‘ফুলের বনে মধু নিতে অনেক কাঁটার জ্বালা’, গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র৷ সে অনেকদিন আগের কথা৷ আজ ইউরোপে সেই ভ্রমর কিংবা ভোমরা অথবা – ইংরিজিতে – বাম্বল-বি-র বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের ভোমরাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নিশ্চিহ্ন হবার ঝুঁকিতে রয়েছে৷ এর কারণ হল মূলত তাদের হ্যাবিট্যাট, অর্থাৎ বসবাসের উপযোগী পরিবেশের ক্ষতি এবং সেই সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন৷ ইউরোপের ৬৮টি প্রজাতির ভোমরাদের মধ্যে ১৬টি প্রজাতি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সঙ্ঘ বা আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় নাম উঠিয়ে ফেলেছে৷ অন্যদিকে ভোমরাদের নিকটাত্মীয় মৌমাছিরাও রোগের কারণে বিপন্ন৷ কাজেই মুক্ত প্রকৃতিতে পরাগ ছড়ানোর মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যারা নিখর্চায় করে থাকে, সেই নিরলস, মধুলোভী কর্মীরাই যদি উধাও হন, তাহলে দুনিয়া চলবে কি করে?
প্রাণিজগতের রেকর্ডধারীদের কথা
প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবলে অবাক হতে হয়৷ কেউ খুব ছোট, কেউ খুব বড়৷ প্রাণীদের চলন-বলনেও কত বৈচিত্র্য! কেউ দৌড়ায় ঝড়ের বেগে, কেউ লাফিয়ে চলে, কারো আবার বিচরণ আকাশের কাছাকাছি৷ ছবিতে দেখে নিন তাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিতা : দ্য স্প্রিন্টার
ক্ষুধার্ত চিতার সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে চিতা৷ নিঃশব্দে শিকারের কাছাকাছি গিয়ে এমন বেগে তাড়া করতে শুরু করলে ভয়ঙ্কর এই শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার৷ একটাই আশার কথা- চিতা বেশিক্ষণ খুব দ্রুত দৌড়াতে পারেনা৷ তাই কয়েকশ মিটারের মধ্যে ধরতে না পারলে হরিণের মতো পছন্দের খাবার হাতছাড়া করার হতাশায়ও ভুগতে হয় চিতাকে৷
ছবি: Fotolia/stephane angue
গতির সঙ্গে কষ্টসহিষ্ণুতা
‘প্রংহর্ন’ অন্য হরিণদের মতোই ক্ষিপ্রগতির হলেও এক জায়গায় পৃথিবীর বাকি প্রাণীদের চেয়ে এগিয়ে৷ কিছু প্রাণী শুরুতে খুব দ্রুত ছুটতে পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ফলে গতিও কমে আসে দ্রুত৷ প্রংহর্ন সেরকম নয়৷ পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত অনায়াসে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে৷ ফলে চিতা, বাঘ, সিংহ বা অন্য যে-কোনো প্রাণীই শিকার করতে আসুক, শুরুর ঝড়টা সামলে নিলে প্রংহর্নকে আর কে পায়!
ছবি: Getty Images
দ্রুততম পাখি
সব পাখি কিন্তু ওড়ে না৷ কোনো কোনো পাখি ডানা না মেলে দু পায়ে ছুটতেই বেশি ভালোবাসে৷ বিশালদেহী উটপাখি তো উড়তেই পারেনা৷ তবে দৌড়ায় অবিশ্বাস্য গতিতে৷ ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে বলে তারা যে শুধু পাখিজগতের দ্রুততম সদস্য তা-ই নয়, অন্তত আধঘণ্টা পর্যন্ত ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেগ ধরে রাখতে পারে বলে তাদের কষ্টসহিষ্ণুতারও প্রশংসা করতে হয় আলাদাভাবে৷
ছবি: AP
‘শকুন হইতে সাবধান’
১৯৭৩ সালে একটা বিমান প্রায় বিধ্বস্ত হতে বসেছিল শকুনের কবলে পড়ে৷ ১১ হাজার ২০০ মিটার অর্থাৎ ৩৬ হাজার ৭৪৫ ফুট ওপর দিয়ে উড়ছিল বিমানটি৷ এক রুপেল শকুন উড়তে উড়তে সেখানে গিয়ে হাজির এবং বিমানের সঙ্গে ধাক্কা৷ পাখি সাধারণত ১০০ থেকে ২,০০০ মিটার উঁচুতে ওড়ে৷ শুধু অভিবাসী পাখিরাই প্রবল শীতে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে বাঁচতে যখন দেশান্তরী হয়, বিশেষ করে যখন হিমালয়ের ওপর দিয়ে উড়তে হয়, তখন বড় জোর ৯,০০০ মিটার উঁচুতে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবচেয়ে উঁচুতে লাফ
বিশাল আকৃতির বুনো বেড়াল শ্রেণির এই প্রাণী একেবারে জায়গায় দাঁড়িয়ে সাড়ে পাঁচ মিটার, অর্থাৎ ১৮ ফুট ওপরের মগডাল থেকে শিকার ধরে আনতে পারে৷ স্থলচর আর কোনো প্রাণী লাফিয়ে এত উঁচুতে উঠতে পারেনা৷ ৫০ কেজি ওজনের শরীর নিয়ে পুমা কী করে যে এত উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে, কে জানে! প্রাণীকুলে ডলফিনই শুধু পুমার চেয়ে বেশি, ৭ মিটার উঁচুতে উঠতে পারে লাফিয়ে৷ তবে জলচর ডলফিন লাফের আগে অনেকটা পথ সাঁতরে গতি বাড়িয়ে নেয়৷
ছবি: Bas Lammers
সবচেয়ে ছোট পাখি
সবচেয়ে ছোট পাখির নাম হামিং বার্ড৷ সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ে এটা নিশ্চয়ই অনেক আগেই জেনে গেছেন সবাই৷ সবচেয়ে ছোট হামিং বার্ডের শরীর দুই ইঞ্চি বা ৬ সেন্টিমিটারের মতো৷ ওজন অন্য পাখির পালকের সমান, মাত্র ২ গ্রাম! খুব ছোট পাখি, খুব ছোট ডানাও তাদের৷ তাই উড়তে হয় অনেক কষ্ট করে৷ ওড়ার সময় সেকেন্ডে ৪০ থেকে ৫০ বার ডানা ঝাপটায় হামিং বার্ড৷
ছবি: Fabian Schmidt
সবচেয়ে গভীরে
ডাইভ দিয়ে সমুদ্রের পানির ৩,০০০ মিটার গভীরে চলে যায় তিমি৷ একঘণ্টা শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে থাকতেও পারে সেখানে৷ আর কোনো স্তন্যপায়ী প্রানী পানির এত গভীর তলদেশে যেতে পারে না৷ এতক্ষণ ধরে তিমির মতো শ্বাস বন্ধ রাখাটা অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়৷ তিমি নাকি ডাইভ দেয়ার সময়ই মস্তিস্ক আর হৃৎপিণ্ডে রক্ত পাঠিয়ে দেয়৷ আর এভাবেই দম বন্ধ করে ঘণ্টা পার করার জাদু দেখায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই প্রাণী৷
ছবি: 2010 Universum Film GmbH / Richard Herrmann
খরতাপে নির্বিকার
‘অরিক্স’ হরিণ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তপ্ত হাওয়া গায়ে মেখে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়৷ মানুষ হলে অমন তাপে মৃত্যু নির্ঘাত৷ অরিক্সের দেহের রক্ত শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ তাছাড়া তৃষ্ণা খুব কম পায় বলে অন্য প্রাণীদের মতো গরমে ঘন ঘন পানি পান করারও দরকার পড়েনা৷ সপ্তাহে একবার পানি পান করলেই সুস্থ থাকে অরিক্স৷ এমন হলে কারো গায়ে তাপ দুর্ভোগ হয় কী করে!
ছবি: picture-alliance/zb
সেরা কান
প্রাণীকুলে সেরা কান বাঁদুরের৷ নিশাচর এই প্রাণী তার বড় বড় কান শব্দের উৎসের দিকে ঘোরালে যেন দীর্ঘ এক চোঙ চলে যায় সেখানে, টেনে নিয়ে আসে শব্দকে৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারেও বাঁদুরের তাই পোকামাকড় ধরে খেতে কোনো অসুবিধা হয়না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাফের আসল চ্যাম্পিয়ন
মাছিদেরও আছে অসাধারণ এক ক্ষমতা৷ শরীরের উচ্চতার চেয়ে ২০০ গুণ উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে তারা৷ ফ্রগহপার তো আরেক কাঠি সরেস৷ নিজের শরীরের উচ্চতার চেয়ে ৪০০ গুণ বেশি উঁচুতে এক লাফে হেসেখেলে উঠে যায় তারা!
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
বিভিন্ন দেশের সরকার, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণ গোষ্ঠীদের সমন্বয়ে সৃষ্ট আইইউসিএন বলছে: ‘‘ইউরোপে ফসলে পরাগ যোগ করে যে সব কীটপতঙ্গ, তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি প্রজাতির মধ্যে তিনটিই হল ভোমরা৷'' এই সব পরাগবহনকারী খুদে জীবরা প্রতিবছর ইউরোপীয় কৃষিপণ্যে যে মূল্য যোগ করে, তার পরিমাণ হল দু'হাজার দু'শো কোটি ইউরো৷
অথচ ইউরোপের ভোমরাদের মধ্যে অর্ধেক প্রজাতির সদস্যসংখ্যা কমছে৷ সংখ্যা বাড়ছে মাত্র ১৩ শতাংশ প্রজাতির৷ ইউরোপীয় ভোমরা মৌমাছির চেয়ে অনেক বড় এবং কালোর উপর হলদে ডোরা কাটা৷ এরা মৌমাছির মতো চাক তৈরি করে না; শ'দুয়েক অবধি ভোমরা মিলে ছোট ছোট বাসা বাঁধে৷ গ্রিনহাউস বা কাচের ঘরে টম্যাটো, লঙ্কা ও ক্যাপসিকাম, বেগুন ইত্যাদির গাছ ‘পলিনেট' অর্থাৎ পরাগযুক্ত করার জন্য বাণিজ্যিকভাবে ভোমরা পালনের চল আছে৷
জলবায়ুর পরিবর্তন, বাণিজ্যিকভাবে কৃষিকাজ, এবং কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তনের ফলে ভোমরারা বিপন্ন হয়ে পড়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে বটে: যেমন ইইউ সম্প্রতি কিছু কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে৷ কিন্তু যে বস্তুটি নিয়ে আজ গবেষণার প্রয়োজন, সেটি হল: মৌমাছিদের রোগ কি এখন ভোমরাদের মধ্যেও ছড়াচ্ছে? ব্রিটেন থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসের খবর: তথাকথিত ‘ডিফরমড উইং' বা ‘পঙ্গু পাখা' ভাইরাসটি নাকি মৌমাছি এবং ভোমরা, উভয়ের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে৷ তবে সাধারণভাবে ভোমরাদের অসুখবিসুখ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা নেই৷
একমাত্র রানি ভোমরাই শীত কাটিয়ে বসন্তে পা দিতে পারে৷ কেননা প্রকৃতিতে অপচয়ের আরেক নাম নবায়ন৷