বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নতুন বছরে তাঁদের চাওয়া নিয়ে নানা কথা বললেও, সকলের প্রত্যাশার মূল সুর একটিই – ‘আমরা যেন ভালো থাকি, থাকি নিরাপদ’৷ আর এই ভালো থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সংঘাত, প্রতিহিংসা বর্জন সবচেয়ে জরুরি৷
বিজ্ঞাপন
শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের বিভিন্ন দৈনিক এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে ছাপা তাঁর একটি কলামে নতুন বছরে নিজের ১০টি প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন৷ তাঁর সেই ১০টি প্রত্যাশা হলো – ১. পাকিস্তানি ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার, ২. হেনরি কিসিঞ্জারের প্রতীকী বিচার, ৩. জামায়াত মুক্ত বিএনপি, ৪. আলাদা সাইকেল লেন, ৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা, ৬. দুটি পাবলিক পরীক্ষা, ৭. পত্রিকায় গাইড বই প্রকাশ বন্ধ করা, ৮. প্রশ্ন ফাঁস থেকে মুক্তি, ৯. ফেসবুক থেকে মোহমুক্তি এবং ১০. সবার জন্যে প্রবেশগম্যতা৷ তাঁর কথায়, ‘‘এই ১০টি প্রত্যাশা পূরণ করতে কোনো অর্থ খরচ হবে না, শুধুমাত্র সদিচ্ছাই যথেষ্ঠ৷''
চায়ের দোকানদার মোহাম্মদ ফারুক
জাফর ইকবালের মতো গুছিয়ে বলতে পারেন না সাধারণ মানুষ৷ তবে তাঁদেরও প্রত্যাশা আছে, আছে চাওয়া-পাওয়া৷ আর সেই প্রত্যাশা পূরণেও বাড়তি কোনো অর্থ খরচ করতে হবে না৷
ঢাকার পান্থপথে চায়ের দোকানদার মোহাম্মদ ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যাতে ভালো থাকতে পারি নতুন বছরে, এটাই প্রত্যাশা৷ আমার ব্যবসায় যেন কোনো সমস্যা না হয়, যেন কোনো বাধা না আসে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মিলে-মিশে থাকে৷ হরতাল, সংঘাত, সংঘর্ষ না হয়, তাহলে দেশ ভালো থাকবে৷ দেশের মানুষও ভালো থাকবে৷'' তাঁর মতে, দেশের অনেক উন্নতি হচ্ছে৷ তবে নির্বাচনে সব দল আসলে আরো ভালো হবে৷ এছাড়া ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে সরকার খুব ভালো কাজ করেছে'' – এ কথাও বলেন মোহাম্মদ ফারুক৷
কলাবাগান বাজারে কথা হয় বাজার করতে আসা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে৷ তাঁর প্রত্যাশাও ফারুকের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে মিলে যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ যেন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে৷ জীবনযুদ্ধে সবাই যেন বিজয়ী হয়৷''
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
এই বাজারের সবজি বিক্রেতা আব্দুস সালামের কথায়, ‘‘ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চাই৷ পরিবারের সবার মুখে হাসি দেখতে চাই৷''
তবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন স্কুল শিক্ষক রবিউল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘নিরাপদে ঘরে থাকারও পরিস্থিতি নেই৷ সাধারণ মানুষের চাওয়া তো খুব বেশি না৷ খেয়ে পরে শান্তিতে থাকতে চায় সবাই৷ আমিও চাই একটা নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা৷''