1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

ভ্যাটের হার বাড়ানো কি সংস্কারের অংশ?

আসজাদুল কিবরিয়া দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক৷
আসজাদুল কিবরিয়া
১৭ জানুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশে অন্তর্বতীকালীন সরকার শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

ধনী ও গরিব মানুষেরা একই হারে ভ্যাট দেওয়ায় তাতে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকেছবি: Mortuza Rashed/DW

দেশে যখন উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি বিরাজমান এবং সুদের হার বাড়িয়ে টাকার সরবরাহ কমানোর জোর চেষ্টার পরও তা নামছে না, তখন কর ও শুল্ক হার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। যদিও গতানুগতিক সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে যে এসব কর ও শুল্ক হার বাড়ানোয় জনজীবনে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

কেন এই কর ও শুল্কহার বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ল? – এই প্রশ্নের একটা সহজ জবাব ঘুরে-ফিরে আসছে যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর চাপে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আইএমএফের কাছ থেকে তিন বছর মেয়াদে মোট ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার একটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। গণজাগরণের মুখে পতিত হাসিনা সরকার ২০২৩ সালে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে। তখন ২০২৩-২০২৬ মেয়াদে কয়েক কিস্তিতে বিভিন্ন শর্তপূরণ সাপেক্ষে মোট ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ দিতে সম্মত হয় আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। এসব শর্তের অন্যতম হলো কর ও শুল্কহার বাড়ানোসহ করের আওতা বাড়ানো। তারই অংশ হিসেবে এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শতাধিক পণ্য ও সেবার শুল্ক ও কর বাড়ালো।

অবশ্য, এসব পণ্য ও সেবার একটা অংশকে কম প্রয়োজনীয় বলেই বিবেচনা করা যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর প্রাক্কলন অনুসারে, আগামী ছয় মাসে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আসবে সিগারেট, কৃত্রিম স্বাদ ও কার্বোনেটেড কোমল পানীয়র মতো পণ্য থেকে যেগুলো স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় উপকারী নয়। আকাশপথে ভ্রমণে বিমান ভাড়ায় আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে যা থেকে এক হাজার কোটি টাকা আসবে বলে প্রত্যাশা। আবার ফলের রস, ফলজাত পানীয়, আপেল, মালটা, বিভিন্ন ধরণের টিসু পেপারের ওপরেও শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়েছে। এগুলো বহু মানুষের কাছে নিত্যপণ্যের মতো বটে আর তাই তাদেরকে বাড়তি অর্থ গুণতে হবে । নন-এসি হোটেল, মিষ্টির দোকান, রেস্তোঁরার ওপরেও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে যা হোটেলে থাকা-খাওয়া আগের চেয়ে ব্যয়বহুল করবে। এলপি গ্যাসের দামও বাড়বে বাড়তি করের কারণে। ইন্টারনেট সেবা ব্যবহারের খরচ বাড়বে বাড়তি ভ্যাট বসায়। অবশ্য প্রতিবাদের মুখে রেস্তোঁরায় ভ্যাট না বাড়ানোর কথা জানিয়েছে এনবিআর। হয়তো আরো কিছু পণ্যে বর্ধিত ভ্যাট বা শুল্ক প্রত্যাহার করা হতে পারে।

সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শতাধিক পণ্য ও সেবার মধ্যে কিছু পণ্য ও সেবা জনজীবনে সরাসরি তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, এসব পণ্য ও সেবার ভোক্তা হলো মূলত উচ্চ আয়ের মানুষজন। আবার কিছু পণ্যের দাম বাড়ায় তার ভোগ কমবে, যা কোনো ক্ষতি বয়ে আনবে না। তবে কিছু পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে তা সাধারণ মানুষের কষ্ট কিছুটা বাড়াবে। তার মানে শুল্ক ও কর বাড়ানোর ফলে গণহারে সব মানুষের ভোগান্তি বাড়ার কথা নয়, বরং এখানে একটা মিশ্র প্রভাব পড়ার কথা। তবে ভ্যাট বাড়ানোর মানে হলো, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো যা রাজস্ব আদায় বাড়ানোর তুলনামূলক সহজপথ। ধনী-গরিব নির্বিশেষে একই হারে ভ্যাট দেয় ও দেবে।

বড় সমস্যা হলো, এমন একটি সময়ে এই কর ও শুল্ক বাড়ানো হলো, যখন মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে এবং তা নিম্নমুখী হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় খেয়ে ফেলছে। এই প্রবণতা তিন বছর ধরে বেশ জোরালভাবে চলছে । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, যেখানে ২০২৩ সালে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, সেখানে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের সামান্য ওপরে থেকেছে। আবার ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ যখন গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের আশে-পাশে ঘোরাফেরা করেছে।

মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বশে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। সামনেই নতুন অর্ধবার্ষিক মুদ্রানীতির ঘোষণা আসছে যেখানে এই নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা হবে বলেই ধারণা করা যায়। সোজা কথায়, বাজার টাকার সরবরাহ কমিয়ে সামগ্রিক চাহিদাকে কিছুটা প্রশমিত করার মাধ্যমে বাজারের চড়া দর একটু সহনীয় করে আনার চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত এতে তেমন সুফল মেলেনি। বরং, বিনিয়োগ ও ব্যবসার খরচ বেড়েছে। ফলে সামনে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুফল কতোটা মিলবে, তা দেখার বিষয়। এমতাবস্থায় কিছু পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো হলে তা সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে।

যেহেতু বাংলাদেশে বাজার তদারকীর প্রক্রিয়াটি দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ, সেহেতু একটি পণ্যের দাম বাড়লে তা অনেক সময় আরো কিছু পণ্যের দাম বাড়ার নিয়ামক হয়ে ওঠে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। এতে করে সাধারণ ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সে কারণেই এবারের কর ও শুল্ক বাড়ানোর আওতায় আসা পণ্য ও সেবাগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আরো কিছু পণ্য ও সেবার দামও বেড়ে গিয়ে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজারদর আরেকদফা বেড়ে যাওয়ার চাপ। পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে আর দেড় মাসও নেই। ভরা মৌসুম চলায় শীতকালীন সবজির দাম এখন অনেক নেমে এসেছে। শিগগিরি পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তাতে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হওয়া বাধাগ্রস্ত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক্ষেত্রে আদৌ কিছু করতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে।

শীতকাল চলে যাচ্ছে। গরমকাল আসছে। তাতে করে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমাগত বাড়বে। তখন আরেক সমস্যা দেখা দেবে। স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া অদক্ষ ও ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে চড়া দরে বিদ্যুৎ আমদানির অর্থ জোগাতে আগের মতো গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

অন্যদিকে, ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মহার্ঘ ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ন্যূনতম ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে এই ভাতা দেয়ার জন্য সরকারের ব্যয় হবে সাত হাজার কোটি টাকা যা জুন মাসের আগেই দেয়া হবে। তাহলে কি এই টাকার সংস্থান করতেই কর ও শুল্ক হার বাড়ানো হলো? ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সাত হাজার কোটি টাকা বা প্রায় ৬০ শতাংশইতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দিতে চলে যাবে। বস্তুত আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা ছাড়া আর কোনো কারণই নেই এই সময়ে এই ভাতা দেয়ার। হাসিনা সরকার আমলাতন্ত্রকে অনুগত রাখতে অতিমাত্রায় সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে দফায় দফায়। পাশাপাশি দুর্নীতি করতেও উৎসাহ যুগিয়েছে। এর কুফল ভুগতে হচ্ছে জনসাধারণকে

দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে গত দেড় যুগে যে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে দেশ থেকে, তার কিছুটা যদি সামনের দিনগুলোয় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়, তাহলে সরকার হয়তো একটু স্বস্তি পাবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায়। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণের জোগান বাড়লে তাও সাময়িকভাবে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াবে এবং লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ কমাবে। সার্বিকভাবে জনসাধারণের জীবনযাত্রার ব্যয় একটু সহনীয় হবে। আর এটাই সবার প্রত্যাশা। সংবিধান, সমাজ, গণমাধ্যম আর অর্থনীতি সংস্কারের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় সময় ক্ষেপণ করার চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এদিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি। জরুরি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোয় জোর দেয়া যার সাথে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে চলার একটি সম্পর্ক রয়েছে। এমতাবস্থায় সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে জনগণকে তুষ্ট করার প্রয়াস কতোটা সুফল দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ