কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর প্রতিবাদী সমাবেশের বিরুদ্ধে পুলিশের আচরণ বেপরোয়া৷ লাঠিপেটা ও গ্রেপ্তারই শুধু নয়, কারাগারে আটক কার্টুনিস্ট কিশোর অসুস্থ হওয়ার পরও তার রিমান্ড চায় পুলিশ৷ এর কারণ কী?
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) কাশিমপুর কারাগারে মারা যান ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ৷ মারা যাওয়ার পর রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলকায় বিক্ষোভ হয়৷ পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় শাহবাগে বাম ছাত্র সংঠনগুলোর মশাল মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ৷ তাদের লাঠিপেটায় কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন৷ এখানেই শেষ নয় এই ঘটনায় আটক সাত জনের বিরুদ্ধে মামলাও করে পুলিশ৷
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷
ছবি: Facebook/Sushanta.D.Gupta
9 ছবি1 | 9
এদিকে লেখক মুশতাকের মৃত্যুর ঘটনায় ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় শুক্রবার খুলনায় আটক করা হয় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল আমিনকে ৷ তার বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে৷
পুলিশের এই ‘আগ্রাসী’ মনোভাবের সবচেয়ে বড় পরিচয় পাওয়া গেছে এখনো কারাগারে আটক কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের রিমান্ড আবেদনের মধ্য দিয়ে৷ কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ৫ মে৷ ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে র্যাব ডিজিটাল আইনে মামলা করে৷ রমনা থানা পুলিশ তদন্ত শেষে এই বছরের ১৩ জানুয়ারি চার্জশিট দেয় সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুন্যালে৷ চার্জশিটে মুশতাক, কিশোর ও দিদারকে আসামি করা হলেও আট জনকে বাদ দেয়া হয়৷ তাদের ঠিকানা নিশ্চিত না হওয়ায় তাদের বাদ দেয়া হয়৷ কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তাদের নাম ঠিকানা নিশ্চিত করতে এই মামলার অধিকতর তদন্ত দাবি করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন৷
মামলার তদন্ত নতুন করে দেয়া হয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ওপর৷ মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. আফছর আহমেদ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদের তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন৷ ২৫ ফেব্রুয়ারি মুশতাক মারা যান৷ তারপরও ২৮ ফেব্রুয়ারি আদলাতে শুনানি করে কিশোরকে রিমান্ডে নিতে চায় পুলিশ৷ যদিও আদালত তাদের রিমান্ড আবেদন নাকোচ করে দেন৷
সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুন্যালের পিপি নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘‘আমরাই অধিকতর তদন্ত চেয়েছি৷ আর সে কারণেই রিমান্ডের আবেদন হয়েছে৷’’
তার ডান কানের পর্দা ফেটে গেছে: কিশোরের ভাই আহসান কবির
কিন্তু কিশোরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইউম বলেন, ‘‘একবার চার্জশিট হয়ে গেলে সেই মামলার অধিকতর তদন্তে আসামিদের আবার রিমান্ডে নেয়া যায় না৷ ১০ ফেব্রুয়ারি আবার শুনানি আছে৷ সেখানে আমরা আইনগত দিক তুলে ধরব৷ কিন্তু আইনের কত দিক তখন আবার হয়ে যায় তা বলা যায় না৷’’
কিশোরের ভাই সাংবাদিক আহসান কবির জানান, কাশিমপুর কারাগারে আটক কিশোরের শারীরিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ৷ তাকে এর আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির করা হলেও ২৮ ফেব্রুয়ারি হাজির করা হয়নি৷ তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আটকের পর কিশোরকে নির্যাতন করা হয়৷ তার পায়ের গোড়ালিতে এখনো ব্যাথা৷ সে খুঁড়িয়ে হাঁটে, কয়েক কদম যাওয়ার পর তাকে অন্যের সহায়তা নিতে হয়৷ পায়ে ইনফেকশন হয়ে গেছে৷ তার ডান কানের পর্দা ফেটে গেছে৷ ডায়াবেটিস-এর কারণে সে চোখে ঠিকমত দেখতে পারে না৷’’
তার কথা এই পরিস্থতিতে কিশোরের রিমান্ড আবেদন, ‘‘ভয় দেখানো ও ভিন্ন উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনো কারণেই হতে পারে না৷’’
কারা হেফাজতে মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের, সরকারের: অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান
রিমান্ড আবদনের শুনানির দিন কিশোরের জামিন আবেদন করা হয়নি৷ কারণ ওই তারিখটি গোপন রাখা হয়েছিল বলে জাানান আহসান কবির ৷ তাই সোমবার হাইকোর্টে কিশোরের জামিন অবেদনের শুনানি হয়েছে৷ ৩ মার্চ আদালত এব্যাপারে আদেশ দেবেন৷ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষ আবারও শুনানি করবে৷
মানবাধিকার কশিনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, লেখক মুশতাক কারাগারে মারা যাওয়ার পর পরিস্থতি সামাল দিতে এখন প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশি হামলা, মামলা ও রিমান্ডের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি করে সাময়িক উপশমের পথ খুঁজছে সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘কারা হেফাজতে মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের, সরকারের৷ সরকারের কাজ হলো একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করে সঠিক কারণ জানানো৷ কিন্তু তা না করে তারা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাইছে যাতে মানুষ ভয় পায়৷ যে প্রতিবাদ তৈরি হচ্ছে তা যেন হতে না পারে৷ কিন্তু এটা কোনো সঠিক পথ নয়৷ এতে জনরোষ বাড়ে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘কিশোরকে যে আবার রিমান্ডে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এটাও ভয় দেখানোর জন্য৷ রাষ্ট্রের এই অসুর শক্তি প্রদর্শন কোনোভাবেই একটি গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়৷’’