ভ্যাটিকানের মতো সুফি মুসলমানদের জন্য ক্ষুদ্ররাষ্ট্র হচ্ছে
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এডি রামা সম্প্রতি বলেছেন, সুফি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বেকতাশি মুসলমানদের জন্য তিনি রাজধানী তিরানায় একটি সার্বভৌম ক্ষুদ্ররাষ্ট্র গঠন করতে চান৷
বিজ্ঞাপন
বেকতাশিরা তার এই চাওয়াকে স্বাগত জানালেও অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন৷
২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি তার এই পরিকল্পনার কথা জানান৷ এই সময় তিনি আলবেনিয়ার নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসার উদ্ধৃতি ‘‘আমাদের মধ্যে সবাই অনেক বড় কিছু করতে পারবে না, কিন্তু আমরা সবাই ভালোবাসা দিয়ে ছোট ছোট অনেক কিছু করতে পারবো'' ব্যবহার করেন৷
এডি রামা বলেন, ইটালির রাজধানী রোমে অবস্থিত ভ্যাটিকান সিটির আদলে এটি প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার নাম হবে ‘দ্য সভরেন স্টেট অফ বেকতাশি অর্ডার’৷
তেরশো শতাব্দীতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় বিকশিত হয় সুফিবাদ ও বেকতাশি আদর্শ৷ ১৯২৯ সালে আলবেনিয়াতে বেকতাশি আদর্শের প্রধান কার্যালয় বেকতাশি ওয়ার্ল্ড সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়৷
তিরানার ২৭ একর জায়গা জুড়ে ক্ষুদ্ররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে আলবেনিয়ার সরকার৷ এই রাষ্ট্রের নিজস্ব সীমানা, পাসপোর্ট ও প্রশাসন থাকবে৷
অসাধারণ উদ্যোগ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে সবাই
বেকতাশিদের নেতা এডমন্ড ব্রাহিমাজ, যিনি ভক্তদের কাছে বাবা মণ্ডি হিসবে পরিচিত, তিনি বলেন ‘‘এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ৷’’ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও শান্তি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি৷ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন ‘‘বেকতাশি অর্ডার শান্তি, সহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির কারণে সমাদৃত৷ ভ্যাটিকানের মতো সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে তা আমাদের ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কাজের জন্য সহায়ক হবে৷’’
অকল্পনীয় সিদ্ধান্ত
আলবেনিয়া সরকারের এই পরিকল্পনা সম্পর্কে দেশটির জনগণ ও সেখানকার নীতি নির্ধারকদের অনেকেই কিছু জানতো না৷ এই সিদ্ধান্তে অনেকেই তাই বেশ অবাক হয়েছেন৷ জার্মানির টুবিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুলসিম ধর্মতত্ত্ব এর গবেষক বেজনিক জিনানি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন ‘‘সমসাময়িক ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে এটি অকল্পনীয় ছিল৷’’
হযরত শাহজালালের দরগাহর ভেতর-বাহির
৩৬০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে সিলেট অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করতে এসেছিলেন বিখ্যাত সুফি দরবেশ শেখ শাহজালাল কুনিয়াত মুজাররদ। তার নামানুসারে দরগাহর নাম দেয়া হয় ‘দরগাহ-এ-হযরত শাহজালাল (র.)৷ পবিত্র এই দরগাহটি দেখে নিন ছবিঘরে...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হযরত শাহজালাল (র.)-এর আগমনের ইতিহাস
হযরত শাহজালাল (র.)-এর সমাধিতে ফার্সি ভাষার ফলক-লিপির তথ্য অনুযায়ী তিনি ১২৭১ সালে ইয়েমেনে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম প্রচারের বিষয়টি স্বপ্নে পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁর মামা সৈয়দ আহমদ কবিরের নির্দেশে ১৩০৩ সালে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মূল মাজার
ধারণা করা হয়, ইসলাম প্রচারে ভারতবর্ষে এসে হযরত শাহজালাল (র.) ১৩৪১ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর তাঁকে সিলেটে সমাহিত করা হয়। মূল মাজারের পাশেই তাঁর মুরিদের ৪টি কবরও রয়েছে। মূল মাজারে দর্শনার্থীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু আদব মেনে চলতে হয়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
৭০০ বছরের পুরানো কবরস্থান
হযরত শাহজালালের দরগাহর পাশেই রয়েছে একটি বড় কবরস্থান। ৩৫ বছর ধরে গোরখোদকের কাজ করা ইদন মিয়া বলেন, মাজারের স্থানে আস্তানা গড়ার পর থেকে, অর্থাৎ ৭০০ বছরের অধিক সময় ধরে এই কবরস্থান আছে। তবে সর্বমোট কত কবর ধরে আছে এখানে, তা কেউ জানেন না।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দরগাহকেন্দ্রিক ব্যবসা
সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রে দরগাহগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান সড়কের পাশেই মাজারকে কেন্দ্র করে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, আতর-তসবির দোকান গড়ে উঠেছে। এছাড়া দূর দুরান্তের মানুষের মাজারে যাতায়াতের সুবিধার জন্য বিভিন্ন দূরপাল্লার পরিবহণ কোম্পানির বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে সেখানে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাজারের ডেগ
সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে প্রবেশ করতেই ডান দিকে চোখে পড়বে একটি ছোট কক্ষ। সেখানে প্রবেশ করতেই দেখা যায় তিনটি বড় পিতলের ডেগ বা হাঁড়ি। সেখানে দায়িত্বে থাকা একজন বলেন, সবচেয়ে বড় ডেগটি সুফি বাবার আমলে বসানো, বাকি দুটি পরে বসানো হয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নারীদের জন্য নামাজের পৃথক ব্যবস্থা
শাহজালালের দরগায় প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই মূল মাজারের সিঁড়ি ঘেঁষে চোখে পড়বে মহিলাদের নামাজের পৃথক ব্যবস্থা। এছাড়াও হাজারখানেক নারীর নামাজ পড়ার জন্য বড় কক্ষ রয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিবারের সঙ্গে প্রথমবার মাজারদর্শন
সুনামগঞ্জ থেকে পরিবারের সঙ্গে প্রথমবারের মতো মাজারে এসেছেন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আয়েশা আক্তার। তার সঙ্গে আসা বড় বোন সাবিনা ইয়াসমিন জানান, আগে প্রায়ই মাজারে আসা হলেও করোনার পর এই প্রথম তারা মাজারে এলেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পুকুরে গজার মাছ
মাজারের উত্তরদিকে একটি পুকুর রয়েছে। কথিত আছে, হযরত শাহজালাল ৩৬০ আওলিয়া নিয়ে সিলেট আসার সময় গজার মাছ নিয়ে আসেন। পুকুরের শোভাবর্ধনকারী এসব গজার মাছ ভেসে বেড়াতে দেখে দর্শনার্থীরা আনন্দ পান এবং মাছগুলোকে খাবার খেতে দেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জালালি কবুতর
হজরত শাহজালাল (র.) ইসলাম প্রচারে ভারতবর্ষে আসার পর ঘটনাক্রমে নিজামুদ্দীন আউলিয়া তার আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দীন আউলিয়া তাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার এখন সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর৷ কবুতরগুলো ‘জালালি কবুতর’ নামে পরিচিত।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাজারে যে বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন
প্রতিদিন মাজারে সহস্রাধিক মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। মূল মাজার পরিদর্শন, নামাজ পড়া ইত্যাদির ভিড়ে অনেকেই মোবাইল, মানিব্যাগসহ মূল্যবান জিনিস যেন না খোয়ান সে ব্যাপারে মাজারের বিভিন্ন জায়গায় সাবধানতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানত
অনেকেই মাজারে যান মানত করে৷ সেদিন স্বামী-সন্তানসহ এসেছিলেন দিলারা বেগম। তিনি জানান, প্রতি ২-৩ মাসে একবার আসেন এই দরগাহতে। এবার সন্তানের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করে একটি মোরগ মানত করেছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
খাবারের আয়োজন
শাহজালালের দরগাহ শরীফে প্রায় ১০ বছর যাবত রান্নার কাজ করেন তোরাব আলী। তিনি জানান, সিলেটে ব্যাপক বন্যা এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের হাতে টাকাপয়সা কম থাকায় এখণ দর্শনার্থী তুলনামূলকভাবে কম আসছেন। তবুও তারা শুক্রবার প্রায় ৪-৫ হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন করে থাকেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভিক্ষুক ও সন্ন্যাসীদের আধিক্য
দরগার ভিতরে কিছুদূর পরপরই বিভিন্ন বয়সি ভিক্ষুক এবং সন্ন্যাসী দেখা যায়। তারা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে খাবার এবং টাকা চেয়ে নেন। অনেক দর্শনার্থীই বিষয়টি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এখানে এলে মনে শান্তি পাই’
কাঁচামাল ব্যবসায়ী রুহুল আমিন হযরত শাহজালালের দরগাহতে এসেছিলেন সিলেটের জিন্দাবাজার থেকে। প্রায়ই তিনি মাজারে আসেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখানে এসে বাবার উছিলায় আল্লাহর কাছে মনের আশা জানাই। মাঝে মাঝে পরিবারকে নিয়েও আসি। এখানে আসলে মনে অন্যরকম একটা শান্তি পাই।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
14 ছবি1 | 14
ধর্মীয় সম্প্রীতিতে প্রভাব পড়বে?
এই উদ্যোগের কোনো নেতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়বে না বলে মনে করেন আলবেনিয়ার বাসিন্দারা৷ আলবেনিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার জন্য বেশ পরিচিত৷ দেশটিতে খুব কাছাকাছি দূরত্বেই গির্জা ও মসজিদের উপস্থিতি চোখে পরে৷ দেশটিতে আন্তঃধর্মীয় বিয়েকেও বেশ সাদরে গ্রহণ করা হয়৷
২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুসারে আলবেনিয়ার জনসংখ্যা ২৪ লাখ৷ যার মধ্যে অর্ধেকই মুসলিম ধর্মের অনুসারী৷ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই সুন্নি মতাদর্শের অনুসারী, যার মধ্যে আনুমানিক ১০ শতাংশ মুসলিম বেতাকশি সম্প্রদায়ের৷ বাকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোমান ক্যথলিক ও অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী রয়েছেন৷ আলবেনিয়াতে ঐতিহাসিকভাবে বেতাকশি সম্প্রদায়ের লোকদের মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মঝে সেতু বন্ধনকারী হিসেবেই দেখা হয়৷