আর কয়েকদিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন কমিশন লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ প্রকাশ করবে৷ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে প্রচার৷ নির্বাচনি উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দামও বাড়ছে৷ দৌড়ে সবার আগে ছুটছে মুরগি৷

মুরগির ট্রিপল সেঞ্চুরি!

ঘরে-বাইরে মুরগির মাংস এখন প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাবার৷ গৃহস্থের হেঁশেল থেকে স্ট্রিট ফুড বা নামজাদা রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে বেশি চাহিদা মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি খাদ্য সামগ্রীর৷ সেই মুরগির মাংসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে নজির সৃষ্টি করেছে৷

সাধারণভাবে জেলায় চিকেনের দাম প্রতি কেজি ২০০ টাকার মধ্যেই থাকে৷ কলকাতা ও তার লাগোয়া এলাকায় প্রতি কেজিতে এই দাম ২০ টাকার মতো বেশি দেখা যায়৷ কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকেই দাম বাড়তে শুরু করেছে৷

গত মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় এক কেজি মুরগির দাম ছিল ২৩০ টাকার আশেপাশে৷ গত সাত দিনে মুরগির দাম পৌঁছে গিয়েছে ট্রিপল সেঞ্চুরির দোরগোড়ায়৷ অর্থাৎ প্রায় তিনশ টাকায়৷

গত এক সপ্তাহে ধরে প্রায় রোজই মুরগির মাংসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে৷ কলকাতার অভিজাত বাজারে প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকা দরে৷ কোথাও আবার একেবারে ৩০০ টাকা৷ জেলায় দাম একটু কম হলেও তা ২৫০ টাকা পার হয়েছে৷

মাংসের দাম বাড়ার সাথে মাছও সঙ্গ দিচ্ছে৷ রুই, কাতলা, ভেটকি, চিংড়ি সহ নানা মাছের দাম বিয়ের মরশুম চলায় এমনিতেই চড়া৷ বিভিন্ন বাজারে এই মাছের দাম প্রতি কেজিতে ২৫০ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে৷

দাম বাড়ার এই বিষয়টির সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিচ্ছেন উত্তর দিনাজপুরের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী সন্দীপ তরফদার৷ ডিডাব্লিউকে এই ব্যবসাযী বলেন, ‘‘এই সময়টা মুরগিতে মড়ক লাগে৷ মুরগি মরে যায়৷ ফলে যোগান কমে৷ ভোট সামনে এলে আবার চাহিদা অনেকটা বাড়ে৷ রাজনৈতিক দলের সভা থাকলে অনেক বেশি অর্ডার আসে৷ এছাড়া সামনে দোলযাত্রা, সব উৎসবের মুখে দাম বাড়ে৷’’

মুরগি পালনের খরচও বেড়েছে বলে দাবি পোল্ট্রি সংগঠনের৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মদন মাইতি বলেন, ‘‘মুরগির খাবার হিসেবে ভুট্টার দানা লাগে৷ এই দানা ইথানল শিল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে৷ ফলে দানার দাম বেড়েছে৷ এতে মুরগি পালনের খরচও বেড়ে গিয়েছে৷’’

সবজির দাম

পশ্চিমবঙ্গের মাঠে মাঠে এখন আলু চাষিদের ফসল তোলার সময়৷ হিমঘরগুলির দরজা খোলা, বাজারেও আলুর যোগান পর্যাপ্ত৷ কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে আলুর দাম একটু একটু করে বাড়ছে৷ আলু যেখানে প্রতি কেজিতে ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, তা গত কয়েকদিনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ টাকা৷

গত মাসে রসুনের দাম কেজি প্রতি ৫০০ টাকায় গিয়ে পৌঁছেছিল৷ যদিও তা এখন কমতে কমতে ২০০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ পেঁয়াজ, টমেটো ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে৷ অন্যান্য শাক সবজির দাম অবশ্য মোটের উপর নাগালের মধ্যে আছে৷

এই দামের উল্লেখ করে ফোরাম অব ট্রেডার্স অর্গানাইজেশনের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ কোলে ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘গত মাসে কাঁচা সবজির দাম বেড়েছিল৷ কিন্তু এখন তা কমে এসেছে৷ মুরগির মাংসের দাম অনেকটা বেড়েছে৷ আমরা রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলছি যাতে, এই দামও নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা যায়৷''

বাজারে নতুন ওঠা সবজি, যেমন ঢেঁড়স, পটল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা এখনো মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে৷ এই প্রবণতা গ্রীষ্মের মুখে স্বাভাবিক বলেই দাবি ব্যবসায়ীদের৷ তারা বলছেন, যোগান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দাম কমে আসবে৷

ভোটের থাবা

প্রতি নির্বাচনের আগেই জিনিসপত্রের দামে বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়৷ প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও এই দাম বাড়ার পিছনে অন্যান্য কারণও থাকে৷

ফোরাম ফর ইনডিজেনাস এগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট-এর সাধারণ সম্পাদক চিন্ময় দাস বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা কোনো একটি জায়গায় এলে পণ্যের চাহিদা বাড়ে৷ তারা অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন৷ ফলে স্থানীয়ভাবে কোনো বাজারে দাম বৃদ্ধি হতে পারে৷’’

এর সঙ্গে থাকে মজুতদারির মাধ্যমে তৈরি করা কৃত্রিম সংকট৷ একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে পণ্য মজুত করেন৷

চিন্ময় বলেন, ‘‘এখন পণ্য মজুত করার ফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি হয়৷ এর ফলে দাম বাড়ে৷ ব্যবসায়ীরা মজুত করে রাখেন ভোটের পরে বিক্রি করবেন বলে৷ সেই সময় বেশি দাম পাওয়া যায়৷’’

এই ধরনের কালোবাজারি রোখার জন্য সরকার গঠিত টাস্ক ফোর্স রয়েছে৷ তার মাধ্যমে বাজারে বাজারে মাঝেমধ্যেই অভিযান চলে৷ রবীন্দ্রনাথ কোলে বলেন, ‘‘কালোবাজারি যাতে না হয়, সেজন্য নজরদারি থাকে৷ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’

কিন্তু তাতে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো সম্ভব হয় না সবসময়৷ আর তাই দাম কমে আসা পর্যন্ত বাড়তি টাকা খসে যায় গৃহস্থের পকেট থেকে৷

শনিবার দমদমে বাজার করতে আসা ব্যাঙ্ক কর্মী অপূর্ব ঘোষাল বলেন, ‘‘এখন তো বেশি দামে কিনতে হবে৷ সেই টাকা তো আমরা আর ফেরত পাব না! ফলে দাম কবে কমবে, সে দিকে তাকিয়ে আর কেউ বসে থাকে না৷’’

নির্বাচনের মুখে চাঁদা আদায়ের পরিমাণও বেড়ে যায় বরে  অভিযোগ রয়েছে৷ বিশেষ করে পণ্য পরিবহনকারী যান থেকে চাঁদা নেয়া হয়৷ এই বাড়তি খরচের বোঝা শেষমেশ বইতে হয় জনতাকেই৷ আবার নির্বাচন চলাকালীন যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ থাকায় পণ্য আমদানি, রপ্তানিও কমে যায়৷ এর ফলে যোগান পর্যাপ্ত থাকে না৷ যার অনিবার্য পরিণাম মূল্যবৃদ্ধি৷’’