একদিকে মজুরি বৃদ্ধি, অন্যদিকে শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানা পড়েছে লোকসানের মুখে৷ গত ১৫ বছরে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি৷ ফলে কিছু পোশাক কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে৷
বিজ্ঞাপন
গত বছরের ১লা ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় নতুন মজুরি কার্যকর হয়৷ ৭৭ ভাগ মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে শ্রমিকদের এখন সর্বনিম্ন মজুরি দাড়িয়েছে ৫,৩০০ টাকা৷ গত বছরের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১,১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং এর আগে তাজরিন ফ্যাশনস-এ আগুনের ঘটনায় শ্রমিক নিরাপত্তা এবং নিম্ন মজুরি নিয়ে চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প৷ এই চাপ এড়াতে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়৷ কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির চাপ সহ্য করতে পারছে না অনেক পোশাক কারখানা৷
এর কারণ, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়াচ্ছে না৷ ফলে ছোট ছোট অনেক পোশাক কারাখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে৷ তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ভবনের সামনে বন্ধ হওয়া এ সব পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনই ভিড় করছেন৷ গত সপ্তাহে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার এরকম একটি পোশাক কারাখানা বন্ধ করে দেয়ার পর সেই কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় বিজিএমইএ ভবনের সামনেই৷ তাঁরা জানান, মালিক কর্তৃপক্ষ দু'মাসের বেতন না দিতে পেরে কারাখানা বন্ধ করে দিয়েছে কিছু না জানিয়েই৷ একই ভবনের আরো কয়েকটি গার্মেন্টসও বন্ধ হওয়ার পথে বলে জানান তাঁরা৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
৯৪৬টি পোশাক কারখানার ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের মাত্র ৪০ ভাগ নতুন মজুরি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে৷ এর মধ্যে চট্টগ্রামে পেরেছে মাত্র ৫ ভাগ কারখানা৷ বিজিএমইএ-র সহ সভাপতি শহীদুল আযিম জানান, ‘‘অনেক পোশাক কারখানারই নতুন মজুরি বাস্তবায়নে সক্ষমতা নেই৷''
একই সঙ্গে রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিক নিরাপত্তা, কম মজুরি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা প্রশ্নে পশ্চিমা ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷ তাঁরা ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় চলে যাচ্ছেন৷ ব্যাবিলন গ্রুপ নামের একটি পোশাক কারাখানার পরিচালক ইমদাদুল হক জানান, গত বছর ফ্রান্সের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ১,৩০,০০০ শার্ট নিয়েছে৷ আর এবার তারা নিচ্ছে অর্ধেকেরও কম মাত্র ৬০,০০০ পিস শার্ট৷ অন্যদিকে, সিমকো গ্রুপ একই ক্রেতাকে পোশাক সরবরাহ করে লাভের পরিবরর্তে শতকরা ২ ভাগ লোকসান গুনছে৷ পরিস্থিতি সামলাতে ক্রেতাদের পোশাকের দাম বাড়াতে অনুরোধ করলেও তাঁরা সাড়া দিচ্ছেন না৷ জানা গেছে, এখন ৫টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৪টিই এই পরিস্থিতির মুখোমুখি৷ যেমন ব্যাবিলন গ্রুপ এর আগে ২.৬৯ ভাগ লাভ করলেও এখন তাদের উল্টো ২.৪২ ভাগ লোকসান হচ্ছে৷
গত চার মাসে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় প্রবৃদ্ধির ধারা গত ১৫ বছরেও সর্বনিম্ন, যা পোশাক কারখানার জন্য অশনি সংকেত৷ বিজিএমইএ-র সহসভাপতি শহীদুল আযিম বলেন, ‘‘একদিকে ক্রেতারা নানা প্রশ্নে অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন আর অন্যদিকে রয়েছে বাড়তি মজুরির চাপ৷ এই দুই দিকের চাপ এখন সামাল দিতে হচ্ছে পোশাক কারখানার মালিকদের৷'' গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সিরারজুল ইসলাম রনি জানান, ‘‘কিছু পোশাক কারখানা বাড়তি মজুরি দিতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে৷ আর শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় ১০টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এর ফলে শ্রমিকরা বেকার হচ্ছেন৷ তাই আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে৷ তাদের উচিত হবে পোশাকের জন্য বাড়তি দাম দেয়া৷ কম দামে পোশাক কেনার মানসিকতা ছাড়তে হবে৷ পোশাক কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকরা কাজ হারাবে৷ তখন নিরপত্তার চেয়ে বেকারত্বই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে৷'' বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ৷ রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ আসে এই খাত থেকে৷ পোশাক কারখানায় নিয়োজিত আছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাঁদের ৮০ ভাগই নারী৷ তাই পোশাক কারখানার যে কোনো ধরণের বিপর্যয় পুরো অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলবে৷