অনাস্থা বিতর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ রাহুল গান্ধীর। বললেন, মণিপুরে ভারতকে হত্যা করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
রাহুল বলেছেন, ''আমি মণিপুর গেছিলাম। আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাননি। কারণ, ওর কাছে মণিপুর ভারত নয়। সত্যি কথা হলো, মণিপুর আর বেঁচে নেই। মণিপুর আপনারা দুইভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন।''
কংগ্রেস নেতার বক্তব্য, ''আমি ত্রাণশিবিরে গেছিলাম। নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলেছি, একজন নারী বললেন, তার একটাই বাচ্চা ছিল। তার সামনে বাচ্চাকে গুলি করে মারা হয়। পুরো রাত ওর মৃতদেহ নিয়ে বসেছিলাম।''
বিজেপি সাংসদদের কয়েকজন বলে ওঠেন, মিথ্যা কথা। রাহুলের সঙ্গে সঙ্গে জবাব, ''তোমরা মিথ্যা বল। আমি বলি না।'' রাহুল বলেন, ''ওই নারী আমায় বললেন, তারপর ভয় লাগলো। ঘর ছেড়ে, যা ছিল সব ছেড়ে দিয়ে এসেছি। একবস্ত্রে চলে এসেছি। একটা ফটো কেবল নিয়ে এসেছি।''
রাহুল জানান, ''অন্য একটি শিবিরে এক নারী তার কথা বলতে শুরু করেই কাঁপতে থাকলেন। তার ভয়ংকর ছবি মনে পড়ে গেল। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।''
এরপরই রাহুলের সরাসরি অভিযোগ, ''বিজেপি ভারতকে হত্যা করেছে। এদের রাজনীতি শুধু মণিপুরকে মেরে দিয়েছে তাই নয়,, ভারতকেও মণিপুরে হত্যা করেছে। ভারতমাতার হত্যা আপনারা মণিপুরে করেছেন। মণিপুরের মানুষকে মেরেছেন। আপনারা দেশদ্রোহী। এজন্য প্রধানমন্ত্রী মণিপুর যেতে চান না। আমার এক মা এখানে, অন্য মাকে মণিপুরে হত্যা করা হয়েছে।''
রাহুলের দাবি, ''মণিপুরে সেনার প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আপনারা সেনাকেও মারতে চান মণিপুরে। মোদীজি ভারতের হৃদয়ের আওয়াজ শোনেন না। কার আওয়াজ শোনেন?
মণিপুরে গভীর হচ্ছে বিভাজন
মণিপুরে মে মাসে শুরু হয়েছিল সহিংসতা৷ তিনমাস পর দৃশ্যত সহিংসতা কমলেও পরিস্থিতি এখনো থমথমে৷ এখনো জারি আছে সান্ধ্য আইন৷ ছবিঘরে বিস্তারিত৷
ছবি: DW
সংঘাতের শুরু
মে মাসে মণিপুর হাইকোর্টের রায় মেইতেই গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসাবে মান্যতা দেয়৷ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় কুকি গোষ্ঠী৷ দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়, যার রেশ এখনও মণিপুরে বর্তমান৷ মেইতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষ্ণুপুর ও কুকি সংখ্যাগরিষ্ঠ চূড়াচান্দপুরের মধ্যে বিভক্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্য৷ দুই গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই পারস্পরিক অবিশ্বাস এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে৷
ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS
আরো যে যে কারণে দ্বন্দ্ব
মণিপুরের জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ কুকি৷ অন্যদিকে, এই রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি বাসিন্দা মেইতেই গোষ্ঠীর৷ কুকিরা বহু দিন ধরেই পৃথক রাজ্যের দাবি জানিয়ে আসছেন৷ এই দাবি ‘খারিজ’ করে এসেছে মেইতেইরা৷ অন্যদিকে কুকিরা মনে করেন, রাজ্যে সরকারি চাকরি বা জমির মালিকানা পাওয়ার ক্ষেত্রে মেইতেইদের আধিপত্য রয়েছে৷ কুকি নেতারা এই অবস্থারও পরিবর্তন চান৷
ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS
মৃত্যু ও উচ্ছেদ
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, মে মাসে শুরু হওয়া সহিংসতায় অন্তত ১২০জনের মৃত্যু হয়েছে৷ তবে স্থানীয়দের মতে, মৃতের সংখ্যা আরো বেশি৷ সহিংসতার কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ৷ মণিপুরের মৈরাঙে চালু হয়েছে একটি ক্যাম্প, সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন মেইতেইরা৷
ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS
অস্ত্রের বাজার মণিপুর
মে মাসে সংঘর্ষ শুরুর পর সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানায়, উন্মত্ত জনতা পুলিশ স্টেশন লুট করে প্রায় তিন হাজার অস্ত্র ও ছয় লাখ গুলি নিয়ে যায়৷ মেইতেই ও কুকি দুই গোষ্ঠীর হাতেই অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে বলে জানাচ্ছে এএফপি৷
ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS
যা বলছে কর্তৃপক্ষ
রাজ্য পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার পর সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিলেও মণিপুরে এখনো স্বাভাবিকতা ফেরেনি৷ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘নিরপেক্ষ তদন্তের’ আশ্বাস দিয়েছেন৷ তবে স্থানীয়দের মধ্যে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷
ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS
প্রতিবাদের ঢেউ
সম্প্রতি মণিপুরের দুই নারীকে যৌন হয়রানি করার পর নগ্ন করে হাঁটানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়৷ মণিপুরসহ সারা ভারতে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়৷ প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বসবাসরত কুকি ও মেইতেইরাও৷
ছবি: Rafiq Maqbool/AP Photo/picture alliance
রাজনীতিতে মণিপুর
ভারতের সংসদেও বিরোধীরা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে ‘নো কনফিডেন্স’ ভোট দেন৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মণিপুরে সংঘর্ষ শুরু দুই মাস পর তা নিয়ে মন্তব্য করলে, সেটাও সমালোচিত হয়৷ মণিপুরের মুখ্যুমন্ত্রী বীরেন সিংহের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ- তিনি কুকিবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছেন৷ তার পদত্যাগের দাবিও উঠছে৷ কিন্তু বীরেন সিংহ জানান, তদন্ত চলছে ও প্রকৃত আসামীদের বিচারব্যবস্থার আওতায় আনা হবে৷
ছবি: Biju Boroi/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
এরপর রাহুল নিজেই সেই প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, ''মোদী দুজনের আওয়াজ শোনেন। রাবণ যেমন দুই জনের কথা শুনত। মেঘনাদ ও কুম্ভকর্ণ। মোদীজি দুজনের কথা শোনেন। অমিত শাহ ও আদানি।''
রাহুলের অভিযোগ, ''রাবণের অহঙ্কার লঙ্কা জ্বালিয়েছিল। বিজেপি এখন পুরো দেশে কেরসিন ফেলছে। হরিয়ানায় ফেলেছে। মণিপুরে ফেলেছে। তোমরা দেশকে জ্বালাতে চাইছ।''
রাহুল তার ভাষণ শুরু করেন ভারত জোড়ো যাত্রার অভিজ্ঞতা দিয়ে। তিনি বলেন, ''প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আমি গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে সবার কথা শুনতাম। একজন কৃষক এলেন। হাতে তুলো নিয়ে। তিনি আমাকে তুলো দিয়ে বললেন, এটাই আমার ক্ষেতে বেঁচে আছে। প্রশ্ন করি, বিমার পয়সা পেয়েছেন। বলেন, পাননি। বড় শিল্পপতিরা ছিনিয়ে নিয়েছেন। যখন কৃষককে দেখলাম। ওর মনের ভয়, আমার মনে এল। ওর ক্ষুধা বুঝতে পেলাম। যাত্রা বদলে গেল। সাধারণ মানুষের দুঃখ, আঘাত আমার দুঃখ ও আঘাতে পরিণত হলো।''
না পালালে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিত: মণিপুরী উদ্বাস্তু
মণিপুর থেকে পালিয়ে আসামে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ। তাদের সঙ্গে কথা বলেছে ডিডাব্লিউ।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
অভিশপ্ত রাত
৫ মে এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে তাদের। হামলাকারীরা এসে একের পর এক ঘরে আগুন লাগাতে থাকে। ঘরের ভিতর এই মানুষগুলিকেও পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে কোনোক্রমে পালিয়েছেন তারা।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
সারা রাত পাহাড়ি রাস্তায়
গোটা রাত পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসামের কাছাড় জেলায় পৌঁছেছেন এই উদ্বাস্তুরা। জীবন ছাড়া আর সব পুড়ে গেছে তাদের।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
সব মিলিয়ে আটটি ক্যাম্প
কাছাড় জেলার লখিপুরে আটটি ক্যাম্পে প্রায় আড়াই হাজার উদ্বাস্তু বসবাস করছেন। এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কয়েকটি ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। বহু উদ্বাস্তু মিজোরামেও গেছেন। সেখানেও এমনই আরো ক্যাম্প তৈরি হয়েছে।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
কারা করল এমন!
কারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তা জানলেও প্রকাশ্যে বলতে চাইছেন না উদ্বাস্তুরা। বার বার একটাই কথা বলছেন, ঘরবাড়ি, চার্চ সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
নদী পথে পলায়ন
নদী পথেও অনেকে পালিয়েছেন। পালানোর সময় তাদের ক্যামেরাতেই উঠেছে এমন ছবি।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
পুলিশি প্রহরা
ক্যাম্পগুলিতে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষেরাও মণিপুরী উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং বলেছেন, প্রায় তিরিশ হাজার উদ্বাস্তু রাজ্য ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। দ্রুত তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা হবে।
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
ফিরতে ভয়
উদ্বাস্তুরা বলছেন, বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন তারা। মৃত্যুর মুখ থেকে তারা ফিরে এসেছেন। আবার সেই ভয়াবহ রাত ফিরে আসবে না তো!
ছবি: Viswakalyan Purokayastha/DW
8 ছবি1 | 8
রাহুল বলেছেন, ''লোকে বলে, এই দেশ একটা আওয়াজ। এই দেশের মানুষের আওয়াজ। তাদের দুঃখ, কষ্টের আওয়াজ। আমাদের মনের অহঙ্কার দূর করতে হবে। নাহলে আপনি ভারতের আওয়াজ শুনতে পারবেন না। অহঙ্কার ও ঘৃণাকে আগে দূর করতে হবে। নাহলে মানুষের আওয়াজ শুনতে পারবেন না।''
রাহুলকে জবাব দিতে ওঠেন বিজেপি-র মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। তিনি কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা তোলেন। কংগ্রেস আমলে হওয়া নারীদের উপর অত্যাচারের খতিয়ান দেন। তিনি দাবি করেন, কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়েছে সেখানে মোদী ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর থেকে।
স্মৃতির অভিযোগ, ''লোকসভায় মণিপুর নিয়ে আলোচনা করতেই চায়নি কংগ্রেস। অমিত শাহ বা রাজনাথ সিং যখনই আলোচনার কথা বলেছেন, তখনই তারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দাবি করে সেই আলোচনা থেকে সরে গেছে।''
স্মৃতি বলেন,''কংগ্রেস আগে দুর্নীতির ব্যাখ্যা দিক, অযোগ্যতার ব্যাখ্যা দিক। তোমরা তো ভারতের অংশ নও। কারণ, ভারত দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। ভারত পরিবারবাদী নয়। ব্রিটিশদের কংগ্রেস বলেছিল, ভারত ছাড়। পরিবারবাদীরা এখন ভারত ছাড়।''