বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে, ব্লগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমশ কি একটা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি হচ্ছে? একদিকে ৫৭ ধারা, অন্যদিকে বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়৷ ভয়ের মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷
বিজ্ঞাপন
ইদানীং প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এক অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি আমি, আমার সহকর্মীরা৷ কোন বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে অনেক তথ্য পাওয়া যায়৷ কিন্তু সেসব তথ্য লিখতে গেলেই যত বাধা৷ সুন্দর করে একটি বিষয় বলার পর বক্তব্যদাতা বলে দেন, ভাই আমার নাম উল্লেখ করে এসব লিখবেন না কিন্তু৷ বোঝেনইতো যা অবস্থা এখন৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
আমার সহকর্মী, ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ সেদিন গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়ে বক্তব্য নেবার জন্য এক জায়গায় ফোন করলেন৷ ওয়েবসাইটে পাওয়া নম্বরে ফোন করার পর একজন সেই ফোন ধরলেন, কথা বললেন৷ তবে শেষে বলে দিলেন যা বলেছি তা লিখবেন না৷ পাশাপাশি সেই ব্যক্তি নিজের পরিচয় না দিয়ে আমার সহকর্মীকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন৷ বলেছেন, তিনি তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হতে চান৷ তবে তার বলার ভঙ্গি মোটেই ইতিবাচক ছিল না৷
বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আমার এক সহকর্মীর কথোপকথন শুনছিলাম৷ তাঁর পত্রিকা সমস্যায় পড়েছে৷ অনানুষ্ঠানিকভাবে সবাই জানাচ্ছে সমস্যা কোথায়৷ কিন্তু তিনি কারা সমস্যা তৈরি করেছে তা চমৎকারভাবে এড়িয়ে গেলেন৷ সমস্যা যে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা বাড়বে সেটা জানিয়েছেন পরিষ্কারভাবেই৷ আমি অবাক হয়েছি৷ যার কথা বলছি, তিনি আমাদের মতো সাংবাদিকদের জন্য আদর্শ৷ বুঝতে পারি, কতটা ভয়, কতটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে দেশে, যে এত উঁচু মাপের একজন সম্পাদককে সযত্নে সবার জানা সত্যটা আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে৷ অথচ সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তাঁর পত্রিকা পরিচিত, তাঁর পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি৷
এত গেল মূলধারার পত্রিকার কথা৷ ব্লগের পরিস্থিতি আরো উদ্বেগের৷ তালিকা ধরে চলতি বছর খুন হয়েছেন চার ব্লগার৷ ইন্টারনেটে লেখালেখির উপরে এটা কত বড় ধাক্কা তা যারা এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন, তারা ভালো বোঝেন৷ বাংলাদেশে বড় কোন ঘটনা ঘটলে আগে যতটা প্রতিক্রিয়া হতো, এখন আর তা হয়না৷ নামজাদা ব্লগারদের মধ্যে ‘স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণ' চলে এসেছে৷ রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে লেখালেখি অনেক কমে গেছে৷ অকালে কে জীবন হারাতে চাইবে বলুন৷
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি পর্যবেক্ষক সংগঠন ফ্রিডম হাউসের এক রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে গতকাল৷ রিপোর্টটা তৈরির সময় সংশ্লিষ্ট একজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল৷ আগেই জানতাম, তারা পরিস্থিতি কিছুটা তুলে ধরবেন৷ তবে এই রিপোর্টে যা প্রকাশ হয়েছে, বাস্তব অবস্থা তারচেয়ে অনেক খারাপ৷ সমস্যা হচ্ছে, এটা সবাই জানে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে চাইবে না৷ বোঝেনতো, দেশেই যা অবস্থা...৷