জার্মানি উন্মুক্ত ও সহনশীল দেশ৷ কিন্তু জার্মানিতে থাকতে হলে আমাদের মূল্যবোধের কাঠামো মেনে নিতে হবে৷ ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল মনে করেন, তার মধ্যে ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামও অন্যতম৷
ছবি: picture alliance/dpa/Jüdisches Forum für Demokratie und gegen Antisemitismus e.V.
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অধিকারের উপর সহজে আঁচ পড়ে না৷ একমাত্র হাতেগোনা কিছু কারণে এই অধিকার সংকুচিত করা সম্ভব৷ তাই গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে জার্মানির রাজপথে এমন সব বুলি আমাদের বার বার সহ্য করতে হয়, যার মূলমন্ত্রই অগণতান্ত্রিক৷ যেমন ‘বিদেশিদের দূর করো'৷
রাষ্ট্র তার সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিলে এবং রাজপথে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অধিকার খর্ব করলে তার পরিণতি কী হয়, নাৎসি স্বৈরতন্ত্রের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের দেশকে তা শিখতে হয়েছে৷ সে কারণেই ম্যার্কেল সরকারের সমালোচকরা বিক্ষোভ দেখালে বা জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জার্মানিতে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা বার্লিনে মার্কিন দূতাবাসের সামনে তাদের ক্রোধ উগরে দিলে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা৷
যজ্ঞের আয়োজক দেশ কখনো মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না
আমাদের ইতিহাস কিন্তু আমাদের সবকিছু মেনে নিতে দায়বদ্ধ করে না৷ বরং এর বিপরীতটাই শেখায়৷ জার্মানি কমপক্ষে ৬০ লক্ষ ইহুদি ধর্মাবলম্বীর হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী৷ হলোকস্ট যত আগের ঘটনাই হোক না কেন, ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে চিরকালের জন্য জার্মানির একটা দায়িত্ব রয়েছে৷ ইহুদি নিধন যজ্ঞের আয়োজক দেশ কখনো মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না৷ অন্য কোনো দেশে তো নয়ই, জার্মানির মাটিতে তো একেবারেই নয়৷
ইনেস পোল, ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদকছবি: DW/P. Böll
সে কারণে জার্মানিতে ইহুদি ধর্মের প্রতীক ‘স্টার অফ ডেভিড' লাগানো পতাকা কোনো অবস্থায় পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না৷ যে সব মানুষ এ দেশে আশ্রয় খুঁজছেন, যাঁরা জার্মানিতে নতুন করে বাসা বাঁধতে চান, তাঁদের এই দায়িত্ব মেনে চলতে হবে৷ আমাদের মূল্যবোধের কাঠামোর মৌলিক ভিত্তি নিয়ে কোনো রকম আপস সম্ভব নয়৷
অভিবাসনের দেশ জার্মানি
অন্যান্য সমাজে প্রতিপক্ষের সম্মান ক্ষুণ্ণ করতে পতাকা পোড়ানো স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে৷ জার্মান সংবিধানের ভিত্তি হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা৷ ফৌজদারি অপরাধ না হলেও তুরস্ক, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সৌদি আরবের পতাকা পোড়ানোর ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না৷ সেই সব দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যতই সমালোচনা থাক না কেন, তা সত্ত্বেও এটা মেনে নেওয়া যায় না৷
আমাদের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস থেকে শিক্ষা কখনো ভুললে চলবে না৷ তবেই ভবিষ্যতে অভিবাসনের দেশ হিসেবে জার্মানিতে সবাই মিলেমিশে বসবাস করতে পারবে৷ এই উত্তরাধিকার মেনে না নিলে এখানে কারও ভবিষ্যৎ নেই৷ এ নিয়ে কোনো আপস সম্ভব নয়৷
জার্মানি-ইসরায়েল: একটি বিশেষ সম্পর্ক
নাৎসি আমলের ইহুদি নিধন যজ্ঞে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের অপমৃত্যুর জের ধরে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইসরায়েলের৷ তাই ঐতিহাসিক কারণে জার্মানি ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের চরিত্র একেবারে অনন্য৷ কিছু মানুষের জীবন জুড়েও রয়েছে এ দুটি ভূখণ্ড...
গল্পগুচ্ছ
জার্মান লেখক সারা স্ট্রিকার ইসরায়েলে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছেন৷ সেখানেই লিখেছেন নিজের প্রথম উপন্যাসটি৷ আর সম্প্রতি ইসরায়েলি এবং জার্মান লেখকদের কাজ নিয়ে তৈরি অভিনব একটি গল্পগুচ্ছে একটি ছোট গল্পও লিখেছেন তিনি৷
ছবি: Win Schumacher
মানুষ, প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ
এত দীর্ঘ একটা সময় ইসরায়েলে থাকার কারণে সেখানকার মানুষ, এমনকি প্রকৃতিকেও ভালোবেসে ফেলেছেন সারা৷ তাঁর মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেডারেল জার্মান প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, বেড়ে চলেছে সহযোগিতা৷ তাই সারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী৷
ছবি: Win Schumacher
রন্ধনশিল্প
২০১৩ সালে জার্মানির টম ফ্রাঞ্জ ইসরায়েলের একটি বিখ্যাত রান্নার অনুষ্ঠান তথা প্রতিযোগিতা ‘মাস্টার শেফ’-এ প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ আর তখন থেকেই ইসরায়েলে তিনি একটি অতি পরিচিত নাম৷
ভালোবাসার টানে
ইসরায়েল আর সেখানকার মানুষদের সঙ্গে এতটাই মিলেমিশে গিয়েছিলেন টম যে, আট বছর আগে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি৷ হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন৷ এ অঘটনটা ঘটেছিল ভালোবাসার টানেই৷ প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি৷ বর্তমানে টমকে জেরুসালেমের একটি ছোট্ট সিনাগগে প্রতিদিন স্ত্রীর সঙ্গে প্রার্থনা করতে দেখা যায়৷
রাঁধুনি পরিবার
স্ত্রীর পরিবারেই থাকেন টম৷ তাঁরাও যে রান্নায় এক-একজন ওস্তাদ৷ তাই তাঁদের সঙ্গে রান্নাঘরে দারুণ সময় কাটে টমের৷ কত কী যে শিখেছেন তিনি এখানে৷ আসলে জেরুসালেমের খাবার-দাবার নিয়ে একটি বই লিখতেই তিনি এসেছিলেন ইসরায়েলে৷
গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন
নাম: রিলি উইলো৷ বয়স: ৩৪৷ স্বপ্ন: দাদির মতো মস্ত গায়িকা হওয়ার৷ রিলির দাদি একসময় বার্লিনের বিখ্যাত গায়িকা ছিলেন৷ তাই রিলি ইসরায়েল ছেড়ে আজ পরবাসী৷ বহুদিন হলো বার্লিনেই ঘর বেঁধেছেন তিনি, সানন্দেই৷ যদিও নাৎসিদের কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আউশভিৎসে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর প্রিয় দাদিকে৷
বার্লিনের আড্ডা
এটা ইসরায়েল নয়, জার্মানির ছবি৷ রাজধানীর ক্রয়েৎসব্যার্গ এলাকার একটা পাবে বসে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারছেন রিলি উইলো আর তাঁর স্বামী বেনেডিক্ট বিন্ডেভাল্ড৷ বার্লিনের এ অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী নয়ক্যোলন এলাকায় বহু তরুণ ইসরায়েলির বাস৷
হালকা হাসির পাল্লা
ইসরায়েল থেকে আসা রিলি উইলো আর বন্ধু শাহাগ শাপিরা একটা বিষয়ে একমত৷ আর সেটা হলো: ইহুদি বুদ্ধিমত্তা আর ইসরায়েলি ব্যঙ্গ আসলেই অতীতের কালো অধ্যায়টাকে হালকা করতে সাহায্য করেছে অনেকটাই৷
ছবি: Win Schumacher
সোজা প্রশ্ন
পেশায় সাংবাদিক শাপিরার বয়স মাত্র ২৭৷ কিন্তু আজকের জার্মান সমাজে ইহুদিদের কীভাবে দেখা হয়, সেটা জানতে তাঁর দারুণ আগ্রহ৷ তাই পথে-ঘাটে কারুর সাথে দেখা হলেই তিনি প্রশ্ন করে বসেন: আচ্ছা, আপনি কি ইহুদি বিদ্বেষী?
হাসতে তো মানা নেই!
বার্লিনের হলোকস্ট মেমোরিয়ালটি দেখতে যাঁরাই আসেন, তাঁরাই নিজের মোবাইল ফোনটা দিয়ে একটা ‘সেল্ফি’ তুলতে ভোলেন না৷ ‘‘এখানে সেল্ফি তোলা নিষেধ’’ – না, সত্যি সত্যি না৷ দর্শনার্থিদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে শাপিরা প্রায়ই এমনটা বলেন৷ আর লোকজন সব ঘাবড়ে গেলে, হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি৷