1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মণিপুরি থিয়েটারের নাট্যযাত্রা

শুভাশিস সিনহা
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মণিপুরিদের সমাজজীবন কৃত্যকর্মময়৷ জন্ম থেকে মৃত্যু প্রায় প্রতিটি পর্বেই মৃদঙ্গ বাদন, দেহতত্ত্ব বা মনশিক্ষার গান, মন্দিরার তাল– এসব  আবশ্যিক বলা যায়৷ 

Auftritt von Jyoti Sinha vom Manipuri Theatre of Bangladesh
ছবি: Suvashish Sinha

বাঙালির বর্ষবরণের দিন মণিপুরিদের বর্ষবিদায় হয় পঞ্জিকার তারতম্য অনুসারে৷ মণিপুরিরা দিনটিকে বলে থাকে বিষু৷ বিষু ঘরে ঘরে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন হয়ে থাকে৷ কিন্তু মানুষের সম্মিলন নেই৷ আমরা ভাবলাম, উৎসবটিকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি৷
১৯৯৭ সাল৷ ঘোড়ামারা গ্রামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রথম প্যান্ডেল বেঁধে আমরা আয়োজন করলাম ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান৷ প্রথমে নাম এমনই ছিল৷ কত কষ্ট করেছি৷ ঘরে ঘরে গিয়ে জানানো, শিল্পী আমন্ত্রণ করা, নাটক মঞ্চ আনা, আরো কতকিছু৷ প্রচুর মানুষের সমাবেশ ছিল, যে র‌্যালি দিয়েছি, তা এলাকার মানুষ এখনো ভোলেনি৷ আমরা শুধু চেয়েছি ধর্ম বা কৃত্যবিষয়ক সংস্কৃতিচর্চার ধারা থেকে বের হয়ে এসে নতুন কিছু করতে৷ আমরা তা পেরেছি৷ একটি নাটক করলাম৷ ‘আজবপুরের বর্ষবরণ’৷ এক প্রতিক্রিয়াশীল রাজার কাহিনী৷  তার প্রবল বাধার মুখে বর্ষবরণ হয়৷ সে রাজ্যের প্রজারা তাকে বাধ্য করে বর্ষবরণ উৎসব পালন করতে৷ 
আঙ্গিক নিয়েও আমরা নিরীক্ষা শুরু করি৷ আর রচনায়ও ছিল তার ছাপ৷ সম্পূর্ণ স্বরবৃত্ত ছন্দে নাটকটি লিখি৷ মজা হয়েছিল বেশ৷ সে-নাটকে আজকের জ্যোতি সিনহা প্রথম দলের সাথে যুক্ত হলো৷ রাজকুমারীর ভূমিকায় জ্যোতির অভিনয় প্রথমবারেই দর্শকদের মন জয় করে৷ সে উৎসবে সে নিজে নির্দেশনা দিয়ে কিশোরদের এক মজার নাটিকাও উপস্থাপন করে৷ সেটাও বেশ উপভোগ্য ছিল৷ পরিবার-স্বজন সবাইকে চমকে দিয়ে, ১৯৯৮ সালে, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই৷ আমার মাসতুতো বড় ভাই অসীমকুমার সিংহ (অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি উইকিপিডিয়ার অন্যতম কারিগর এবং আমার আকৈশোরের অন্যতম প্রেরণা) আমাকে প্রণোদিত করেন এ বিভাগে ভর্তি হবার জন্য৷ তবে বাবা-মা, ভাই বোন সবার অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি৷ আমার যে-কোনো কাজে তারা পাশেই থেকেছে আজ অবধি৷ যা-ই হোক সেলিম আল দীনের সান্নিধ্য, বিভাগীয় পড়াশোনা, দেখা-বোঝা আমাকে নাটক নিয়ে ভাবতে বেশ সাহায্য করে৷
নাটক বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখার একটা ইচ্ছে শুরু থেকেই মাথায় কাজ করেছে; বিভাগীয় পড়াশোনার ঐতিহ্যকে আধুনিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মোকাবেলা আর বোঝাপড়ার চেষ্টা আমাকে নাড়া দিল, বিশেষত সেলিম স্যারের ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’৷ ভাবলাম তাহলে আমাদের (মণিপুরিদের) নটপালা, লীলা, নৃত্য এসব নিয়ে আমারও তো অনেক কিছু করার আছে৷ সেই ভাবনা থেকে একটা নাটক করার কথা ভাবি৷  নাটকের মতো নয়৷ এটা হবে পালাগানের মতো৷ গল্প গাইতে গাইতে নাটক হয়ে যাবে৷ যারা গাইবে তারাই  চরিত্র হয়ে অভিনয় করবে৷ নাটকটার নাম ছিল ‘তারালেইমার পালা’৷ রচয়িতা মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষার প্রধান কবি আসামের ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ৷ এ নাটক দিয়েই আমরা ভিন্ন ধারার নাটক করার তৎপরতা শুরু করি৷ 
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ছিল আমাদের নিজেদেরকে খুঁজে ফেরার প্রথম নাট্য৷ মনে পড়ে জাহাঙ্গীরনগরে যখন ক্লাস করছি, তখনই পোকাটা মাথায় ঢোকে৷ বড়ু চন্ডীদাসের পালাটিকে বেশি মনে ধরে এজন্য, আমি যে সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, সেখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা সবগুলোতেই প্রায় বৈষ্ণবীয় ভাবে-ধরনে উপস্থিত৷ শান্তরসের আধিক্যই থাকে সেখানে৷ প্রেম আর ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়৷ কিন্তু বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ তা নেই৷ এখানে শৃঙ্গার রসের আধিক্য নিয়েই একেবারে গ্রামীণ একটা পটভূমিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে দেখানো হয়েছে; ধর্মের দার্শনিক জায়গা সেখানে নেই বললেই চলে৷ আমাদের জন্য এই কাজটা সত্যি ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং৷ একে তো ভক্তিরসে আপ্লুত মণিপুরি ভাবুক সম্প্রদায়কে রুষ্ট করার ভয়, তার উপর পাঠটাকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করার তাগিদ৷ সব মিলিয়ে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ খুব কষ্টকর একটা কাজ ছিল৷ কিছু না ভেবে আমি পালাটির ঈষৎ সংক্ষেপিত রূপ সম্পাদনা করে সেখান থেকে অনুবাদ করে ফেলি৷ নানা ছন্দে নানা মাত্রায় কখনো পয়ারে কখনো ত্রিপদীতে ছন্দ বৈচিত্র্য রক্ষা করে অনুবাদ শেষ করি৷ তারপর গ্রামের মণ্ডপে সবাই মিলে পড়তে বসি৷ নাটকটির শুরুতে সময় দাঁড়ায় পৌনে তিন ঘন্টা৷ অভিনেতার সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধশত৷ 
২০০০ সালে আমরা দলের নাম পরিবর্তন করি৷ আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র৷ চিন্তায় অনেক পরিবর্তন৷ নিজের শেকড়ের দিকে তাকানোর অভিব্যক্তি রীতি সব পাল্টে যাচ্ছে৷ পড়াশোনা করছি নানা বিষয়ে৷ ভাবলাম, না, এ নাম বিচ্ছিরি৷ নাম বদলে রাখলাম ‘মণিপুরি থিয়েটার’৷ মণিপুরি জাতিসত্তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকবে আমাদের থিয়েটার৷ একটা প্রতীকী ব্যাপার৷ শুধু আমাদের জন্য নয়, এ রকমই যারা অস্তিত্ববিপন্ন হয়ে আছে, তাদের সবার পক্ষে যেন দাঁড়াতে চাইলাম৷ এক সন্ধ্যায়, তখন ৪র্থ প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী আযোজনের প্রস্তুতিসভা৷ আমি উপস্থাপন করলাম আমার ব্যাখ্যা৷ সবাই মেনে নিল৷ ঐ অনুষ্ঠানে আমরা নতুন নাম ঘোষণা করলাম৷ তখন থেকে আমরা বাংলা ছেড়ে সম্পূর্ণ নিজেদের ভাষাতেই (মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া) নাটক মঞ্চায়ন করতে শুরু করি, যদিও মাঝে মধ্যে বাংলা নাটক করেছি, তবে তা সংখ্যায় খুব গৌণ৷  
২০০১ সাল৷ ঠিক করলাম শুধু মণিপুরি নাটক নিয়ে একটা নাট্যোৎসব হবে৷ বাংলাদেশে এই প্রথম৷ কীভাবে কী হবে কিছুই ঠিক নেই৷ কিন্তু করব তো করবই৷ তিনটি নাটক ছিল উৎসবে৷ তিন দিনের উৎসব৷ নাট্যমূলক ঐতিহ্যবাহী পালাও ছিল৷ ছিল রাস৷ সব মিলিয়ে একটা পরিপূর্ণ ‘মণিপুরি নাট্যোৎসব’৷ এ রকম জমজমাট অনুষ্ঠান, এ রকম আলোড়ন আর কোথাও মেলেনি৷ মনে আছে তখন শ্রীমঙ্গলের তাপমাত্রা বোধ হয় নিকট-অতীতের মধ্যে সর্বনিম্ন রেকর্ড করা হয়েছিল৷ সেই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে হাজার হাজার মানুষ নাটক দেখেছে৷ নাট্যোৎসবের জন্য মণিপুরি পোষাকে সেজে তরুণ তরুণীরা যে র‌্যালী বের করেছিল, সেটাও ছিল দেখার মতো৷ নাচে গানে সকাল থেকে বিকাল মাতিয়ে রেখেছিল সারা রাস্তা৷ 
এই নাট্যোৎসব আমাদের দলকে সারা দেশে একটা পরিচিতি এনে দেয়৷ একে একে আমরা মঞ্চে আনতে থাকি নতুন নতুন নাটক৷ কোনো বছরই আমরা থেমে থাকিনি৷ আমার পরীক্ষা, কর্মীদের সমস্যা কোনোকিছুই থামিয়ে রাখতে পারেনি আমাদের নাট্যযাত্রাকে৷ যেসব সংকট তৈরি হত, আমরা নিমেষে সেখান থেকে উত্তরণের মরিয়া লড়াই করেছি৷ পেরেছিও৷ 
২০০৬ সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান থেকে একবার প্রযোজনা-শর্তে পঁচিশ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছিলাম আমরা৷ মামুনুর রশীদ চেয়ারম্যান থাকাকালে৷ একটা প্রযোজনার জন্য সেই টাকা নিতান্তই অপ্রতুল৷ তবু উৎসাহের জন্য ব্যাপক৷ নিজেদের বাড়তি সংযোগে মঞ্চায়নের কাজ চলে৷ বৃটিশ উপনিবেশকালে কমলগঞ্জের ভানুবিল পরগনার মণিপুরি কৃষ্কপ্রজাদের আন্দালনের কাহিনী নিয়ে তখন ‘ভানুবিল’ নামের নাটকটি মঞ্চে আনা হয়৷ ঢাকায়ও দুটো প্রদর্শনী হয়েছিল নাটকটির৷ বাংলার জাতীয় ইতিহাসের অংশ অথচ প্রায় আড়ালে থাকা এক সংগ্রামের গল্প মানুষকে আন্দোলিত করেছিল৷ 
২০০৮ সালে সুবচন প্রবর্তিত আরজু স্মৃতি পদক পাই৷ ঢাকার বাইরে সেরা নাট্যদল হিসেবে৷ সেটিই আমাদের প্রথম কোনো জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি৷ সংবাদটা যখন জানানো হয় আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি৷ আমাদেরকে মজা করা ছলেই হয়তো বলা হয়েছি উপস্থিত থাকতে৷ কারা পুরস্কার পায় ঠিক করা হয়নি৷ তখন এ ধরনের পুরস্কার-পদক আমাদের ভাবনাতেই ছিল না৷ উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা নিয়ে আমরা কয়েকজন উপস্থিত হয়েছিলাম৷ যখন আমাদের দলের নাম ঘোষণা করা হলো আবেগে কন্ঠরুদ্ধ অবস্থা৷ সে-ই ছিল আমাদের প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি৷ পুরস্কারের অংক ছিল পঁচিশ হাজার টাকা৷ সেই টাকার ওপর নির্ভর করেই মঞ্চে আনার উদ্যোগ নেয়া হয় নতুন নাটক ‘ইঙাল আধার পালা’৷ এখন পর্যন্ত আমাদের একমাত্র দ্বিভাষিক নাটক৷ কথক বা সূত্রধরের বর্ণনা ছিল বাংলায় আর পাত্র-পাত্রীদের সংলাপ মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষায়৷ একজন মণিপুরি মৃদংগবাদকের চুরি যাওয়াকে নিয়ে মূল গল্প আবর্তিত হলেও, সাংস্কৃতিক সংকটের রূপক স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাটকে৷ জ্যোতি অভিনয় করেছিল কথকের ভূমিকায়৷ মূল নায়ক মৃদঙ্গবাদক প্রেমসিং লক্ষণ সিংহ৷ মা-মেয়ের ভূমিকায় শুক্লা আর স্মৃতি৷ আর নন্দর ভূমিকায় সুশান্ত৷ সবাই দারুণ অভিনয় করেছিল৷ এটিও এরেনা মঞ্চে ডিজাইন করা হয়েছিল৷ 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা অবলম্বনে একেবারেই মণিপুরি একটা গল্প ফেদে করলাম ‘দেবতার গ্রাস’৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষ উদযাপনের ধারায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়৷ এক ঝাঁক নতুন অভিনেতা দলে আসে নাটকটির মধ্য দিয়ে৷ সুনন্দা, বীথি, পাপড়ি সহ অনেকেই৷ নাটকটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক ধরনের উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখার নিজস্ব রীতির নিরীক্ষা ফলপ্রসূ হয়েছিল৷  
সর্বশেষ ‘লেইমা’৷ অচির্চত বা স্বল্পচর্চিত নাট্যকারদের রচনা নিয়ে কাজ করার একটা ইচ্ছা বা জেদ সবসময় কাজ করে৷ লোরকার নাটক বাংলায় হয়েছে খুবই কম৷ অনেক খোঁজখবর করে গুগল ঘেটে তাঁর কাব্যনাট্য ‘ইয়ের্মা’র সন্ধান পাই৷ অনুবাদ করে ফেলি৷ যেন আমাদেরই জনপদের গল্প৷ এর কাব্যিকতা, আবেগ তীব্র আকর্ষণ করে৷ এবার অভিনয় আর সংলাপে জোর দিয়ে নাটকটির ডিজাইন করি৷ বিশুদ্ধ মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষা এবং সম্পূর্ণ সংলাপ-অভিনয়-নির্ভর বলে বাঙালি দর্শকরা কতটুকু নিতে পেরেছেন ঠিক জানি না, তবে মণিপুরিদের মধ্যে এর আবেদন ছিল বাঁধভাঙা৷  
২০১৩ সালে পাওয়া সোলায়মান প্রণোদনা আমাদের দলের জন্য একটা বড় অর্জন৷ আর মনে পড়ে ২০১১-তে থিয়েটারওয়ালা’র সেই নাট্যযজ্ঞ৷ ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালামের মতো নাট্যনির্দেশকদের পাশে আমার নাম৷ তিনজনের নাটক নিয়ে উৎসব৷ ভাবলে এখনো অবাক হই, উদ্দীপ্ত হই ভীষণভাবে৷ 
২০১২ সালে ভারতের মণিপুরি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে নাট্যমঞ্চায়ন আমাদের প্রাণের আনন্দ ছিল৷ আর ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারি দল হিসেবে আগরতলা, শিলচরে নাটক করাটাও গর্বের ছিল নিঃসন্দেহে৷  
শুধু নাটক নয়, মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী নানান আঙ্গিক নিয়ে আমরা ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি৷ একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছি এখানকার পালাকার, ইশালপা বা গায়েন, রাসধারী, সূত্রধারীদের সঙ্গে৷ তারা আমাদেরকে ভালোবেসেছেন, সাহচর্য দিয়েছেন৷ 
একবার সপ্তাহব্যাপী নাট্যভ্রমণ করেছিলাম৷ একটা পিক-আপ ভ্যান ভাড়া করে প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাটকের মঞ্চায়ন৷ সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে৷ 
মাইকেলের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ আসলে নিখাদ কবিতাই৷ সেখান থেকে করব ‘কহে বীরাঙ্গনা’৷  নাট্যগুণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল৷ ঘটনা সেভাবে ঘটে না৷ আর মধুসূদনের আঁটোসাটো অক্ষরবৃত্ত! দর্শক শুনবে? দেখবে? সেসব ভাবিনি৷ আমার মন আচ্ছন্ন হয়েছিল৷ জ্যোতিকে বললাম, পড়৷ পড়তে থাকো৷ তোমার মনে যদি ভালো-লাগা জন্ম নেয়, তাকে লালন করার স্বপ্ন দেখো৷ জ্যোতি পড়ে উচ্ছ্বসিত৷ কিন্তু আমরা তখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি৷ আমি শুধু বলেছি একদম গভীরে যেতে হবে৷ পাঠের আরও ভেতরে৷ যেখানে গেলে শব্দের আপাত দেয়ালগুলোকে ভেঙে ফেলা যায়, স্বর আর শরীরের রসায়নের জারিত করে ফেলা যায় কবিতার ছদ্মপ্রস্তর৷ জ্যোতি তা করেছে৷ কতদিন যে কথা চলেছে, আলাপ করেছি...৷ শুধু বলেছি এখানে মুন্সিয়ানার কিছুই ফলানোর চেষ্টা করা হবে না৷ কেবল আমরা টেক্সটের কাছে নিজেদেরকে ছেড়ে দেব৷ যেমন ধর্মগ্রন্থের সামনে নতজানু ধার্মিক৷ শিল্প তো এক অর্থে শিল্পীর ধর্মই৷ আমার দিদি শর্মিলার সাথে বসে সুর আর রাগ-রাগিনীগুলো ঠিক করলাম৷ সংগীতের সাথে বাদ্য৷ বিধান (মণিপুরি থিয়েটারের প্রধান বাদ্যশিল্পী বিধানচন্দ্র সিংহ) বাদ্যকে নাটকীয় করে তোলার চেষ্টা চলল৷ এভাবেই দাঁড় হলো ‘কহে বীরাঙ্গনা’৷ 
গ্রামের সেই ছোট্ট স্টুডিও (তখন আরও ছোট ছিল এর মাপ) নটমণ্ডপে টানা দুদিন চারটা শো হলো, দর্শনীর বিনিময়ে৷ লোকে ভরপুর৷ এক বৃদ্ধাকে চোখ মুছতে দেখা গেল৷ দর্শক পিনপতন নীরব৷ একাধিকবার দেখল অনেকেই৷ 
ষাট হাজার টাকা খরচ হয়েছিল প্রযোজনাটিতে৷ টেলিভিশনের জন্য দুটি নাটক লিখে বিশ হাজার টাকা যোগাড় করেছিলাম৷ মাইনের জমানো টাকা থেকে আরও হাজার বিশেক৷ বাকি টাকা দলের দুতিন জনের কাছ থেকে৷ তখন জ্যোতিও কপর্দকশূন্য বলা যায়৷ পিতৃহীন সংসারে ছোট বোন স্মৃতি (কহে বীরাঙ্গনা’র অন্যতম শিল্পী) তখন মাত্র কলেজে পড়াশোনা করছে৷ জ্যোতি একটা এনজিওতে ঢুকেছিল৷ নাটকের জন্য তাও ছেড়ে দিল৷ 
যা হোক ‘কহে বীরাঙ্গনা’র পঞ্চাশ প্রদর্শনী হলো৷ এই নাটক নিয়ে এত রিভিউ, এত আলোচনা, এত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, আমরা নিজেরাই কখনো বিব্রত হয়েছি৷ কিন্তু আমরা এই খ্যাতিতে পথ হারিয়ে বসতে যাইনি৷ গ্রামের সবুজ ঘাসের পথে ধূলিমাখা পায়ে হেঁটেছি শিল্পের ভালোবাসাকে বুকে নিয়ে, সেই আগের মতোই, পথ খুঁজেছি নতুন প্রকরণের৷ 
কিন্তু পথ আমাদের বড়োই সংকটের৷ সেই শুরু থেকে আমাদের লড়াই করে যেতে হয়েছে নিদারুণ বাস্তবতার সাথে৷ বরাবরই আমরা শুনেছি একদমই একটা গ্রামে, তাও এমন একটা প্রান্তিক অঞ্চলে, জীবন যেখানে টেকে না, সেখানে থিয়েটার টিকবে কীভাবে?
সত্যি কেন টিকে রইলাম? একটা বড় প্রশ্ন৷ কম ঝড় তো আসেনি৷ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আর্থিক প্রচন্ড টানাপোড়েন তো আছেই৷ আমার পরিবারটির কথা না বললেই হয় না৷ আমার সামান্য স্কুলশিক্ষক বাবা, আমাদের তিন ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ যোগাতেই ফতুর হতে বসেছিলেন, তাও সয়ে নিয়েছিলেন আমাদের সব ‘আহ্লাদ’, ‘আদিখ্যেতা’৷ বাবা যে নিজেও একজন অভিনেতা আর নাট্যসংগঠক ছিলেন৷ বাবার অভিনীত ‘তাসের ঘর’, ‘বন্দীর ছেলে’ ইত্যাদি নাটকের কথা এখনও লোকের মুখে মুখে শুনি৷ শিল্পসাহিত্যের প্রতি তাঁর অগাধ দরদ৷ পুরো একটা বাড়িই তো ছেড়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের জন্য৷ উঠানে করতাম মহড়া, শিশিরে কুয়াশায় ভিজে ভিজে, বৃষ্টিকাদায় একাকার, রোদে পুড়ে৷ সমস্যা হলে বারান্দায়, তাতেও সমস্যা হলে ঢুকে যেতাম বাড়ির ভেতর৷ সেখানেই হৈ-হুল্লোড়, নাচ-গান, মহড়া...৷ 
আমার মা৷ শুধু আমার নয়, আমাদের এই থিয়েটারেরই মাতৃমূর্তি তিনি৷ শীর্ণ শরীরে সকল ধকল, হট্টগোল, ‘অত্যাচার’ সয়ে নিয়েছেন, সয়ে নেন৷ 
আমার দাদার নাম দেবাশিস সিনহা৷ ডাক নাম শিশির৷ ডাক্তার হলেও তার মন শিল্পপ্রিয়৷ প্রথম এক যুগের প্রায় সকল ডিজাইন, আঁকিবুকি তারই করা৷ মঞ্চসজ্জাও তারই৷ অর্থ সহায়তাতে দাঁড়ালো সজল, সুব্রত, উজ্জ্বল সহ অনেক টগবগে তরুণ৷   
দিদি (শর্মিলা সিনহা) তো আমার নিত্যসঙ্গী, আজ অবধি৷ নাটকে সংগীতের অগ্রভাগে সে-ই৷ মণিপুরি নাট্যোৎসবে উন্মুক্ত মঞ্চে পরিবেশিত প্রথম পর্যায়ের পৌনে তিন ঘন্টার ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাটকে কুয়াশাভেজা রাতে সে একাই নেপথ্যে ৬৫টি গান গেয়েছিল! এছাড়াও কঠিন-পড়ুয়া এই মেয়ে আমার কাজের দারুণ বিশ্লেষক৷ 
অবশেষে ২০১০ আমরা একটা স্থায়ী ঠিকানা পেলাম৷ নিজেদের একটা ছোট্ট মিলনস্থল৷ নটমণ্ডপ৷ আমাদের ভিটার ভেতরই, বাড়ির উত্তর-পূর্বদিকে তোলা হলো নটমণ্ডপ৷ বাবা অতি উৎসাহে এই জায়গাটুকু আমাদের থিয়েটারের নামে দিয়ে দিলেন৷ অধিকাংশ কাঠের ব্যবস্থাও করে দিলেন তিনি৷ নির্মাণকালীন তত্ত্বাবধানটাও তাঁরই৷
জানি এই ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’৷ তবু যে ‘অলৌকিক আনন্দের ভার’ আমরা কাঁধে তুলে নিয়েছি, তাকে আর অবমোচনের উপায় তো নেই৷ তাই পথ চলব৷ থামব না!

শুভাশিস সিনহা, নাট্যকর্মীছবি: privat

এ বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ