1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

'ভোটের কাজে গোঁয়ার থেকে মাতাল সবার পাল্লায় পড়েছি'

গৌতম হোড়
১০ মে ২০২৪

ভোটগ্রহণের সময় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন প্রিসাইডিং অফিসার। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে তিনিই প্রধান।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট চলছে
সাত ধাপে লোকসভার নির্বাচন চলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত ভারতে।ছবি: Subhadip Basak/DW

ভারতের নির্বাচনে এমন দায়িত্বে নিজের আট বারের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা  ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক প্রিসাইডিং অফিসার দেবাশিস ভৌমিক।

ডয়চে ভেলে : কবে থেকে শুরু হয় প্রিসাইডিং অফিসারের কাজ?

দেবাশিস ভৌমিক : প্রিসাইডিং অফিসারের কাজ শুরু হয় ট্রেনিং থেকে। দিন ২০-২৫ বা একমাস আগে এই ট্রেনিং হয়। দুটো ট্রেনিং নিতে হয়। প্রথমটায় বলা হয় কী কাজ করতে হবে এবং কী কী কাজ করা যাবে না। দ্বিতীয় ট্রেনিংয়ে বলা হয়, কোন কোন কাগজ নিতে হবে, কীভাবে ফর্ম পূরণ করতে হবে, কীভাবে ইভিএম নিয়ে যেতে হবে, সিল করতে হবে, শান্তিপূর্ণ ভোট কীভাবে করতে হবে, অশান্তি হলে কোথায় জানাতে হবে। সেই সঙ্গে ইভিএম নিয়েও আলাদা ট্রেনিং হয়। ভোটের আগে মক পোল করা থেকে ভোট শেষ হয়ে গেলে সিল করে জমা দেয়া পর্যন্ত পুরো বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শেখানো হয়। সেই সঙ্গে প্রিসাইডিং অফিসারদের জন্য তৈরি করা হ্যান্ডবুকও দেয়া হয়, তাতে বিস্তারিতভাবে সবকিছু লেখা থাকে।

এরপর হাতেকলমে কবে থেকে কাজ শুরু হয়?

সেটা শুরু হয় ভোটের আগের দিন থেকে। আগেই আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কোথা থেকে ভোটের জিনিস সংগ্রহ করতে হবে, কোথায় জমা দিতে হবে। আমার সঙ্গে আর কারা টিমে থাকবেন। ভোটের আগের দিন সকাল দশটার পর পৌঁছে যেতে হয় ভোটের জিনিস সংগ্রহ করার কেন্দ্রে। সেখানেই গিয়ে জানতে পারি কোথায় ভোটটা নিতে যেতে হবে, অর্থাৎ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রটা কোথায়। সাধারণত প্রাইমারি স্কুল বা হাই স্কুলে ভোটগ্রহণ কেন্দ্র হয়। 

কী জিনিস নিতে হতো?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইভিএম মেশিন৷ সেটা নিতে হয়। যারা ভোট দেবেন, তাদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য শক্ত পিচবোর্ডের কভার নিতে হয়। এর সঙ্গে থাকে অসংখ্য কাগজপত্র ও খাম এবং সিল করার জিনিস।

এবার ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাবেন কী করে?

প্রত্যেকটা টিমের একটা নম্বর থাকে। ভোটের জিনিস সংগ্রহ করার পর জানিয়ে দেয়া হয় ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বাস আছে, নাকি গাড়ি বা অন্য কোনো যানবাহন। আমি তো অটো, ব্য়াটারি চালিত ভ্যান, টাটা সুমো গাড়ি, মিনিবাস, বাস, এমনকি লঞ্চেও গেছি। অটো করে অবশ্য গিয়েছিলাম পঞ্চায়েত ভোট করতে। একবার বিধানসভা নির্বাচনে সন্দেশখালিতে ভোটকেন্দ্র ছিল। বাস একটা জায়গা পর্যন্ত গেছিল। তারপর  চার কিলোমিটার রাস্তা ব্যাটারি চালিত ভ্যান রিক্সায় যেতে হয়েছিল। আরেকবার হিঙ্গলগঞ্জে যাওয়ার সময় ঘণ্টা দেড়েক লঞ্চে করে যেতে হয়েছিল। আসলে পুরোটাই নির্ভর করে কোথায় ভোটকেন্দ্র পড়েছে এবং সেখানে যাওয়ার রাস্তা কেমন, নদীতে সেতু আছে কিনা, এসবের উপর।

ভোটকেন্দ্রে তো পৌঁছালেন, এবার থাকবেন কোথায়?

ওই স্কুলেই থাকতে হতো। খালি ক্লাসরুমে একটা সতরঞ্চি পেতে, তার উপর চাদর বিছিয়ে, হাওয়া বালিশ নিয়ে শুতে হতো। এই সব জিনিসই আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হতো। লাইট-ফ্যান থাকলেও অনেক সময় অসুবিধা হতো। একবার তো আলো এত কম ছিল যে, আমাকে হ্যাজাকের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ফ্যান না থাকলেও চলবে, কিন্তু আলো না থাকলে তো ভোট নেয়া যাবে না। তাই হ্যাজাকের ব্যবস্থা করলাম।

আর বাথরুম... খাবার?

‘ছোট কাজ' ওই স্কুলের টয়লেটে সারা যেতো, তবে খুব দরকার না হলে ‘বড় বাথরুম' করতে যেতাম না। আর এখন কিছু স্বনিযুক্ত সংস্থা খাবার দেয়। আগে কাছাকাছি কোনো দোকান থেকে পালা করে খেয়ে আসতে হতো। তবে আমি ভোটের কাজে গেলে জল, ওআরএস, লেবুর সরবত আর শশা ছাড়া আর কিছু খেতাম না। স্নান বাইরে কলে করতে হতো। আমি সচরাচর করতাম না।

ভোটের আগের দিন কাজ করতে হতো?

অবশ্যই। প্রায় ঘণ্টা চার-পাঁচেকের কাজ থাকতো। এত লেখালেখি করতে হতো, ফর্ম ভরতে হতো, তাতে অতটা সময় লেগে যেতো। শুতে শুতে রাত একটা থেকে দুইটা বেজে যেতো। তারপর সকাল পাঁচটার মধ্যে উঠে পুরো টিমকে তৈরি হয়ে যেতো। আমাকে তারও আগে উঠে যেতে হতো। ছয়টার মধ্যে এজেন্টরা এসে যাবে। ভোট শুরুর আগে এজেন্টদের নিয়ে মক পোল করতে হতো। ইভিএম ততক্ষণে বসানো হয়ে গেছে। প্রত্যেক এজেন্টকে দেখাতে হয়, ইভিএম পুরো খালি। তারপর তারা প্রত্যেকে কোনো প্রতীকে কয়েকবার ভোট দেবে। তাদের এই ভোট দেয়া শেষ হলে, তারপর ইভিএমে দেখানো হয় কোথায় ক‘টা ভোট পড়েছে। এজেন্টরা সন্তুষ্ট হলেন। তারপর সেটা মুছে দেয়া হলো। মক পোল পর্বের শেষে ইভিএম আসল ভোটের জন্য প্রস্তুত। এবার ডিক্লারেশনের একটা ফর্ম থাকে। সেখানে ভোটের আগে এজেন্টদের একবার সই নিতে হয় ভোট শুরু করতে চলেছি। ভোট শুরু হলে আবার সই নিতে হয়। ভোট শেষ হলে আবার নিতে হয়। মেশিন সিল করে রওয়ানা হওয়ার সময় আবার সই নিতে হয়।

ভোট চলার সময়ও তো নানান ঘটনা ঘটে, সেরকম কী ধরনের ঘটনা আপনার সঙ্গে ঘটেছিল?

একবার এক ভোটদাতা গোঁ ধরে বসলেন, তিনি আঙুলে কালি লাগাবেন না। কোনো অনুরোধ-উপরোধেই কাজ হয় না। তিনি গোঁ ধরে বসে আছেন। তার নাম নথিভুক্ত হয়ে গেছে। ভোটার পরিচয়পত্র দেখিয়েছেন। শেষপর্যন্ত তার কাছে হাতজোড় করে সবিনয়ে বলতে হলো, ‘‘দাদা, এটা আমার চাকরির বিষয়। আপনি আঙুলে একটু কালি না লাগালে আমার চাকরি থাকবে না। তাই আমার মুখ চেয়ে কালি লাগান।'' তিনি খুব রেগেমেগে সম্মত হলেন। আমি বাঁচলাম।

আরেকবার আলো কম ছিল। মোমবাতি জ্বালিয়ে ভোট হচ্ছিল। একসময় মোমবাতি উল্টে গিয়ে নিভে গেল। এবার নিয়ম হলো, সব এজেন্টকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে আবার মোমবাতি জ্বালতে হবে। একজন এজেন্ট বললেন, আপনারা করে নিন। আমার কোনো অসুবিধা নেই। তিনিও কিছুতেই কথা শুনবেন না। শেষপর্যন্ত তাকে বলতে হলো, তিনি না গেলে ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকবে। তার দায় তাকেই নিতে হবে। তখন তিনি গেলেন, মোমবাতি জ্বললো। ভোট আবার শুরু হলো।

আবার ব্যতিক্রমী দৃশ্যও দেখেছি।  এমনও দেখেছি, দুই দলের এজেন্টরা খেলা নিয়ে আলোচনা করছেন, একবার দুই স্কুল শিক্ষক বন্ধুকে এজেন্ট হিসাবে দেখেছিলাম। তারা একে অন্যকে চা খাওয়াচ্ছেন, পান খাওয়াচ্ছেন। তাদের গলায় গলায় ভাব। এসব দেখলে ভালো লাগে। বোঝা যায়, গোলমাল, উত্তেজনার বাইরেও কিছু মানুষ আছেন, রাজনীতি যাদের বন্ধুত্ব, স্বাভাবিক সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারেনি।

দেবাশিস ভৌমিক, সাবেক প্রিসাইডিং অফিসারছবি: Debashish Bhowmik

কোনো গণ্ডগোলের মুখে কখনো পড়েননি?

আমি খুবই ভাগ্যবান। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা পর্যন্ত সব ভোটে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব সামলেছি। কিন্তু কখনো গোলমালের মুখে পড়িনি। আমার অনেক বন্ধু পড়েছেন বলে শুনেছি। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। ভোটগ্রহণের সময় হলো বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময় যারা লাইনে থাকবেন, সকলেই ভোট দিতে পারবেন। তাদের স্লিপ দিতে হয়। সেসব স্লিপ দিয়ে সকলের ভোট নিয়ে এজেন্টদের সম্মতি নিয়ে ভোটদানের কাজ শেষ করেছি, তারপর এক নেতা এসে হাজির, তিনি বলেন, কেন অনেকে ভোট দিতে পারেননি। আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি। তার এজেন্টকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে ভোট দিতে পারেননি। তিনি বললেন, সকলেই দিয়েছেন। তারপর দেখা গেল, তিনি ভুল বুথে এসেছেন। অন্য বুথে এই অভিযোগ উঠেছে।

ভোট শেষ হলো, তারপর?

তারপরেও অনেকক্ষণের কাজ থাকে। ইভিএম সিল করতে হয়। তার একটা পদ্ধতি আছে। প্রচুর লেখালেখি থাকে। কতগুলো ভোট পড়েছে, তার মধ্যে কতজন নারী, কতজন পুরুষ। কতজন ভোটার কার্ড দেখিয়ে ভোট দিয়েছেন, কতজন অন্য পরিচয়পত্র দেখিয়ে দিয়েছেন, সব হিসাব লিখে দিতে হতো। ইভিএমের ক্রমিক সংখ্যা, পেপার সিলের ক্রমিক সংখ্যা, কন্ট্রোল ইউনিটের ক্রমিক সংখ্যা সব দিয়ে ১৭ সি ফর্ম পূরণ করতে হয়। সেসবের একটা করে কপি প্রত্যেক এজেন্টকে দিতে হয়। ইভিএম মেশিন জমা দেয়ার সময় একটা সিলবন্ধ ও একটা খোলা ফর্ম দিতে হতো। খোলা ফর্মটা দেখে নেয়ার পর সেটাও সিলবন্ধ করতে হতো।

সব লেখালেখির কাজ শেষ করতে আবার তিন থেকে চার ঘণ্টা, তারপর আবার গাড়ি বা বাস করে যেতে হতো ভোটের জিনিস জমা করতে। সেখানে সব জমা দিয়ে, তারপর বাড়ি ফেরা।

কত রাত হতো ফিরতে?

একটা ঘটনার কথা বলি। সবকিছু কলকাতায় এসে জমা করতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তারপর দেখি, আমার বাড়ি ফেরার বাস নেই। একটা বাস বসিরহাট যাবে। সেটাতে করে বসিরহাট চলে এলাম আমরা দুইজন। তারপর পড়লাম এক মাতালের পাল্লায়। তিনি আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবেনই। কোনো কথা শুনবেন না। তবে তিনি একটা উপকার করেছিলেন। শেষপর্যন্ত অত রাতে একটা গাড়ি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। তাতে করে রাত দুইটার পর বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ