পাঁচ সপ্তাহের ম্যারাথন ভোট পর্বের শেষে শুক্রবার ১৬ই মে ভোট গণনার প্রথম চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফলের যে ছবিটা উঠে আসছে, তাতে আর কোনো সংশয় নেই যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট দিল্লিতে সরকার গড়তে চলেছে, আর প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী৷ প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, বুথ ফেরত সমীক্ষাগুলির পূর্বাভাষমত মোদী ঢেউ এখন বাস্তব, অনুমান নয়৷
বিজেপির বিজয়রথ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিম ভারতে৷ সংসদের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৭২-এর ম্যাজিক সংখ্যা একাই অতিক্রম করতে চলেছে বিজেপি৷ আর জোট শরিকদের নিয়ে সংখ্যা প্রায় ৩০০ ছাড়িয়ে যেতে চলেছে৷ উত্তর প্রদেশে ৮০টি আসনের মধ্যে বিজেপি-জোট পেয়েছে ৬৭টি আসন৷ বারাণসী আসনে এগিয়ে আছেন মোদী৷ লক্ষৌ আসনে জিতেছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং ও কানপুর থেকে প্রবীণ নেতা মুরলি মনোহর যোশী৷ গুজরাটে ২৬টি আসনের মধ্যে সবকটি বিজেপির ঝুলিতে৷ রাজ্যের বদোদরা আসনে মোদী জিতেছেন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায়৷ গান্ধীনগর থেকে জিতেছেন বিজেপির বর্ষিযান নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি৷ দিল্লির সাতটি আসনের সবকটি এখন বিজেপির দখলে৷ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির নাম গন্ধ নেই৷ পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রে ৪৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি জোটের দখলে ৪৭টি আসন৷ তবে দক্ষিণ ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের দুর্গ এখনো বিজেপির অধরা৷ তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার এআইএডিএমকে রমরমা৷ কেরালাতে সবে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি৷ দিল্লির বিজেপি সদর কার্যালয়ে এখন চলেছে বিজয় উৎসব৷ ব্যান্ডপার্টি, বাজি পটকা, লাড্ডু, ফুলের ছড়াছড়ি৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
অন্যদিকে কংগ্রেসের হয়েছে ভরাডুবি৷ রাহুল গান্ধীর আমেথি আসনে এখন জোয়ার ভাঁটা৷ কখনো রাহুল এগিয়ে কখনো বিজেপির স্মৃতি ইরাণী৷ পরাজয় নিশ্চিত জেনে কংগ্রেসের তরফে জনাদেশ মেনে নেয়া হয়েছে৷ তবে গত ১০ বছরে কংগ্রেস অনেক ঐতিহাসিক কল্যাণ কর্মসূচি চালু করেছিল৷ কিন্তু ভালোভাবে তা তুলে ধরতে পারিনি জনগণের সামনে৷ কংগ্রেসের গলদ কোথায়, ভুলত্রুটি হয়েছে কোথায় – তা নিয়ে পরে পোস্টমর্টেম করা হবে বলে জানান কংগ্রেসের সংসদীয় মন্ত্রী৷ তিনি বলেন, কংগ্রেসকে এর আগেও কয়েকবার নির্বাচনি বিপর্যয়ের সন্মুখীন হতে হেয়েছিল, কিন্ত আবারো ‘ফিনিক্স' পাখির মতো জেগে উঠতে পেরেছে৷ বর্তমান নির্বাচনি বিপর্যয়ের দায়িত্ব কারোর একার নয়৷ এটা দল ও সরকারের মিলিত দায়িত্ব৷