আজ না হয় কাল ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হবে ভারতে৷ কিন্তু ১৩০ কোটির দেশে ভ্যাকসিন দিতে প্রতি পদে সমস্যায় পড়তে হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাজ্য ও অ্যামেরিকায় শুরু হয়েছে করোনার ভ্যাকসিন দেয়ার কাজ৷ ভারতেও অদূর ভবিষ্যতে তা শুরু হয়ে যাবে৷ তিনটি কোম্পানি জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন চালুর অনুমতি চেয়েছে৷ নীতি আয়োগের সদস্য বিনোদ পল জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি ভারতেও ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়ে যাবে৷ নিঃসন্দেহে সুখবর৷ কিন্তু এই সুখবরের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে৷ কীভাবে দেয়া হবে এই ভ্যাকসিন? কারা প্রথমে পাবেন? বাকিরা কখন পাবেন? কীসের ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে? কারা দেবেন? এ তো এক আধ লক্ষ টিকা দেয়া নয়, ১৩০ কোটি মানুষকে দুই বার করে ভ্যাকসিন দেয়া মানে ২৬০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন লাগবে৷ কবে পাওয়া যাবে অত ভ্যাকসিন? এই ভ্যাকসিন কি বাধ্যতামূলক হবে?
এই প্রশ্নগুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা বেশ জটিল৷ একটু অসাবধান হলেই পুরো প্রক্রিয়া বেহাল হয়ে যেতে পারে৷ উপমহাদেশে সরকারি বহু কর্মসূচির মতোই ঘেঁটে যেতে পারে পুরোটা৷ আর যেহেতু ভারতে সবকিছুর মধ্যেই রাজনীতি ঢুকে পড়ে, তাই করোনা-ভ্যাকসিন দেয়ার মধ্যেও যে তার প্রবেশ ঘটবে না, এই গ্যারান্টি কে দেবে? বিশেষ করে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ সহ পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট, তখন ভ্যাকসিন-রাজনীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ ফলে পরিস্থিতি বেশ জটিল৷
করোনা ভ্যাকসিন দেয়া নিয়ে নীতি নির্ধারণ করার জন্য ন্যাশনাল এক্সপার্ট গ্রুপ অন ভ্যাকসিন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অন কোভিড তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ তারা অন্তত বার দশেক বৈঠকে বসেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে৷ রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সরকার আলোচনা করেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের কথা হয়েছে৷ তারপর ঠিক হয়েছে, প্রথমে ভ্যাকসিন দেয়া হবে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের৷ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত এক কোটি মানুষ প্রথমে এই প্রতিষেধক নিতে পারবেন৷ তারপর পাবেন পুলিশ, পুরসভার কর্মীদের মতো ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কাররা, যাঁরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একেবারে সামনে আছেন৷ তাঁদের সংখ্যা দুই কোটির মতো৷ এঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশ, সেনা, হোমগার্ড, সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে জড়িত কর্মী, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত কর্মী ও পুরসভার কর্মীরা আছেন৷ তারপর প্রতিষেধক নিতে পারবেন পঞ্চাশ বছর বা তার বেশি বয়সীরা৷ তাঁদের সংখ্যা প্রায় ২৭ কোটি৷ ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের চিহ্নিত করা হবে৷ তার সঙ্গে কম বয়সী অথচ যাঁরা ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন সহ বিভিন্ন গুরুতর অসুখে ভুগছেন, তাঁরা প্রতিষেধক নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন৷
এখনো পর্যন্ত অগ্রাধিকারের এই তালিকা তৈরি করতে পেরেছে কমিটি৷ শিক্ষকেরা কবে প্রতিষেধক নিতে পারবেন তা নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়েছে৷ কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ গত নয় মাস ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শুধু অনলাইন ক্লাস হচ্ছে৷ ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিষেধক দেয়া জরুরি৷
করোনা ভ্যাকসিন: কোন দেশের কী কৌশল
এক বছরেরও কম সময়ে করোনার কার্যকরী একাধিক ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছে বিভিন্ন কোম্পানি৷ সেগুলো অনুমোদনও পেতে শুরু করেছে৷ আগেভাগে সংগ্রহে দেশগুলোর মধ্যে তোড়জোড় যেমন চলছে; তেমনি নাগরিকদের টিকা প্রদানে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কৌশল৷
ছবি: Allan Carvalho/NurPhoto/picture-alliance
পথ দেখালো যুক্তরাজ্য
আট ডিসেম্বর বায়োনটেক ও ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন ৯০ বছরের মার্গারেট৷ যুক্তরাজ্যে প্রথম আট লাখ টিকা পাবেন তার মতো প্রবীণ, সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাকি বয়স্ক নাগরিকরা৷ ফাইজারের কাছে মোট চার কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি; যার মাধ্যমে দুই ডোজ করে দুই কোটি মানুষের ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা মিলছে৷ পাঁচ কোটি ত্রিশ লাখ নাগরিকের সবাইকে টিকা দিতে যুক্তরাজ্যকে নির্ভর করতে হবে অন্য কোম্পানিগুলোর উপরে৷
ছবি: Jacob King/AP Photo/picture alliance
প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র
বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রও৷ দেশব্যাপী ছড়ানো বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে ২৯ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান পৌঁছেছে৷ ফাইজার থেকে আরো ২০ লাখ আর মডার্নার ৫৯ লাখ ডোজের চালান ছাড় হতে পারে আসছে সপ্তাহে৷ এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের৷ প্রথম ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সিং হোমে বসবাসরত, জরুরি সেবায় নিয়োজিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যধিতে আক্রান্তরা টিকা পাবেন৷
ছবি: Bran Woolston/REUTERS
ক্যানাডার তোড়জোড়
মডার্নার কাছ থেকে এক লাখ ৬৮ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পেতে সম্প্রতি চুক্তি করেছে ক্যানাডা৷ শর্ত অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই চালান ছাড় শুরু করবে কোম্পানিটি৷ তবে তার আগেই ফাইজারের টিকা পৌঁছে গেছে দেশটিতে৷ ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে প্রয়োগও৷
ছবি: Adrian Wyld/REUTERS
দেরি করেনি সৌদি
আরব নিউজের সংবাদ অনুযায়ী, ১৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবে বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রথম চালান পৌঁছায়৷ পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রয়োগ৷ টিকা পেতে একদিনে মোট দেড় লাখ মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন৷ সবাইকে বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও অগ্রাধিকারভিত্তিতে পাবেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সি, বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ছবি: Ahmed Yosri/REUTERS
শুরু হচ্ছে ইসরায়েলে
ইসরায়েলের গণমাধ্যম হারিৎস-এর তথ্য অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রথম টিকা নেবেন দেশটিতে৷ এরপর প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পাবেন বাকি জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ সাধারণ নাগরিকদের টিকা প্রদান শুরু হবে আসছে সপ্তাহে৷ শুরুতে অগ্রাধিকার পাবেন বয়স্করা৷ প্রাথমিক পর্যায়ে ফাইজারের কাছ থেকে কয়েক লাখ ভ্যাকসিন নিচ্ছে দেশটি৷ দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে নিজেদের উদ্ভাবিত একটি ভ্যাকসিনও৷
ছবি: Abir Sultan/REUTERS
অপেক্ষায় জার্মানি
নভেম্বরের শুরুতেই টিকা কর্মসূচির কৌশল নির্ধারণ করেছে জার্মানির সরকার৷ ইইউর মাধ্যমে ৩০ কোটি টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি৷ টিকা পাওয়া মাত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬০ টি বিতরণ কেন্দ্রে সেগুলো পৌঁছে দেবে সরকার৷ তবে সাধারণ মানুষকে এর আওতায় আসতে বেশ কয়েক মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে৷ কেননা, শুরুতে প্রাধান্য পাবেন বয়স্ক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকরা৷ এই তালিকায় আছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতরাও৷
ছবি: Ralph Orlowski/REUTERS
জাপানে মহাযজ্ঞ
নিজেদের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর সবার জন্য আগামী জুনের মধ্যে করোনার টিকা নিশ্চিত করতে চায় জাপান সরকার৷ এজন্য ফাইজার, আস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার কাছ থেকে ২৯ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি হয়েছে৷ জনগণকে বিনা খরচেই এই টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার গত অক্টোবরেই৷ ভ্যাকসিন সংরক্ষণে এরই মধ্যে সাড়ে দশ হাজার ডিপ ফ্রিজার কেনাসহ মহাযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Kyodo/MAXPPP
শেষ ধাপে চীন
পরীক্ষার শেষ ধাপে রয়েছে চীনের বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কয়েকটি টিকা৷ সেগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন না পেলেও জরুরি ভিত্তিতে এরই মধ্যে ১০ লাখ স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিতে থাকা নাগরিককে পরীক্ষামূলক টিকা দেয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন প্রদেশের সরকার আগেভাগেই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জনসংখ্যার হিসাবে টিকার অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রেখেছে৷ কারা আগে ভ্যাকসিন পাবেন তার অগ্রাধিকার তালিকাও তৈরি করছে প্রশাসন৷
ছবি: Wang Zhao/AFP/Getty Images
একাধিক টিকার অপেক্ষায় ভারত
আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা মোদী সরকারের৷ প্রথম ধাপের এই টিকা কর্মসূচীর আওতায় আসবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও পঞ্চাশোর্ধ্বরা৷ এতে খরচ হবে ১৪০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার৷ পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবে ২৩টি মন্ত্রণালয়৷ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও আস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুটনিক এবং ভারতীয় জাইডাস কেডিলা ও ভারতী বায়োটেকের টিকা আছে সম্ভাব্য প্রাপ্তির তালিকায়৷
ছবি: Dado Ruvic/REUTERS
চীনে চোখ পাকিস্তানের
চীনের একটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে পাকিস্তানে৷ ভ্যাকসিন কেনার জন্য ইমরান খান সরকারের এখন পর্যন্ত ঘোষিত বাজেট ২৫ কোটি ডলার৷ এই অর্থ দিয়ে একাধিক টিকা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা তাদের৷ প্রথম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থকর্মী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা৷ পরবর্তী ধাপে গুরুত্ব দেয়া হবে বাকি স্বাস্থ্যকর্মী এবং ষাটোর্ধ্বদের৷
ছবি: Aamir Qureshi/AFP/Getty Images
অক্সফোর্ডের ভরসায় বাংলাদেশ
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশের বেক্সিমকো৷ যার মাধ্যমে পাওয়া যাবে তিন কোটি টিকা৷ এতে দেড় কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে৷ টিকা প্রদানে অগ্রাধিকারের জন্য ১০ ধরনের জনগোষ্ঠীর তালিকা করেছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
11 ছবি1 | 11
প্রাথমিক যে তালিকা তৈরি করেছে কমিটি, সেখানে ৩০ কোটি মানুষকে রাখা হয়েছে৷ তার মানে মোট ৬০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন লাগবে তাঁদের জন্য৷ কিন্তু এখন কত ভ্যাকসিন হাতে পাবে ভারত? সেরাম ইনস্টিটিউট, যারা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড তৈরি করছে, তারা প্রথমেই চার কোটি ডোজ দিতে পারবে৷ কিন্তু ফাইজার বা ভারতীয় কোম্পানি ভারত বয়োটেক ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল রিসার্চের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিন প্রথমে কতটা হাতে পাওয়া যাবে তা তারা জানায়নি৷ ফাইজারের ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ভারতে হয়নি৷ তর্কের খাতিয়ে যদি ধরে নেয়া যায়, তিনটি ভ্যাকসিনই অনুমোদন পেল এবং প্রথমেই তারা চার কোটি ডোজ করে দিতে পারবে, তা হলে মোট ১২ কোটি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু করা যাবে৷ তার মানে তালিকায় উল্লিখিত তিনটি গোষ্ঠীর মানুষই ভ্যাকসিন পাবেন৷ তবে সেখানেও সকলে পাবেন না৷ ৩০ কোটির মধ্যে মাত্র ছয় কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে৷ সেরাম ইনস্টিটিউট হলো বিশ্বের সব চেয়ে বেশি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক, ফলে তাঁদের কাছে বেশি পরিমাণে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা আছে৷ যুক্তরাজ্য, অ্যামেরিকা, ইইউ-কে দেয়ার পর ফাইজার কি প্রথমেই চার কোটি ভ্যাকসিন ভারতকে দিতে পারবে? সম্ভবত না৷ ভারত বায়োটেকের পক্ষেও অত ভ্যাকসিন প্রথমেই তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না৷
এই ভ্যাকসিনগুলি খুবই কম তাপমাত্রায় রাখতে হয়৷ ভারতে এখন যা ব্যবস্থা আছে, তাতে ছয় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন একবারে দেয়া যাবে৷ সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী ও ফ্রন্টলাইন কর্মীদের দুইটি ডোজ দেয়া যাবে৷ ইতিমধ্যে একটা অ্যাপ তৈরি হয়েছে, যেখানে কাকে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে, তাপমাত্রা ঠিক আছে কি না, কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না, সেই সব তথ্য জানা যাবে৷ ঠিক হয়েছে, প্রথমে একশ জন করে গ্রুপ তৈরি করে ভ্যাকসিন দেয়া হবে৷ আধঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখা হবে, তাঁদের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না৷ তারপর তাঁদের ছেড়ে দেয়া হবে৷ প্রতি বছর ভারতে দুই কোটি ৬০ লাখ নবজাতককে বিভিন্ন টিকা ও ইঞ্জেকশন দেয়া হয়৷ ফলে ভারতে প্রশিক্ষিত টিকা কর্মীর কোনো অভাব নেই৷ সব রাজ্যে তাঁরা আছেন৷ এরকম বড় ইভেন্ট পরিচালনা করার দক্ষতাও তাঁদের আছে৷
কিন্তু গোলমাল এখানেই শেষ হচ্ছে না৷ ভারতে একাধিক ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হবে৷ ধরা যাক, কোনো রাজ্যে পাঁচ লাখ লোককে ফাইজারের ভ্যাকসিন দেয়া হলো৷ তাঁকে দ্বিতীয় ডোজ তো ফাইজারেরই দিতে হবে৷ কিন্তু পরে দেখা গেল, ফাইজারের ভ্যাকসিন আসতে দেরি হচ্ছে৷ তখন? এ বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট নীতি নেয়ার প্রয়োজন৷ সে বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ প্রস্তাব এসেছে, একটি রাজ্যে একটি কোম্পানির ভ্যাকসিনই দেয়া হবে৷ কিন্তু তা নিয়ে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি৷
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, ভ্যাকসিনের খরচ কি শুধু কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে? বিহার নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, সকলকে ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেয়া হবে৷ ধারণা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকারই পুরো খরচ দেবে৷ এখন কেন্দ্র পুরো দেবে, না কি, রাজ্য সরকারগুলিকে ৪০ শতাংশ খরচ দিতে বলবে তা পরিষ্কার নয়৷ ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ৪০ শতাংশ খরচ দেয়৷
কিন্তু করোনাকালে রাজ্য সরকারের কোষাগার খালি৷ কেন্দ্রের হালও যে খুব ভালো, তা নয়৷ কেন্দ্র তো রাজ্যগুলিকে জিএসটির ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত দিতে পারছিল না৷ ভ্যাকসিনের দাম যদি পাঁচশ টাকাও হয়, তা হলে ২৬০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে খরচের ধাক্কা প্রবল৷ তা হলে? এত টাকা সরকার পাবে কোথায়? গরিবদের অবশ্যই বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেয়া উচিত৷ কিন্তু যাঁরা দুই ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন, তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেয়া উচিত৷ আম্বানি, আদানিদের কথা ছেড়ে দিন, ভারতে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা তো কম নয়৷ তাঁরা এই ভ্যাকসিন নিজের খরচেই নিতে পারবেন৷ এখন রাজ্য সরকার যদি টাকা দেয়, তা হলে কি তারা ঠিক করতে পারবে, কোন ভ্যাকসিন নেবে, কোনটা নয়? এর উত্তরও অজানা৷
বেশ কিছু রাজ্য সরকার ভ্যাকসিন নিয়ে ঘোষণা শুরু করে দিয়েছে৷ তেলেঙ্গানা জানিয়েছে, জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে তারা প্রায় ৮০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেবে৷ কী করে? জানা নেই৷ তেলেঙ্গানা যদি জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে ৮০ লাখ ভ্যাকসিন পায়, তা হলে বাকি রাজ্যের কী হবে? কমিটির নীতি হলো, রাজ্যে ৫০ বছরের উপরে ও কো-মর্বিডিটি সহ যত মানুষ আছেন, তার অনুপাতে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে৷ নজরদরির জন্য কুড়িজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকবেন৷ এখন রাজ্যে কারা প্রথমে ভ্যাকসিন পাবেন, সেটা কে ঠিক করবে? কোনো রাজ্য যদি বলে বিদ্যুৎ কর্মীরাও ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার, তাঁদের প্রথমে ভ্যাকসিন দিতে হবে, তখন কী হবে? ফলে ছিদ্র অনেক৷ এই সব ছিদ্র দিয়ে পিঁপড়ে তো দূরস্থান, বড় বড় হাতিও গলে যাবে৷ ফলে অব্যবস্থার ভরপুর সম্ভাবনা রয়েছে৷ সব চেয়ে বড় কথা, খাতায় কলমে পরিকল্পনা করা এক, দিনের পর দিন তা ১৩০ কোটি মানুষের কাছে মসৃণভাবে পৌঁছে দেয়া আরেক কথা৷ তবে যে হারে ভ্যাকসিন আসবে, তাতে দেশের সকলের ভ্যাকসিন পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে৷
এখানেই শেষ নয়৷ ভ্যাকসিন নেয়ার পর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে৷ খুবই তড়িঘড়ি করে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে৷ একমাত্র অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের রিপোর্ট হলো, তা বয়স্কদের উপর ভালো কাজ করছে৷ বাকিদের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো রিপোর্ট নেই৷ এরপর প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে পরে তা সারাবার জন্য যে খরচ করতে হবে, সেটা কে দেবে? ক্যানাডা সরকার ঘোষণা করেছে, এই খরচ বিমা কোম্পানি দেবে৷ কিন্তু ভারতে তো তেমন কোনো ঘোষণা হয়নি৷ তাই প্রতিক্রিয়া হলে, তা সারাবার জন্য হাসপাতালের খরচ গুণতে তো আম জনতাকে পাগল হয়ে যেতে হবে!
ফলে সাধু সাবধান৷ ভ্যাকসিন এসে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, করোনা পালাবে বলে যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের অতটা উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ অন্তত ভারতে৷ সমস্যা অনেক৷ পদে পদে পুরো প্রক্রিয়া ঘেঁটে যেতে পারে, ঢুকে যেতে পারে রাজনীতি৷ আর প্রাথমিকভাবে ৩০ কোটি মানুষের জন্য ৬০ কোটি ভ্যাকসিন জোগাড় করে তাঁদের দিতেই কালঘাম ছুটে যাবে৷ তখনো বাকি থাকবে একশ কোটি লোকের ভ্যাকসিন নেয়া৷
করোনায় কাবু সরকার প্রধানরা
বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেক ব্যক্তিই করোনার কাছে হেরে গেছেন৷ এই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে৷ সবশেষ এই দলে যোগ দিয়েছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ৷
ছবি: Olivier Matthys/AP Photo/picture alliance
সোফি গ্রেগরি ট্রুডো
গত মার্চে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগরি ট্রুডো৷ এরপর ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে ছিলেন জাস্টিন ট্রুডো নিজেও৷ তবে তিনি বা তিন সন্তানের কেউ করোনা সংক্রমিত হননি৷
ছবি: Reuters/P. Doyle
প্রিন্স দ্বিতীয় আলবার্ট
মোনাকোর প্রিন্স দ্বিতীয় আলবার্ট রাজ পরিবার এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি৷ মার্চে তার করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/MediaPunch/D. Van Tine
বরিস জনসন
শুরুতে করোনাকে পাত্তা না দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ প্রধান বিশ্ব নেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম করোনায় আক্রান্ত হন৷ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে এপ্রিলের শুরুতে তাকে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়৷
ছবি: Photoshot/picture-alliance
মিখাইল মিশোস্টেন
এপ্রিলের শেষে করোনা শনাক্ত হয়েছিলেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশোস্টেন৷ ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে৷ তার অবর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন আন্দ্রেই বেলোসোভ৷
ছবি: Reuters/Sputnik/E. Shtukina
নুনো গোমেজ নাবিয়াম
এপ্রিলেই করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন গিনি-বিসাউ এর প্রধানমন্ত্রী নুনো গোমেজ নাবিয়াম৷ তার মন্ত্রীসভার তিন সদস্যেরও কোভিড পজিটিভ শনাক্ত হয়েছিল সেসময়৷
ছবি: DW/B. Darame
হুয়ান অর্লান্দো হার্নান্দেজ
জুনে নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট হুয়ান অর্লান্দো হার্নান্দেজ৷ পরবর্তীতে করোনা শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়৷ করোনার টিকায় বিশ্বের সবার সমান অধিকার নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন তিনি৷
ছবি: AFP/O. Sierra
নিকোল পাশেনিয়ান
পুরো পরিবারসহ জুনে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশেনিয়ান৷ তবে আক্রান্তের খবর প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই ভাইরাসমুক্ত হয়েছেন বলে ফেসবুকে ঘোষণা দেন তিনি ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Druzhinin
জেইর বলসোনারো
শুরুর দিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো করোনা সংকটকে ‘উদ্ভট কল্পনা’ এবং সাধারণ ফ্লু হিসেবে অভিহিত করেছেন৷ পরবর্তীতে দেশটি মারাত্মকভাবে করোনা আক্রান্ত হয়৷ জুলাইতে এসে বলসোনারো নিজেই করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন৷
ছবি: Youtube/TV BrasilGov
আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো
করোনা প্রতিরোধে যেসব দেশের সরকার তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়নি তার একটি বেলারুশ৷ দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো করোনা মহামারিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন৷ করোনা প্রতিরোধে ভদকা পানেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি৷ জুলাইর শেষ দিকে নিজে করোনা আক্রান্ত বলে ঘোষণা দেন লুকাশেঙ্কো৷ জানান, কোভিড পজিটিভ হলেও তার তেমন কোন লক্ষণ নেই৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/V. Listsyn
আলেখান্দো গিয়ামাত্তে
সেপ্টেম্বরে গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট আলেখান্দো গিয়ামাত্তের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়৷ এরপর গোটা মন্ত্রীসভার সদস্যদের করোনা পরীক্ষার নির্দেশ দেন তিনি৷ যার মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রীরও করোনা ধরা পড়ে৷
ছবি: Johan Ordonez/AFP
ডনাল্ড ট্রাম্প
দুই অক্টোবর নিজের ও ফাস্ট লেডি মেলানিয়ার করোনা পজেটিভের খবর দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে৷ শুরু থেকেই করোনা ভাইরাসের হুমকিকে খাটো করে দেখানোর জন্য সমালোচিত হয়ে আসছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: Carlos Barria/Reuters
এমানুয়েল মাক্রোঁ
১৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে৷ তার কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়৷ তাদের তথ্য অনুযায়ী, মাক্রোঁ সাত দিনের আইসোলেশনে রয়েছেন৷ তার বেশ কিছু বিদেশ সফর ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে৷ লেবানন সফরও রয়েছে বাতিল হয়ে যাওয়া সফরের তালিকায়৷