মঙ্গলবার ব্রিটিশ সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক বিতর্কিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই অধিবেশনের সময়কাল সঙ্কুচিত করা সত্ত্বেও বিরোধীরা চুক্তিহীন ব্রেক্সিট নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চান৷ ক্ষমতাসীন টোরি দলের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে৷ হাতে গোনা কয়েকজন সংসদ সদস্যও বিরোধীদের উদ্যোগে সমর্থন দিলেও ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ এমন প্রেক্ষাপটে দুই শিবিরই সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷
প্রধানমন্ত্রী জনসন সোমবার তড়িঘড়ি করে ডাকা মন্ত্রিসভার এক বৈঠকের পর ব্রেক্সিটকে ঘিরে একাধিক মন্তব্য করেছেন৷ তাঁর দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে৷ তবে সেই প্রচেষ্টা বিফল হলেও তিনি কোনো অবস্থায় ৩১শে অক্টোবরের নির্ধারিত সময়সীমা বাড়াতে প্রস্তুত নন৷ তাঁর মতে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রয়োজনে চুক্তি ছাড়াই ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করবে৷
নিজের দলের মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কার মুখে সংসদ সদস্যদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে জনসন আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ টোরি দলের কয়েকজন নেতা জানিয়ে দিয়েছেন, সংসদে যারা সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন, তাঁরা আর দলের মনোনয়ন পাবেন না৷ এমনকি তাঁদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হতে পারে৷ সংবাদ সংস্থা ডিপিএ সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, যে সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হলে জনসন অক্টোবর মাসেই নির্বাচন ডাকতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে ১৪ই অক্টোবর নির্বাচনের তারিখ স্থির হতে পারে৷ তবে এই সিদ্ধান্তের জন্যও সংসদে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের প্রয়োজন হবে৷
সংসদে বিরোধী পক্ষ চলতি সপ্তাহেই সম্মিলিতভাবে এক প্রস্তাব অনুমোদনের উদ্যোগ নিচ্ছে৷ তার আওতায় ১৯শে অক্টোবরের মধ্যে ইইউ-র সঙ্গে চুক্তি নিয়ে ঐকমত্য সম্ভব না হলে ব্রেক্সিটের সময়সীমা আরও ৩ মাস পেছানো হবে৷ উল্লেখ্য, ১৭ ও ১৮ই অক্টোবর ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে ব্রেক্সিট নিয়ে বোঝাপড়ার বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যাবে৷ আগামী বছরের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে হবে৷ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেই লক্ষ্যে সংসদে প্রাথমিক ভোটে বিরোধীদের জয় হলে প্রধানমন্ত্রী আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে৷ কারণ এই ভোটাভুটির পরেই বিরোধী লেবার দল সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ মাত্র একটি আসনের ব্যবধানে সরকারি জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সরকারের পরাজয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী জনসনের দৃঢ় অবস্থান অনেক ভোটারের মনে ধরছে৷ কিন্তু ব্রেক্সিট কার্যকর হবার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শেষ পর্যন্ত কোন শিবির সমর্থন পাবে, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়ে যাচ্ছে৷ কোনো পক্ষই যথেষ্ট সমর্থন না পেলে নতুন করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স, এএফপি )