‘ভোটে কারচুপি', রাহুলের অভিযোগের প্রভাব কতটা!
৮ নভেম্বর ২০২৫
অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে পদযাত্রায় ভোটে কারচুপির নিদর্শনও তুলে ধরছেন রাহুল, যা তার ভাষায় ‘হাইড্রোজেন বোমা’।
২০২৪ সালে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে জনমত ও বুথ ফেরত সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, বিজেপি হারতে চলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামান্য ব্যবধানে হেরে যায় কংগ্রেস। সেই রাজ্যের ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন রাহুল। এই দাবির সপক্ষে ভুয়ো ভোটারের নমুনাও তুলে ধরেছেন তিনি।
সীমা, সুইটি, সরস্বতী, আলাদা নামের একাধিক সচিত্র পরিচয়পত্র তিনি দেখিয়েছেন। তার দাবি, কমিশন প্রকাশিত ভোটার তালিকাতেই মিলেছে এই তথ্য। রাই বিধানসভা কেন্দ্রের ১০টি বুথের ২২ জায়গায় একই নারীর ছবিতে রয়েছে আলাদা আলাদা ভোটার কার্ড।
এর থেকেও বড় চমক, ভোটার কার্ডের ছবির নারী ভারতীয়ই নন। তিনি ব্রাজিলিয়ান হেয়ার ড্রেসার। এভাবেই হরিয়ানার অন্য দু'টি বুথে একই নারীর ছবি সম্বলিত ২২৩টি ভোটার কার্ডও তুলে ধরেন রাহুল। তার অভিযোগ, কংগ্রেসকে হরিয়ানায় হারাতে ২৫ লক্ষ ভোটের কারচুপি হয়েছে। ২০২৪-এর ভোটে ৯০ আসনের হরিয়ানায় কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৭টি, বিজেপি ৪৮।
রাহুলের দাবি, হরিয়ানায় যা হয়েছে সেটা বিহারেও হবে। তার বক্তব্য, "হরিয়ানায় হয়েছে। এবার বিহারেও হবে। মাত্র আটটা আসনের জন্য কংগ্রেস সরকার গড়তে পারেনি। হরিয়ানায় ২ কোটি ভোটারের ২৫ লক্ষই ভুয়ো। প্রতি আটটিতে একটি ভোট চুরি হয়েছে।"
যে আটটি আসনের জন্য কংগ্রেস হেরেছে, সেখানে মোট ভোটারের ফারাক মাত্র ২৩ হাজারের মতো। রাহুলের অভিযোগ, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতাদের নাম রয়েছে হরিয়ানাতেও। এসব কারচুপি আড়াল করতে নির্বাচন কমিশন বুথের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ নষ্ট করে দিয়েছে। বিহারে এসআইআরের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
রাহুলের জবাবে মুখ খুলেছেন হরিয়ানার ভোটারেরা
রাহুল যেসব ভোটারের নাম ও পরিচয়ের সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান নারীর ছবি তুলে ধরেছেন, সেই ভোটাররাও মুখ খুলেছেন। তাদের প্রশ্ন, যদি ভোটারের সঙ্গে কার্ডে থাকা ছবির অমিল থাকে, তাহলে কেন কংগ্রেসের পোলিং এজেন্টরা তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন তোলেননি।
ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ধরার সময় মুনেশ নামের এক নারীর ভোটার কার্ড দেখিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। এখানে ছবি ছিল সেই বিদেশি নারীর। ভোটার মুনেশ বলেন, "এটা আমার আসল ভোটার কার্ড, এতে আমার ছবি রয়েছে। এই কার্ড দেখিয়ে আমি ভোট দিয়েছি। জানি না, কীভাবে ওই ভোটার কার্ড তৈরি হলো। যদি সেই কার্ড দেখিয়ে ভোট দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কেন দলীয় এজেন্ট বা কমিশনের প্রতিনিধিদের চোখে পড়ল না’’
গুনিয়া নামে আর এক ভোটারের তথ্য দিয়েছিলেন রাহুল, যিনি এখন প্রয়াত। তার কার্ডেও ব্রাজিলের নারীর ছবি ছিল। ওই মহিলার শাশুড়ি দাবি করেছেন, গুনিয়া ২০২২ সালে মারা গিয়েছেন। তার ভোটার কার্ড পরিবারের কাছেই রয়েছে। যদিও রাহুলের দেখানো কার্ডে প্রয়াত নারীর স্বামীর নাম ও ঠিকানা একেবারে ঠিকঠাক।
বিদেশী নারীর ছবি ব্যবহৃত হয়েছে পিঙ্কি জুগিন্দরের ভোটার কার্ডে। তিনিও রাহুলের উপস্থাপিত ছবি দেখে বিস্মিত। তার বক্তব্য, "গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে আমি ভোট দিয়েছি। আমার ভোটার কার্ডে অন্য নারীর ছবি চলে এসেছিল। সংশোধনের আবেদন করেও ভোটের সময়ে সেটা পাইনি। এটা বিএলওর ভুলে ঘটে থাকতে পারে’’
কে সেই ব্রাজিলিয়ান নারী?
ব্রাজিলের মডেল বলে যাকে সংবাদ মাধ্যমের সামনে পরিচিত করিয়েছেন রাহুল গান্ধী, তিনি আদতে একজন পেশাদার হেয়ার ড্রেসার। তার নাম ল্যারিসা নেরি। সমাজ মাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করে ল্যারিসা এসব ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
তার বক্তব্য, "আমার এই ছবিটা প্রায় ২০ বছরের পুরোনো। তখন আমার ১৮-২০ বছর বয়স। এই ছবি নাকি ভারতের নির্বাচনে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাকে ভারতীয় হিসেবে তুলে ধরে কারচুপি হচ্ছে। এটা কি ধরনের পাগলামো! কোন বিশ্বে আমরা বাস করছি। আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে গোটা বিষয়টা জেনেছি। বিশ্বাসই করতে পারছি না’’
ল্যারিসার এই ছবি একটি ইমেজ প্ল্যাটফর্মে আপলোড করেন তার বন্ধু ম্যাথুস ফেরারো। সে কারণেই সম্ভবত বিদেশি এই নারীকে ওই নামে উল্লেখ করেছিলেন রাহুল। ল্যারিসা বলেন, "ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। আমি কখনো ভারতে যাইনি। এই ঘটনার পরে ইনস্টাগ্রামে আমার ভারতীয় ফলোয়ারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, এতে আমি খুশি’’
রাহুলের বক্তব্যে নির্বাচন ও রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে?
বিহার নির্বাচনের আগে রাহুলের দাবি ভোটারদের মধ্যে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, নির্বাচন কমিশন ও বিজেপিকে কতটা বেকায়দায় ফেলবে, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ভোটার তালিকা দিতে ভারতের সর্বত্রই ব্যর্থ হয়েছে। এরকম একটা কথা রাহুল গান্ধী বলতে চেয়েছেন। এখন বিহারে নির্বাচন হচ্ছে, বিহারের ব্যাপারে তিনি খুব একটা প্রমাণ দিতে পারেননি। এতে সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী না করে মানুষকে সচেতন করা উচিত ছিল। কমিশন যে কাজ করছে না, সেটা বলার মতো পর্যাপ্ত যুক্তি রাহুল দেখাতে পারেননি’’
তার মতে, "হরিয়ানার ভোট অনেকদিন আগে হয়ে গিয়েছে। রাহুল বলেছেন, এক্সিট পোলে একটি পার্টিকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। এই কথার তো কোনো যুক্তি নেই। বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এক্সিট পোলের ফল ভুল হয়েছে। সুতরাং তার ভিত্তিতে উনি একটা প্রেস কনফারেন্স করলেন এবং নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করলেন, এটা বোকা বোকা লাগছে। যেখানে নির্বাচন হচ্ছে অর্থাৎ বিহার সম্পর্কে যদি উনি সঠিক তথ্য দিতে পারতেন, তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ হত। সেটা না করে পুরনো নির্বাচনের তথ্যকে তুলে ধরা খুব একটা কার্যকরী হয় না। একটা নির্বাচন হয়ে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে নির্বাচন কমিশন আর দায় নিতে চায় না’’
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যে কোনো রাজনৈতিক নেতা যেটা করেন, বিহার ভোটের আগে নিজেদের পালে হাওয়া টানতে বা বিপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপাতে রাহুল গান্ধী সেটা করেছেন। এটা সবসময়ই একটা চাঞ্চল্যকর বিষয় যে, একটি রাজ্যের একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে ২২ বার একই ব্যক্তি ভোট দিচ্ছেন। হতে পারে তিনি হয়তো একই ব্যক্তি নন। কিন্তু একজনের এপিক কার্ড ব্যবহার করে এতগুলো ভোট দেওয়া হচ্ছে। যে কোনো গণতন্ত্রে মানুষের সঙ্গে এ ধরনের ছিনিমিনি খেলাটা উচিত নয়। তাই রাহুলের অভিযোগ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ’’
যদিও বিহার নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে রাহুলের অভিযোগকে অনেকে বিবেচনা করছেন। সাংবাদিক প্রসূন আচার্য বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে ডিডাব্লিউকে বলেন, "এখানকার ভোটের প্রথম দফায় আমি এমন উদাহরণ দেখলাম যেখানে নারীরা ভোট দিতে পারছেন না। কারো নাম তালিকায় রয়েছে, কিন্তু ভোটার কার্ডের ছবি মিলছে না। আমি দেখলাম যে মোকামা বিধানসভা কেন্দ্রে দুজন ভূমিহার নারী ভোট দিতে না পেরে বসে রয়েছেন। একজনের ভোটার কার্ডের ছবি আলাদা। আর একজনের ভোট এই বুথের বদলে দূরের একটি গ্রামে চলে গিয়েছে’’
এই ঘটনা শুধু এক জায়গার নয়, বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে বলে দাবি প্রসূনের। তিনি বলেন, "একাধিক কেন্দ্রে দেখা গিয়েছে, যেসব ভোটারের নাম খসড়া তালিকায় ছিল, যারা চূড়ান্ত তালিকা দেখেননি, তারা কার্ড নিয়ে ভোট দিতে গিয়ে দেখছেন, সংশ্লিষ্ট বুথের ভোটার তালিকায় তাদের নাম নেই। কত মানুষ এভাবে ভোট দিতে পারেননি, তার হিসাব নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই, রাজনৈতিক দলের কাছেও নয়। এর ফলে গরিব, নিরক্ষর মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোটদানে বঞ্চিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে, একজনও বৈধ ভোটারের নাম যেন তালিকা থেকে বাদ না যায়। কিন্তু বিহার ভোটের প্রথম দফায় দেখা গেল, যেভাবে বৈধ ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে, সেটা খুবই আশঙ্কার কারণ’’
বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন শুরু হয়েছে। দেশের অন্যান্য রাজ্য একই প্রক্রিয়া চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন তার পরিপ্রেক্ষিতে রাহুলের 'হাইড্রোজেন বোমা'র তাৎপর্য আছে বলে সুমনের মত।
তিনি বলেন, "এটা রাহুল গান্ধীর কৃতিত্ব যে গত ছয় মাসে ধারাবাহিকভাবে ভোটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেনিয়মের উল্লেখ করে চলেছেন। যেমন, এর আগে কর্নাটকের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বিধানসভায় কীভাবে ছয় হাজারের বেশি লোকের নাম বাদ দেয়া হয়েছে, কীভাবে দলিত এবং মুসলিমদের নাম বাদ পড়েছে, সেটা তুলে ধরেছিলেন। আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশন তো বটেই, প্রত্যেকের এই বিষয়ে বেশি সচেতন থাকা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় যেভাবে ক্রমাগত ভোট চুরি বা ভোটে কারচুপি নিয়ে অভিযোগ উঠছে এবং তার জেরে বিভিন্ন রাষ্ট্রে গন্ডগোল হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাহুলের অভিযোগকে দেখা হোক’’