পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট যত কাছে আসছে, রাজনৈতিক তরজাও তত বাড়ছে। সম্প্রতি দুটি জনপ্রিয় গানের প্যারোডি বানিয়েছে সিপিএম এবং বিজেপি। সেই নিয়ে সরগরম রাজ্য রাজনীতি।
বিজ্ঞাপন
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির লেখা কয়েকটি গান ব্যাপকভাবে প্রচারে জায়গা করে নিয়েছিল। এবার ভোটের আগে সেই ধরনের সুরেলা প্রচার এখনো শুরু করেনি তৃণমূল। কিন্তু ভোটের বাজার সরগরম সিপিএম–এর বানানো ‘টুম্পা সোনা’ গানটির প্যারোডি নিয়ে। এই ‘টুম্পা সোনা’ সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি গান। তার প্যারোডি প্রত্যাশামতোই লোকের কাছে পৌছে যাচ্ছে, যেখানে চাকরি না পেয়ে, পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করতে না পেরে হতাশ এক বাঙালি যুবক তার বান্ধবী টুম্পাকে বলছে, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বামফ্রন্টের সমাবেশে জোট বেঁধে যোগ দিতে। কার্টুন ছবি দিয়ে বানানো ভিডিওটিতে বিজেপি এবং তৃণমূলকে সমধর্মী বলে কটাক্ষ করে, বামেরাই যে একমাত্র বিকল্প, সেকথা বলা হয়েছে।
টুম্পা সোনা-কে যদি মানুষ রাখে, থাকবে: কঙ্কন ভট্টাচার্য, বামপন্থি গণসংগীত শিল্পী
যদিও বামপন্থিদের একাংশ টুম্পা সোনার মতো একটি চটুল গানকে এভাবে রাজনৈতিক প্রচারে জড়িয়ে নেওয়ায় ক্ষুব্ধ। অনেকেই বলছেন, বামপন্থিদের গণসংগীত যেখানে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরিদের ঐতিহ্য এবং মর্যাদার উত্তরাধিকার বহন করছে, সেখানে এই গান বামপন্থার সম্মানহানি করছে। কোনো কোনো বাম নেতা অবশ্য বলছেন, গান, সে যে রকমের গানই হোক, তা যদি মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতে পারে, তা হলে ছুঁৎমার্গ থাকা উচিত নয়।
টুম্পা সোনার প্যারোডি আদৌ মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারবে কিনা, সে প্রসঙ্গে বিশিষ্ট বামপন্থি গণসংগীত শিল্পী কঙ্কন ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘কোনো শিল্পকর্ম জোর করে টিকিয়ে রাখা যায় না। যেটা থাকার, সেটা এমনিই থাকে। যেটা যাওয়ার, সেটা চলে যায়। এটা মুহূর্তে বিচার করা খুব মুস্কিল। এটা একদিন থাকবে, দুদিন থাকবে, না ভবিষ্যতেও থাকবে, সেটা সময়ই বলবে।’’ এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সুরকার, ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘হেই সামালো ধান হো', ইত্যাদি বহু যুগোত্তীর্ণ গানের স্রষ্টা, প্রয়াত সলিল চৌধুরির একটা কথা স্মরণ করেছেন কঙ্কন, যে যে গানের সঙ্গে দেশের মাটির যোগ আছে, সেই গানই থাকে, কালজয়ী হয়।
ফ্যাসিজম বিরোধী গান গাওয়ার সত্ব কি শুধু বামপন্থিদের: শমীক ভট্টাচার্য, বিজেপি নেতা
এদিকে বিজেপি বিখ্যাত প্রতিবাদের গান ‘বেলা চাও’–এর সুরে একটি গান বেঁধেছে— পিসি যাও। পিসি বলতে এক্ষেত্রে অবশ্যই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, যিনি তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির সম্পর্কে পিসি, যে অভিষেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। এখন যখন অভিষেকের স্ত্রী এবং শ্যালিকার বাড়িতে অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখা অভিযান চালাচ্ছে, তখন এই গানটি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। কিন্তু উত্তর ইটালির কৃষিশ্রমিকদের যে গান একসময় ইটালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ–বিরোধী আন্দোলনের স্লোগান হয়ে উঠেছিল, সেই গান কী করে বিজেপি গ্রহণ করতে পারে? বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী গান গাইবার অধিকার, তার ইজারা, বা পুরো সত্বটাই কি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থিরা নিয়ে ফেলেছেন? এখন তো তারা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক এবং অপাংক্তেয় যে, শেষ পর্যন্ত তাদের কৃত্রিম গাম্ভীর্য ছেড়ে টুম্পা সোনাকে আঁকড়ে ধরেছেন!’’ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, যে কোনো গানেরই প্যারোডি হতে পারে। তার বিরোধিতা করলে সৃজনশীলতারই বিরোধিতা করা হয়।
এই গানের লড়াইয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের এখনও অংশ নেওয়া বাকি। কবীর সুমন, ইন্দ্রনীল সেন, নচিকেতার মতো বড় মাপের গায়ক যে দলে, তারা এবার পাল্টা কোন সুরে শান দিচ্ছে, অনেকেই এখন সেদিকে তাকিয়ে আছে।
১৮ ফেব্রুয়ারির ছবিঘরটি দেখুন...
পশ্চিমবঙ্গের ভোটে কে কোথায় দাঁড়িয়ে
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট আসন্ন। হাই-ভোল্টেজ লড়াইয়ে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূল ও বিজেপি। বাম-কংগ্রেস কি কিছু করতে পারবে?
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
ভোটের দামামা
এপ্রিল-মে মাসে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা পশ্চিমবঙ্গে। সব দলই প্রচারে নেমে গেছে। প্রধান দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূল এবং বিজেপি। তবে যত দিন যাচ্ছে, শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে বাম এবং কংগ্রেস।
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
তৃণমূলের জোর
২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। সেই থেকে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক নির্বাচনে ৪০ শতাংশের উপরে ভোট পেয়েছে তারা। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ আসন পেয়েছিল তৃণমূল।
ছবি: Getty Images/D. Sarkar
বিজেপির শক্তি
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠে। তারাও ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। এবারের নির্বাচন ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে বিজেপি। রাজ্য জুড়ে চলছে রথযাত্রা।
ছবি: Payel Samanta/DW
ধর্মীয় মেরুকরণের নির্বাচন
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে এবার ধর্মীয় মেরুকরণের নির্বাচন হবে। বিজেপি ধর্মীয় তাস খেলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার উত্তর দিতে গিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ বৃদ্ধি করছেন।
ছবি: Imago Images/Pacific Press Agency/S. Paul
শাহ-মোদীর লক্ষ্য
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে পশ্চিমবঙ্গের রণনীতি তৈরি করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। ৪০টিরও বেশি সভা করেছিলেন তাঁরা। এবারের ভোটেও একই ভাবে প্রচারের পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় নেতাদের এনে প্রচারের ঝাঁজ বাড়াতে চাইছে তারা। সঙ্গে চলছে তৃণমূলের নেতাদের বিজেপিতে নিয়ে আসার কাজ।
ছবি: Dibyangshu Sarkar/AFP/Getty Images
বারবার আসছেন শাহ
অমিত শাহ এখন বারবার পশ্চিমবঙ্গে আসছেন। ভোটের দিন ঘোষণার আগে তিনি প্রচারের জমি তৈরি করছেন। পরে মোদী প্রচারের ঝড় তুলবেন। আসছেন নাড্ডাও। তাছাড়া অন্য রাজ্যের নেতাদেরও নিয়ে আসা হবে পশ্চিমবঙ্গে।
ছবি: Payel Samanta/DW
রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি ও বাঙালিয়ানা
মোদী, শাহ, নাড্ডার মুখে বারবার শোনা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজির নাম। উঠে আসছে বাংলা ও বাঙালিয়ানার প্রশংসা। তৃণমূল লড়াইটাকে বাঙালি বনাম অ-বাঙালিতে পরিণত করার চেষ্টা করছিল। তার জবাবে, বাঙালি-প্রেম দেখাতে চাইছেন মোদী-শাহরা।
ছবি: DW/P. Samanta
মমতার পাল্টা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই একশ। রাজ্য জুড়ে সভা শুরু করে দিয়েছেন তিনি। নির্বাচন স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোর সময় সময় পরামর্শ দিচ্ছেন মমতাকে। গত কয়েক মাসে দুয়ারে সরকার এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যবীমা জনমনে সাড়া ফেলেছে।
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বাম-কংগ্রেস জোট
কংগ্রেস এবং বামের ভোট গত ১০ বছরে চোখে পড়ার মতো কমেছে। ২০১৬ সালে তাদের জোট বিশেষ কাজে আসেনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০২১ সালে তাদের জোট আগের চেয়ে ভালো ফল করবে। বিজেপি এবং তৃণমূলের ভোট বাম-কংগ্রেস জোট সমান ভাবে কাটতে পারলে ফলাফলে তার যথেষ্ট প্রভাব পড়বে।
ছবি: Zumapress/Imago Images
সমীক্ষার ফলাফল
এখনো পর্যন্ত যতগুলি ভোটের আগের সমীক্ষা হয়েছে, তাতে অল্প হলেও এগিয়ে আছে তৃণমূল। তবে বিজেপি ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। প্রশান্ত কিশোরের স্ট্র্যাটেজি কি তৃণমূলের ভোট-মার্জিন বাড়াতে পাড়বে?
ছবি: Hindustan Times/Imago Images
আসরে ফুরফুরা শরিফ
এরই মধ্যে ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি নিজের দল তৈরি করেছেন। তিনি বিজেপি এবং তৃণমূল কাউকেই সমর্থন করছেন না। বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের আলোচনা চলছে।