জুলাই মাসে জার্মানির চারটি শহরের মসজিদে বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত সেগুলো ভুয়া প্রমাণিত হলেও মুসলমানদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে৷ ফলে তাঁরা সরকারের কাছে আরও বেশি নিরাপত্তা চাইছেন৷
বিজ্ঞাপন
কোলনে অবস্থিত জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদও হুমকি পাওয়ার তালিকায় ছিল৷ কোলন ছাড়াও ইজালন, ফিলিঙ্গেন-স্ভেনিঙ্গেন ও মিউনিখের মসজিদে হুমকি দেয়া হয়েছিল৷ এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ডুইসবুর্গ, মানহাইম ও মাইনৎস শহরের মসজিদেও বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়৷
এসব ঘটনায় মুসলমানরা ‘খুবই উদ্বিগ্ন' বলে ডয়চে ভেলেকে জানান জার্মানির সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ মুসলিমসের মুখপাত্র নুরহাত সয়কান৷ এই অবস্থায় ‘মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব' বলে মনে করেন তিনি৷
সয়কান বলেন, সব ধর্মের মানুষ যেন নির্ভয়ে তাঁদের ধর্মপালন করতে পারেন, তা জার্মান সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে৷ ‘‘আমাদের অস্তিত্ব যেমন ঝুঁকির মুখে, তেমনি আমাদের গণতন্ত্রও৷ এটা গ্রহণযোগ্য নয়,'' বলেন তিনি৷
সয়কান জানান, মসজিদে নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে৷ তবে সরকার এখনও কিছু করেনি৷
জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদ
জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদটির নির্মান কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে, কোলনে৷ ২০১৭ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে৷ ইতোমধ্যে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই মসজিদ নিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Becker
ইউরোপের অন্যতম বড় মসজিদ
কোলনের কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে পরিচিত এই মসজিদটি ইউরোপের অন্যতম বড় এবং জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদ৷ এটির আয়তন ৪৫০০ বর্গমিটার৷ এতে একসঙ্গে দুই থেকে চার হাজার মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে৷ জার্মানিতে তুর্কি মুসলিমদের সংগঠন ডিটিব মসজিদটি নির্মাণ করেছে৷ নামাজের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সংলাপ, খেলাধুলা আয়োজনের ব্যবস্থা এবং দোকান ও লাইব্রেরি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
ভিন্ন ডিজাইনের মসজিদ
‘নন-অটোমান’ ডিজাইন অনুসরন করে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে৷ এতে কংক্রিট এবং কাঁচের দেয়াল ও গম্বুজ রয়েছে৷ দু’টি মিনারতের উচ্চতা ৫৫ মিটার করে৷ আর মসজিদের ভেতরে দেয়ালে বিভিন্ন ক্যালিগ্রাফি রয়েছে৷
ছবি: Picture alliance/dpa/M. Becker
দীর্ঘদিনের স্বপ্ন
কোলনে বসবাসরত তুর্কিরা দীর্ঘদিন ধরেই এমন এক মসজিদের স্বপ্ন দেখছিলেন৷ তবে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরুর পর নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ এমনকি ২০১১ সালে বিপুল প্রতিবাদের মুখে এটির নির্মাণকাজ কিছুদিনের জন্য মন্থরও করা হয়৷ অভিবাসীবিরোধী চক্র এটি নির্মাণের বিরোধিতা করে৷ তবে পত্রিকার এক জরিপে দেখা যায়, শহরের ৬৩ শতাংশ বাসিন্দা এটি তৈরির পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চোখে পড়ার মতো স্থাপনা
জার্মানিতে প্রায় পাঁচ মিলিয়নের মতো মুসলমান বাস করেন৷ তাঁদের একটি বড় অংশই তুর্কি বংশোদ্ভূত৷ কোলনে বসবাসরত সোয়া লাখ মুসলমানের জন্য সত্তরটির মতো মসজিদ রয়েছে৷ অধিকাংশ মসজিদই এমন জায়গায় তৈরি যা সচরাচর চোখে পড়েনা৷ তবে এই মসজিদটি ব্যতিক্রম৷
ছবি: Picture alliance/dpa/O. Berg
খরচ কম নয়
মসজিদটি তৈরিতে কমপক্ষে সতের মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছে৷ তবে এখনও কিছু কাজ বাকি রয়েছে বলে জানা গেছে৷ এই অর্থের অধিকাংশই দিয়েছে ডিটিব৷ কিছু অর্থ সংগ্রহে সহযোগিতা করেছে একটি গির্জা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Geisler
পল ব্যোম, স্থপতি
কোলন কেন্দ্রীয় মসজিদটির নকশা করেছেন পল ব্যোম৷ তিনি এবং তাঁর বাবা মূলত গির্জার ডিজাইন করার জন্য বিখ্যাত৷ তবে সমজিদটি তৈরির মাধ্যমে তিনি তাঁর দক্ষতাকে অন্যস্তরে নিয়ে গেছেন৷
ছবি: AP
প্রার্থনার এক স্বচ্ছ ঘর
‘উন্মুক্ত’ এবং ‘উজ্জ্বল’৷ মসজিদটির ডিজাইন সম্পর্কে এই দুটো শব্দই উচ্চারণ করেছেন ব্যোম৷ মসজিদটির মধ্যে প্রাকৃতিক আলো নিশ্চিত করতে দেয়ালে প্রচুর কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে৷ আর মসজিদটি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও উন্মুক্ত৷ যেকেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেন৷
ছবি: Lichtblick Film GmbH/Raphael Beinder
জার্মান স্টাইলে তৈরি মসজিদ
কোলনের মানুষ মসজিদটিকে স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘ক্যোলশ ম্যুশি’৷ আর মসজিদটির ডিজাইনেও জার্মান ছোঁয়া রয়েছে৷ প্রচলিত তুর্কি মসজিদগুলো যেরকম, এই মসজিদটি মোটেও সেরকম নয়৷
ছবি: picture alliance / dpa
কিছু শর্ত
কোলন কর্তৃপক্ষ মসজিদটি নির্মাণের অনুমতি দেয়ার পাশাপাশি কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছে৷ এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সেখানে জার্মান ভাষা শিক্ষার আয়োজন থাকতে হবে৷ পাশাপাশি ইমামকে জার্মান ভাষায় দক্ষ হতে হবে৷ আর খুতবা দিতে হবে এমন ভাষায়, যা নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা বুঝতে পারেন৷ মোটের উপর, প্রার্থনায় অংশ নিতে আসা পুরুষ এবং নারীদের সমান মর্যাদা দিতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ২০১৭ সালে জার্মানির ২৩৯টি মসজিদে হামলা হয়েছিল৷ এই সময়ে এক হাজার ৭৫টি ইসলামোফোবিক অপরাধের (ইসলাম ধর্ম নিয়ে ভয়, ঘৃণা ইত্যাদি কারণে করা অপরাধ) ঘটনাও ঘটে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়৷২০১৮ সালের তথ্য এখনও প্রকাশিত হয়নি৷ তবে বাম দলের অনুরোধে প্রকাশ করা তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের প্রথম নয় মাসে ইসলামোফোবিক হামলায় ৪০ ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন৷ আগের বছর একই সময়ে সংখ্যাটি ছিল ২৭৷
সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ মুসলিমসের চেয়ারম্যান আইমান মাজায়েক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ২০১৭ সাল থেকে মুসলমানদের উপর হামলার তথ্য রেকর্ড করা হচ্ছে৷ তখন থেকে হামলার সংখ্যা বাড়ছে৷ শারীরিকভাবে মুসলমানদের আঘাত করা হচ্ছে৷ এই আঘাত দিন দিন আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠছে৷
তিনি বলেন, হামলার সংখ্যা আরও বেশি হবে, কারণ অনেক মুসলমান এসব ঘটনা পুলিশকে জানান না৷
ডানিয়েল হাইনরিশ/জেডএইচ
বার্লিনের মসজিদগুলো...
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ৮০টিরও বেশি মসজিদ রয়েছে৷ ক্লাসিক বা আধুনিক যে ধরনেরই হোক না কেন, এই মসজিদগুলো বার্লিনের নানা অঞ্চলের এবং নানান সময়ের চিহ্ন বহন করে৷
ছবি: Max Zander
ভারতীয় মডেলে তৈরি
জার্মানির সবচেয়ে পুরনো মসজিদটি হচ্ছে বার্লিনের শহরে কেন্দ্রে অবস্থিত আবাসিক এলাকা ভিলমার্সডর্ফ-এ৷ এই আহমেদিয়া মসজিদটি জার্মান স্থপতি কার্ল আগুস্ট হ্যার্মানের পরিকল্পনায় এবং ভারতের বিখ্যাত ‘তাজমহল’-এর মডেলে তৈরি করা হয়৷ মসজিদটির উদ্বোধন করা হয় ১৯২৮ সালে৷
ছবি: Max Zander
বিতর্কিত মসজিদ
এই মসজিদটি উদ্বোধন করার সময় প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও পরে তা মেনে নেওয়া হয়৷ মেনে নেওয়ার উদ্যোগের পেছনে ছিল হাইনার্সডর্ফের সংগঠন ‘‘হাইনার্সডর্ফ তোমার দরজা খোলো’’ এবং প্রথম ইমাম আবদুল বাসিত তারিকের মোটো ছিল, ‘‘কারো জন্য ঘৃণা নয়, সবার জন্য ভালোবাসা’’ – এই নীতিবাক্য৷
ছবি: Max Zander
ছিমছাম মসজিদ
নারী স্থপতি মুবাশরা ইলিয়াস বেশ সাদামাটাভাবেই এই মসজিদের কাজ করেছেন৷ এখানে ২৫০ জন মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে৷ মসজিদের প্রধান ঘরটির ঠিক ওপরেই মহিলাদের জন্যও রয়েছে আলাদা ঘর৷
ছবি: Max Zander
সবচেয়ে বড় মসজিদ
বার্লিনের নয়ক্যোলন এলাকার এই মসজিদটিকে মুলমানদের সাংস্কতিক মিলনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়৷ বার্লিনের সবচেয়ে বড় এই মসজিদে ১,৫০০ জন মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন৷ মসজিদটিতে বিশেষ আয়োজনের জন্য আলাদা জায়গাও রয়েছে৷ ২০১২ সালে জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই মসজিদটি পরিদর্শন করেন৷
ছবি: Max Zander
মুসলমানদের কবরস্থান
মুসলমানের জন্য যে কবরস্থান রয়েছে, ঠিক তার পাশেই ১৯৮০ সালে এই মসজিদ তৈরি করা হয়৷ পরে অবশ্য এটা আরো বড় করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে এটির পরিধি৷
ছবি: Max Zander
বিভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতি বিনিময়
জার্মানির তুর্কি সম্প্রদায় মানুষরা অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করে৷ এখানে ইসলাম ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের নানা আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হয়৷ যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের পুরো মসজিদটা ঘুরে দেখানো এবং ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়৷
ছবি: Max Zander
ইসলাম ধর্মের সেন্টার
প্রথম দেখে বোঝাই যায় না যে এটা একটা মসজিদ৷ উমর আল-ইবনে খাতাব মসজিদটি বার্লিনের আবাসিক এলাকা ক্রয়েৎসব্যার্গের মধ্যমণি৷ বলা বাহল্য, এই এলাকা তুর্কি অধ্যুষিত৷ মসজিদের ভেতরে নামাজের ঘরগুলোর আশেপাশে ছোটখাটো দোকান, কফি শপ, ট্রাভেল এজেন্সি ইত্যাদি রয়েছে৷ ২০০৮ সালে শুরু হওয়া এই মসজিদটিতে একটি মাদ্রাসাও রয়েছে৷
ছবি: Max Zander
ওজু ঘর
মাসহারি সেন্টারের মসজিদের বেজমেন্ট, অর্থাৎ মাটির নীচের একটি ঘরে তৈরি করা হয়েছে এই সুন্দর ওজু ঘরটি৷ এখানে পুরুষ এবং নারীরা আলাদাভাবে ওজু করতে পারেন, অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে বিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে এই মসজিদে৷
ছবি: Max Zander
আন্তর্জাতিক কমিউনিটি
ঝাড়বাতির নীচে নামাজের এই ঘরটিতে একসাথে ১,০০০ জন মুসলমান নামাজ পড়তে পারেন৷ তুর্কি বংশোদ্ভূত মানুষ ছাড়াও মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন আরব, আফ্রিকান, বসনীয় ও অন্যান্য দেশের মুসলমানরা৷ প্রতি শুক্রবার ঐতিহ্যগতভাবে জুম্মার নামাজ হয় আরবি ভাষায়৷ তবে সকলের সুবিধার্থে দেয়ালে লাগানো মনিটরে আরবি এবং তুর্কি ভাষাতেও পড়ে নেয়া যায় অনুবাদ করা আয়াতগুলি৷