চার বছর আগে এই দিনে প্রচণ্ড ভূমিকম্প, সুনামি আর পারমানবিক কেন্দ্র বিস্ফোরণে বিপর্যয় নেমে এসেছিল জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে৷ ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া সেই দিনটিকে স্মরণ করছে শোকসন্তপ্ত জাপান৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার এক মিনিটের জন্য নীরব ছিল জাপান৷ গত তিন বছরও এমনই হয়েছে৷ ২০১১ সালের ১১ই মার্চ ঠিক ২টা ৪৬ মিনিটে শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড ভূমিকম্প৷ রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার সেই ভূমিকম্পের ফলে শুরু হয় সুনামি৷ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফুকুশিমার পারমাণবিক কেন্দ্র৷ পারমানবিক চুল্লি ছিদ্র হয়ে যায়৷ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বিশাল এলাকায়৷ সুনামিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর হোক্কাইডো থেকে শুরু করে ওকিনাওয়া পর্যন্ত এলাকার প্রায় সব ঘর-বাড়িই ধ্বংস হয়ে যায়৷ সেদিনের সেই প্রাকৃতিক এবং পারমানবিক চুল্লির বিপর্যয়ে মারা যায় প্রায় ১৮ হাজার ৫শ' মানুষ৷ অন্তত ২ হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ৷ বুধবার ঠিক ২টা ৪৬ মিনিটে এক মিনিট নীরবতা পালন করে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাপান৷
রাজধানী টোকিয়োতে আয়োজিত স্মরণসভায় জাপানের সম্রাট আকিহিতো চার বছর আগে প্রাণ হারানো মানুষদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক লক্ষ মানুষের প্রতি সমবেদনা জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘সেদিন টেলিভিশনের পর্দায় যে দৃশ্য দেখেছি তা কোনোদিনই আমরা ভুলতে পারবোনা৷'' প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং ফুকুশিমা বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্তরাও এ স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন৷
চার বছর পেরিয়ে গেলেও ফুকুশিমা বিপর্যয়ের রেশ এখনো কাটেনি৷ ফুকুশিমার দায়িচি পারমানবিক চুল্লির আশপাশের এলাকায় এখনো তেজষ্ক্রকীয়তা ছড়িয়ে থাকায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ নিজেদের ঘরে ফিরতে পারছেননা৷ তখন ঘর হারানো ২ লক্ষ ২৮ হাজার মানুষ এখনো বাস করছেন অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images
11 ছবি1 | 11
জাপানে মোট ৪৮টি পারমানবিক চুল্লি রয়েছে৷ ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর থেকে সবগুলোই নিষ্ক্রিয়৷ তবে শিনজো আবের সরকার চুল্লিগুলো আবার পর্যায়ক্রমে চালু করতে চায়৷
বুধবারের স্মরণসভার আগে শিনজো আবের সঙ্গে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের এক বৈঠক হয়৷ সেখানে ম্যার্কেল জার্মানির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জাপানকেও ধীরে ধীরে পারমানবিক চুল্লিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার কর্মসূচি হাতে নেয়ার পরামর্শ দেন৷ জাপানের প্রধানমন্ত্রী জানান, তাঁর দেশের পারমানবিক চুল্লি রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ প্রস্তুতি রয়েছে৷ ফুকুশিমা বিপর্যয়ের চার বছর পূর্তির দিনে জাপানের সাধারণ মানুষের কথায় অবশ্য সেরকমের আস্থা দেখা যায়নি৷ আবার কোনো চুল্লিতে চার বছর আগের মতো বিপর্যয় দেখা দেবেনা এটা তাঁরা ধরে নিতে পারছেননা৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো কারণ বা যৌক্তিকতাও নেই৷