স্যুরেন্স অভিজ্ঞতা
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক মাশুক শাহরিয়ার বলেন, মিল্কভিক হেলথ লিমিটেড নামের এক হেলথ ইন্সুরেন্স কোম্পানি চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে ‘ক্যাশ ব্যাক অফার’ সহ নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়৷ কিন্তু সেখানে রেজিস্ট্রেশন করার পর জানা যায়, তাদের নানারকম শর্তের কথা৷ এমনকি সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও কেটে নেয় তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সালেহার জামা বিড়ম্বনা
ঢাকার মিরপুর ১৩ নম্বরের মিডএশিয়া গার্মেন্টসের কর্মী সালেহা খাতুন বলেন, গত রোজার ঈদে তিনি তার মেয়ের জন্য গুলিস্তানের একটি দোকান থেকে জামা কেনেন৷ কেনার সময় জামা মাপে না হলে তা বদলে দেবার কথা থাকলেও পরে দোকানদার কথা রাখেননি৷ টাকাও ফেরত দেননি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন প্রতারণার শিকার সৈকত
একটি পণ্য ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান সৈকত ইসলাম বলেন, ৩ মাস আগে অনলাইনে তিনি একটি হেডফোন কেনেন৷ পণ্যটি গ্রহণ করার পর দেখা যায় সেটি নষ্ট৷ পরে সেই অনলাইন পেজে এটি নিয়ে অভিযোগ জানালে তারা দুর্ব্যবহার করেন এবং পেজ থেকে ব্লক করে দেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পণ্য কিনে লাঞ্ছিত নাসির
একটি বিদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাসির উদ্দিন জানান, ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে গতমাসে তিনি একটি স্মার্টফোন কেনেন৷ ৭ দিনের মধ্যে বড় সমস্যা হলে সেটি পালটে দেবার কথা ছিল৷ কেনার ৩ দিনের মধ্যেই সমস্যা দেখা দেয়৷ কিন্তু তিনি দোকানে নিয়ে গেলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা
ফেসবুকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পেজে শত শত অভিযোগ দেখা যায় ভুক্তভোগীদের৷ সেখানে সাব্বির আহমেদ নামের একজন মন্তব্য করেন, ‘‘এনারা ভালো কাজ করলেও জনবল যথেষ্ট নয়৷ দেশের আনাচেকানাচে প্রতি পদে যারা প্রতারণা করছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত৷’’