বাংলাদেশ যদি এখনই সতর্ক না হয় তাহলে করোনা পরিস্থিতি ভারতের চেয়েও ভয়াবহ হবে বলে মনে করেন জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সভাপতি৷ তাই তারা সারাদেশে ১৪ দিনের শাটডাউনের সুপারিশ করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু লকডাউন বা শাটডাউন যা-ই হোক না কেন, মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করবে কে? আর যারা গরিব মানুষ, তাদের খাবারের সংস্থানই বা হবে কিভাবে?
সাধারণ মানুষ তো বিধিনিষেধ মানছেনই না৷ মানছেন না দায়িত্বশীলরা৷ ফরিদপুরে এখন কড়া বিধিনিষেধ চললেও তার মধ্যেই বৃহস্পতিবার জনসভা করেছেন সাবেক এমপি এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলির সদস্য আব্দুর রহমান৷ ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার আয়েশা শরিয়ত উল্লা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন৷ কয়েক হাজার লোকের উপস্থিতিতে তিনি সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যও দেন৷ তিনি নিজে মাস্ক ব্যবহার করেননি, আর যারা উপস্থিত ছিলেন তারাও করেননি৷ ছিলনা কোনো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই৷
এ নিয়ে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি৷ মোবাইল ফোনে এসএমএস-এরও জবাব দেননি তিনি৷
তবে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ বলেন, ‘‘কড়াকড়ি আরোপের আগেই শুধু ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের অনুমতি নিয়েছিল তারা৷ কোনো সমাবেশের কথা ছিল না৷ কিন্তু কড়াকড়ি আরোপের পর তাদের অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ করেছিলাম, তারা শোনেননি৷ আমি নিজেও তাকে ফোনে চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু ফোনে পাইনি৷ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠানের দিন এসি ল্যান্ডকেও পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু কাজ হয়নি৷ তারা অনুষ্ঠান করেছেন৷’’
তাদের অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ করেছিলাম, তারা শোনেননি: বোয়ালমারী ইউএনও
তিনি জানান, এখনো এনিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে৷ ওই সমাবেশের কারণে করোনায় বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি৷
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের হার শতকরা ১০-এর নীচে নেমে গিয়েছিল৷ আর প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা নেমেছিল এক হাজারের নীচে৷ কিন্তু এখন সংক্রমণের হার ২২.২১ ভাগ আর প্রতিদিন সংক্রমণ প্রায় ছয় হাজার৷ মৃত্যুহার ১.৫৯৷ গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে করোনায় মারা গেছেন ১০৮ জন, যা এই বছরে সর্বোাচ্চ৷ আর শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৬৯ জন৷
গ্রামাঞ্চলেও এখন করোনা ছড়িয়ে পড়েছে৷ খুলনা এখনো মৃত্যুর শীর্ষে আছে৷ গত ২৪ ঘন্টায় সেখানে মারা গেছেন ২৭ জন৷ ঢাকা ২৫ জন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে৷ বরিশাল বিভাগে কেউ করোনায় মারা যাননি৷
জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সভাপতি ডা. মো, শহীদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতি তাতে সংক্রমণ ঠেকানো না গেলে যে অবস্থা হবে তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না৷ ভারতের চেয়েও খারাপ হবে৷ তাই আমরা ১৪ দিনের জন্য পুরো দেশ শাটডাউনের সুপারিশ করেছি৷’’
এই শাটডাউন কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘জরুরি ওষুধ এবং খাদ্য সরবারাহ ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকবে৷ মানুষকে ঘরে থাকতে হবে৷ তা না হলে আমরা এখন যে জীবিকার কথা বলছি, খাদ্যের কথা বলছি, তার জন্য লোক থাকবে না৷ জীবন না থাকলে জীবিকা দিয়ে কী হবে?’’
ভারতের চেয়েও খারাপ হবে: টেকনিক্যাল কমিটির সভাপতি ডা. মো. শহীদুল্লাহ
তিনি বলেন, এর আগে সরকার কখনো লকডাউন, কখনো বিধিনিষেধ আরোপ করেছে৷ কিন্তু কোনোটাতেই কাজ হয়নি৷ কারণ, লকডাউন দিয়ে যদি সব কিছু খুলে রাখা হয় তাহলে তো কাজ হবে না৷ কাজ হয়ও নাই৷ তাই সত্যিকার অর্থে শাটডাউন দরকার৷ এটা ১৪ দিন করতে পারলে সংক্রমণ কমে যাবে৷ স্বাভাবিক হয়ে আসবে৷ বাঁচতে হলে যে-কোনো উপায়ে এটা করতে হবে৷’’
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, সরকার কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শাটডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ যেকোনো দিন থেকে এই শাটডাউন শুরু হতে পারে৷ জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে৷ কিন্তু নানা প্রেশার গ্রুপ এর বিরুদ্ধে কাজ করছে৷ তারা জীবিকা ও অর্থনীতির প্রশ্ন তুলছেন৷
তবে এই শাটডাউন দিয়ে দরিদ্র মানুষকে ঘরে রাখতে হলে তাদের খাদ্য সহায়তা দিতে হবে৷ আর যাদের অবস্থা ভালো তাদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে৷ বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর তিন কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে৷ করোনায় আরো দুই কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে গেছে৷ তাদের পক্ষে ১৪ দিনের খাবার মজুত করা সম্ভব নয়৷ যদি শাটডাউন শুরু হয় তাহলে তাদের খাদ্যের সংস্থান কী হবে সরকার এখনো সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি৷ এখন করোনায় বিশেষ কোনো খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও নেই৷ প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পগুলোই চলছে৷ তবে সঠিক তথ্যভাণ্ডার না থাকায় বড় একটি অংশ এই কর্মসূচির আওতায় নেই৷
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘যদি আগের মতো লকডাউন বা শাটডাউন হয়, তাহলে তো আর কোনো কথা নেই৷ কিন্তু সত্যিকার অর্থে শাটডাউন হলে গরিব মানুষের খাবার বা অর্থের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে আগে৷ আর যারা দারিদ্র্য সীমার একটু উপরে আছে, তাদেরও দেখতে হবে৷ দেখতে হবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের৷ আর খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে৷’’
নিম্ন আদালত ভার্চুয়াল থেকে আবার বাস্তবের মাটিতে
করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই প্রায় আড়াই মাস পর গত রোববার থেকে আবার সকল অধস্তন বা নিম্ন আদালতে শারীরিক উপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে৷ আদালতপাড়ার সবাই কী চোখে দেখছেন বিষয়টিকে?
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আদালত নিয়মিত না চললে সবার ক্ষতি’
ঢাকার এক নিম্ন আদালতের মুহুরি মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘‘আদালত নিয়মিতভাবে পরিচালিত হলে সবকিছু ‘মেন্টেন’ করতে সুবিধা হয়৷’’ এভাবে বারবার আদালত বন্ধ থাকার কারণে চলমান মামলাগুলো আরো দীর্ঘসূত্রিতার মাঝে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এক মামলায় ১১ বছর
ঢাকার জেলা দায়রা জজ আদালতে কথা হলো এক মামলার বিবাদী বাচ্চু মোল্লার সঙ্গে৷ জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় তার শুনানির নির্ধারিত তারিখ ছিল গত এপ্রিল মাসে৷ কিন্তু করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় বিচারকাজ এতদিন বন্ধ ছিল৷ মামলাটি প্রায় ১১ বছর যাবত চলছে জানিয়ে লকডাউনের কারণে আদালত একাধিকবার বন্ধ থাকার বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কোর্ট খুলসে ঠিক, কিন্তু ব্যবসা খারাপ’
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণের চা-দোকানি মো. মনির বলেন, ‘‘কী আর বলবো স্যার, এ বছরের শুরু থেকেই ব্যবসা অনেক খারাপ৷ গতবছর ব্যবসা তা-ও চলসে কোনোরকম, কিন্তু এইবার একদমই পেটে-ভাতে যাইতেসে৷ কোর্ট চারদিন হইলো খুলসে ঠিক আছে, কিন্তু মানুষ নাই৷ লকডাউন আর করোনার কারণে আদালতে আগের ৫ ভাগের এক ভাগ লোকও হইতেসে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘করোনায় জমানো টাকা সব শেষ’
জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে ২০ বছর ধরে স্ট্যাম্প ভেন্ডার হিসেবে কর্মরত আবু ইউসুফ জানান, গত বছর থেকে দুই দফা আদালত বন্ধ থাকায় তাদের আয়ে বড় রকমের ভাটা পড়েছে৷ আদালত বন্ধ থাকায় কোনোরকম আয় হয়নি গত আড়াই মাসে৷ জমানো টাকা যা ছিল, সবই প্রায় শেষের দিকে৷ এখন আদালত খুললেও মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে৷ এই সংকট সামনের বছরেও কাটবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ভার্চুয়াল আর একচুয়াল তো এক বিষয় না’
২১ বছর ধরে পেশকার হিসেবে কর্মরত মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা যে-কোনো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য৷ তবে আদালত চালু থাকলে সেটা বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের জন্যই ভালো৷ সবকিছু তো অনলাইনে করা সম্ভব না, এতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়৷ আমরা স্বাস্থ্যবিধি যতটুকু মানা সম্ভব সেটা মেনে জনগণকে সেবা দিচ্ছি, এতে কোনো অবহেলা করা হচ্ছে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমার মামলার রায় এতদিনে হয়া যাইতো’
ঢাকার বাড্ডা নতুন বাজার থেকে মুনমুন বেগম তার চার বছরের সন্তানকে নিয়ে আদালতে এসেছেন৷ এসেছেন সন্তানের পিতৃপরিচয় নিশ্চিতে ডিএনএ-র নমুনা বিষয়ে আদালতের আদেশের জন্য৷ তিনি জানাস, স্বামী সন্তানের ভরণপোষণ দিচ্ছে না, তাই দুই বছর আগে এ মামলা করেন৷ আদালত বন্ধ থাকার কারণে মামলার আদেশের তারিখও পাচ্ছিলেন না৷ তার মতো আরো অনেকেরই এই ভোগান্তি হচ্ছে বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘দৈনিক খরচ উঠানোই দায়’
জেলা ও দায়রা জজ কোর্ট প্রাঙ্গণের ভ্রাম্যমাণ হকার মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘১৫ কিলোমিটার দূর থেকে প্রতিদিন এখানে আসি দোকানে৷ যদি ব্যবসা-বাণিজ্য এমন খারাপ চলতেই থাকে, তাহলে অন্য কিছু করতে হবে৷ মাঝের দুই মাস বাসাতেই বেকার বসা আছিলাম৷ এখন কোর্টে মানুষ নাই, মাস্ক টুকটাক যা বিক্রি হয়, দিনের খরচাপাতি উঠানোই দায় হইয়া গেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আদালত খুলে দেওয়াকে সমর্থন করি না’
ঢাকার নিম্ন আদালতের আইনজীবী নূর মো. মাহবুবুর রহমান আদালত খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘করোনার এই পরিস্থিতিতে আদালত এভাবে খুলে আমাদের সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে৷ আমার দুইজন কলিগ মারা গেছেন করোনায়, অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন ইতিমধ্যে৷ কোর্ট খুলে দিলে আমরা আসতে বাধ্য, কিন্তু সবাই আতঙ্ক নিয়েই কাজ করছি৷ পেশাগত ক্ষতি বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে, তাই বলে জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু হতে পারে না৷’’
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নেজারত বিভাগের প্রধান নাজির মো. শাকিলুর রহমান বলেন, ‘‘অনলাইনে বিচারকাজ পরিচালনা করা যায়, কিন্তু সেটি যথাযথ হওয়া কঠিন৷ অনেক সময় বিচারকগণ অপরাধীদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ দেখে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ তাছাড়া মোটামুটি সবই খোলা আছে, এক্ষেত্রে আদালতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় আমি ভুল কিছু দেখছি না৷’’