ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা৷ অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, আইনটির প্রয়োজন আছে, তবে অপব্যবহার রোধ করতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের ইউটিউব টক শো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’- এ অংশ নিয়ে তারা এমন মন্তব্য করেন৷ এবারের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘মৃত্যুর ডিজিটাল মিছিল ও প্রধানমন্ত্রীর দায়’৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে আটক লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর দায় থেকে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে মুক্তি পাবেন, শুরুতে এমন প্রশ্ন ছিল তাদের কাছে৷ এই বিষয়ে অধ্যাপক মীজানুর রহমান মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর দায়ের প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের হেফাজতে যখন কেউ মারা যায়, রাষ্ট্রকেই এর ব্যাখ্যা দিতে হবে৷ ব্যাখ্যাটা আগে আসুক কীভাবে মারা গেলেন৷’’ তার মতে, দায় নেয়া মানেই ব্যাখ্যা দেয়া৷ কীভাবে মৃত্যু হলো, কেন মৃত্যু হলো সেই তদন্ত করতে হবে৷ জামিন পাওয়া মুশতাকের অধিকার ছিল৷ মুশতাকের সঙ্গে অন্যরা যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তারা মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু তিনি কেন মুক্তি পেলেন না সেটিও সংশ্লিষ্টদের জানাতে হবে৷
তবে বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন গোলাম মোর্তোজা৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশ পরিচালনা করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এককভাবে, এটা মোটামুটিভাবে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য৷ দেশে যদি ভালো সবকিছুর কৃতিত্ব এক জনের হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হয়, তাহলে এর খারাপ বা নেতিবাচক যে-কোনো কিছুর দায় অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপরে পড়ে৷ তিনি নিজেও বিষয়টি অস্বীকার করবেন বলে আমার মনে হয় না৷’’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৬ মে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ পরদিন ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর' অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত অভিযোগ কী, তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে৷ এই বিষয়ে গোলাম মোর্তোজা বলেন, মুশতাক আহমেদ বা একজন কিশোর ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ মূলত ভয়ের সংস্কৃতি ও সেলফ সেন্সরশিপ যাতে তৈরি হয় সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ এক্ষেত্রে ডিজিটাল আইন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো প্রয়োজন নেই৷ বাংলাদেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে সেই ভয়ের সংস্কৃতির জন্য এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এই আইনটিকে ব্যবহার করে নিপীড়ন করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে৷’’ তিনি মনে করেন, প্রচলিত আইনের মধ্যেই ডিজিটাল মাধ্যমের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব৷
তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন অধ্যাপক মীজানুর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবশ্যই থাকতে হবে৷ তবে যেখানে যেখানে অপব্যবহারের সুযোগ আছে সেগুলো রহিত করতে হবে৷ স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে অপব্যবহারের কোনো সুযোগ না থাকে৷’’ তার মতে, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড রুখতেই এ আইন প্রয়োজন৷
এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা যোগ করেন, ‘‘আমাদের একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা দরকার যে, সরকারের সমালোচনা করা মানেই রাষ্ট্রের বা দেশের সমালোচনা করা নয়৷...সরকার যখন যৌক্তিক সমালোচনার জবাব দিতে পারে না, সেই কারণে সেই সমালোচনাটুকুকে সরকার দেশের বা রাষ্ট্রের সমালোচনা মনে করে খড়গহস্ত হয়৷’’
এফএস/এসিবি
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷