কোনো প্রাণীর দেহকোষ থেকে হুবুহু সেই জীবটিকে আবারো তৈরি করার পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘ক্লোনিং’৷ ভারতীয় ভোটযুদ্ধে প্রার্থীদের এভাবে ‘ক্লোন’ করা না হলেও, প্রতিপক্ষকে কাবু করতে ‘গোঁজ’ প্রার্থী নামানোর চল কিন্তু নতুন নয়৷
বিজ্ঞাপন
কথায় আছে প্রেমে ও রণে কোনো পন্থাই অন্যায় নয়৷ ভোট যুদ্ধে ভারতের মতো দেশে কৌশলে প্রতিপক্ষকে আটকাতে গোঁজ প্রার্থী নামানোর রেওয়াজ নতুন কিছু নয়৷ সাধারণত, যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা থাকলে একে অপরের ভোট কাটতে এই গোঁজ প্রার্থী নামানো হয়৷ মানে শক্তিশালী প্রার্থীর নামের সঙ্গে মেলে এমন বেশ কয়েকজন প্রার্থী নামানো হয়৷ একই নামের এই সব গোঁজ প্রার্থীর লক্ষ্য ভোটে জেতা নয়, বিপক্ষ প্রার্থীর ভোট কেটে তাঁকে হারানো৷ প্রতিবারের মতো ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ তবে আধুনিক ভারতে এদের আর ‘গোঁজ' প্রার্থী নয়, বলা হচ্ছে ‘ক্লোন ক্যান্ডিডেট'৷
ভারতের নির্বাচন ২০১৪
ভারতে একমাসেরও বেশি সময় ধরে নয় দফায় ভোটগ্রহণ হবে৷ ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ৷ ভোট গণনা হবে ১৬ মে৷ ৮০ কোটি ভোটার এই নির্বাচনে অংশ নেবেন৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
জনগণের সরকার
ভারতের সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর৷ পার্লামেন্টে দুটি কক্ষ রয়েছে৷ উচ্চকক্ষকে বলা হয় রাজ্যসভা আর নিম্নকক্ষ লোকসভা হিসেবে পরিচিত৷ নিম্নকক্ষে যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তারাই দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে৷
ছবি: AP
দৌড়ে এগিয়ে
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে৷ তবে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পথটা নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে৷ কেননা ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গার কারণে যুক্তরাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদীকে বয়কট করেছে৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেস নেতা
দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেসের হাল ধরা সোনিয়া গান্ধী এবার দলের দায়িত্বের বোঝা তুলে দিয়েছেন নিজ পুত্র রাহুল গান্ধীর কাঁধে৷ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রপৌত্র, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী পৌত্র এবং সবচেয়ে কমবয়সি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে রাহুল৷ কিন্তু গত ১০ বছর ধরে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থেকেও সেখানে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুর্নীতি বিরোধী নেতা
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির রাজ্যসভা নির্বাচনে অভিষেক হয় দুর্নীতি বিরোধী দল আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের৷ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘কিং মেকার’ দল
বামপন্থি চারটি দল এবং সাতটি আঞ্চলিক দল মিলে থার্ড ফ্রন্ট গঠন করেছে, যা বিজেপি এবং কংগ্রেসের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ লোকসভায় এখনই তাদের আধিপত্য আছে৷ ঝুলন্ত পার্লামেন্টের সম্ভাবনা থাকলে তারা হয়ে উঠতে পারে ‘কিং মেকার’৷ অর্থাৎ তারা যে দল সমর্থন করবে তারাই গঠন করবে সরকার৷
ছবি: Sajjad HussainAFP/Getty Images
সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকা
এ বছর নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে৷ এটিকে নির্বাচনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে কোনো দলই পিছিয়ে নেই৷ এ বছর প্রথম ভোট দেবেন এমন মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি৷ এদের মধ্যে ৪০ ভাগ শহরে বাস করে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সক্রিয়৷ ফলে নতুন এই প্রজন্ম এবারের নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখছে৷
মেশিনের মাধ্যমে ভোট
লোকসভার ৫৪৫ টি আসনের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভারতের মানুষ ভোট দেবেন ৫ সপ্তাহ ধরে৷ ইলেকট্রনিক মেশিন পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ চলবে৷ ফলাফল জানা যাবে ১৬ মে৷
ছবি: AP
সংখ্যালঘুদের উপর নির্ভরশীলতা
ভারতে ১৩ শতাংশ ভোটদাতা মুসলিম৷ ১০০টি সংসদীয় কেন্দ্রে ১৫-২০ শতাংশ, ৩৫টি কেন্দ্রে ৩০ শতাংশ এবং ৩৮টি আসনে মুসলিম ভোটদাতাদের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো৷ কাজেই আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম ভোটবাক্স নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছেন ভোট বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নমো’ উন্মাদনা
যখন থেকে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীকে (নমো) তাদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়; তখন থেকেই সে দেশের গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্র্যান্ড হিসেবে ‘নমোকে’ তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়৷ বিজেপির প্রচার-কুশীলবদের রি-ব্র্যান্ডিং অভিযানের তোড়ে নৈতিকতার প্রশ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷
ছবি: Sam Panthaky/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
ভারতের পশ্চিমী রাজ্য মহারাষ্ট্রের মাভালে এবার এমনটাই ঘটেছে৷ একই নামের পাঁচ জন প্রার্থীর মধ্যে দু'জন আসল প্রতিদ্বন্দ্বী, বাকি তিনজন গোঁজ প্রার্থী৷ আসল প্রার্থীর একজনের নাম শ্রীরঙ বার্ণে৷ ইনি ভারতীয় জনতা দলের জোটসঙ্গি শিবসেনা দলের৷ তাঁর প্রতিপক্ষ হলেন কংগ্রেসের নির্বাচনি জোটসঙ্গি কৃষক-মজদুর পার্টির প্রার্থী লক্ষণ জগতাপ৷ ব্যালট পেপারে কিন্তু আছে পাঁচজন প্রার্থীর নাম৷ আর তাঁদের নামের পাশে আছে নিজ নিজ দলের নির্বাচনি প্রতীক চিহ্ন৷
নিরক্ষর ভোটাররা সাধারণত প্রতীক চিহ্ন দেখেই তাঁর মনোনীত প্রার্থীকে চিনে ভোট দিয়ে থাকেন, নাম পড়তে না পেরে৷ যেমন শিবসেনা দলের প্রার্থী বার্ণের প্রতীক চিহ্ন তীর-ধনুক৷ সেখানে এক গোঁজ প্রার্থীর প্রতীক চিহ্ন শুধু তীর৷ বিভ্রান্ত এক অশিক্ষিত গ্রাম্য ভোটার তীর ধনুকের বোতাম না টিপে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে শুধু তীর চিহ্নের বোতাম টেপেন৷ পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে পোলিং অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘ভুলটা শোধরাতে গেলে কী করতে হবে?'' আবার অপর একজন ভোটার তাঁর পছন্দের প্রার্থী আসল জগতাপের নির্বাচনি প্রতীক চিহ্নটা চিনিয়ে দিতে অনুরোধ করেন পোলিং অফিসারকে৷ কিন্তু এটা আইন বিরুদ্ধ সেটা কে বোঝাবে?
তরুণ ভোটার টানতে অভিনব উদ্যোগ
ভারতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে যেন তরুণরা ভোট দিতে যায় সেজন্য অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেদেশের সরকার৷ ছবিঘরে থাকছে সে কথাই৷
ছবি: DW/B. Das
১৬তম লোকসভা নির্বাচন
আগামী ৭ তারিখ থেকে ভারতে ১৬তম লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে৷ প্রায় ৮০ কোটি ভোটার এবার ভোট দেবেন৷ ২০০৯ সালের চেয়ে সংখ্যাটা প্রায় ১০ কোটি বেশি৷
ছবি: DW/B. Das
প্রথমবার ভোটার ২.৩ কোটি
এবার প্রায় ২.৩ কোটি তরুণ প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন৷ এদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করাকে নিজেদের একটা অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন৷
ছবি: DW/B. Das
তরুণদের উৎসাহ দিতে
তরুণদের ভোট দিতে যেতে উৎসাহিত করতে ভারতের সরকার ২০১০ সালে ‘সিস্টেমেটিক ভোটারস এডুকেশন অ্যান্ড ইলেকটোরাল পার্টিসিপেশন’ বা এসভিইইপি নামে একটি প্রকল্প চালু করে৷ এর আওতায় জানুয়ারির ২৫ তারিখে ‘ন্যাশনাল ভোটারস ডে’ উদযাপন করা হয়৷
ছবি: DW/B. Das
দেয়ালচিত্র
এটি উত্তরপূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং এর একটি দেয়াল যেখানে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে৷
ছবি: DW/B. Das
আরও উদ্যোগ
শিলং-এর একজন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তরুণদের আকৃষ্ট করতে সৃষ্টিশীল সব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে৷ এর মধ্যে রয়েছে রচনা লেখা, ছবি আঁকা, বিতর্ক ও ধাঁধা প্রতিযোগিতার আয়োজন৷ রয়েছে দেয়ালচিত্র আঁকা, নৃত্য, গান, স্লোগান ও জিঙ্গেল তৈরি, ‘রান ফর ডেমোক্রেসি ম্যারাথন’ ইত্যাদি৷
ছবি: DW/B. Das
অন্যদের কাছ থেকে উৎসাহ পাওয়া
দেয়ালচিত্র অংকন শিল্পী কারিন জপলিন লাংসটিহ বলেন, ‘‘জার্মানি সহ অন্যান্য দেশের স্ট্রিট আর্টওয়ার্ক দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি৷ স্থানীয় বিষয় যেমন ঐতিহ্যবাহী পোশাক, গ্রামের বাস এসব জিনিসকে আমরা দেয়ালচিত্রে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি৷’’
ছবি: DW/B. Das
সব ভোটই গোনা হয়
এত সব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন তরুণ ভোটারদের যে বার্তা দিতে চায় সেটা হচ্ছে ‘সব ভোটই গোনা হয়৷’
ছবি: DW/B. Das
7 ছবি1 | 7
আসলে ভোটে জেতার জন্য এঁরা নামেন না বা নামানো হয় না৷ নামেন বিরুদ্ধ দলের প্রার্থীর ভোট কাটতে৷ ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে৷ বিশেষ করে যেসব কেন্দ্রে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা থাকে৷ মহারাষ্ট্রের মাভাল সংসদীয় কেন্দ্রে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ১৯ লাখের মতো৷ কিছু ভোট গোঁজ প্রার্থীদের ঝুলিতে গেলেও ভোটের ফলাফলে তার প্রভাব পড়ে, জানালেন মাভাল কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোহন কাডু৷ তবে আসল প্রার্থীরা কিন্তু এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ৷
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের বৃহত্তম নির্বাচনি প্রক্রিয়া গোটা দুনিয়ায় প্রশংসিত৷ প্রশ্ন হলো: ভোট পন্ডিতরা ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বচনকে কী চোখে দেখছেন? তাঁরা মনে করেন, ভারতের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে বিজেপির মোদী, কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী এবং আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ত্রিমুখী লড়াইয়ের মাধ্যমে, ১৬ই মে৷ কে জয়ী হবে? ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি হিন্দু জাতীয়তাবাদ? মুক্ত বাজার অর্থনীতি নাকি সমাজতন্ত্রবাদ? বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর সুশাসন এবং উন্নয়নের স্লোগান কতটা বাস্তবায়িত হবে – সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়৷ তবে পরিবর্তন যে একটা হবে সেবিষয়ে সন্দেহ নেই৷