সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর জুলহাজের ভাই বলেন, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হলে এই ধরনের ঘটনা কমে যাবে৷
বিজ্ঞাপন
মামলায় সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক জিয়াসসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড আর দুই পলাতককে খালাস দেয় আদালত৷
রায়ে বলা হয়, স্বাধীন মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করতেই ওই দুইজনকে হত্যা করা হয়৷ ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের বাসায় ঢুকে সমকামী অধিকার কর্মী ও সমকামীদের ম্যাগাজিন ‘রূপবান’-এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নান এবং নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করা হয়৷
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি হলেন চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, শেখ আব্দুল্লাহ ও আসাদুল্লাহ৷
মিনহাজ মান্নান
তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হযেছে৷ পাশাপাশি আরেকটি ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ জিয়া ও আকরাম পলাতক৷ বাকি চারজনের উপস্থিতিতে বিচারক রায় ঘোষণা করেন৷
অভিযোগে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় অপর দুই পলাতক আসামি সাব্বিরুল হক চৌধুরী এবং জুনাইদ আহমদ ওরফে মওলানা জুনায়েদ আহম্মেদ ওরফে জুনায়েদকে খালাস দিয়েছেন বিচারক৷
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সারোয়ার খান জাকির জানান, ‘‘আদালত তার রায়ের বলেছেন, আসামিরা সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলামের সদস্য৷ সমকামীদের নিয়ে র্যালি করাসহ সমকামীদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ করায় ওই দুইজনকে তারা হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়৷ স্বাধীন মত প্রকাশ ও স্বাধীনভাবে কাজ করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যেই তাদের হত্যা করা হয়েছে৷’’
‘আসামিরা সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসার আল ইসলামের সদস্য’
আর জুলহাজের ভাই ও মামলার বাদী ভাই মিনহাজ মান্নান বলেন, ‘‘আমি অপরাধীদের শনাক্ত ও তাদের বিচার চেয়ে মামলা করি৷ এই মামলায় যাদের শাস্তি হয়েছে, যারা ঘাতক, সবাই আমার অজ্ঞাত৷ আমি তাদের চিনি না বা চিহ্নিতও করতে পারিনি৷ তাই এই মামলার রায়ে সন্তোষ বা অন্তোষ প্রকাশ করার আমার অবকাশ আছে বলে মনে করি না৷ যারা মামলার তদন্ত করেছেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করেছেন, বিষয়টি তাদের৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমাদের মনোজগতে যদি পরিবর্তন না আসে, আমরা যদি পরমতসহিষ্ণু না হই, আইনি কাঠামো যদি আরো শক্তিশালী না হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি তাদের শক্ত হাতে দমন না করে, তাহলে এই ধরনের ঘটনা সামনে আরো ঘটবে বলে আশঙ্কা থেকেই যায়৷ যদি প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত হয়, বিচারের আওতায় আসে, তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা কমে যাবে৷’’
এদিকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পরও আদালতে উপস্থিত আসামিদের মধ্যে কোনো অনুতাপ দেখা যায়নি৷ শুরু ধেকেই তারা ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল৷
আসামিদের আইনজীবী এবিএম খায়রুল ইসলাম লিটন দাবি করেছেন তারা ন্যায় বিচার পাননি৷ তিনি বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন৷
জঙ্গি থাবা বাংলাদেশে
নানা মত, নানা পথকে পাথেয় করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো৷ বাংলাদেশে মসজিদ থেকে আদালত, মেলা থেকে সিনেমা হল- কিছুই বাদ যায়নি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর থাবা থেকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
উদীচীতে শুরু
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর উপর জঙ্গিদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়৷ এর পর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিরা৷ ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোণায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলায় নিহত হয় আট জন৷
ছবি: bdnews24.com
উৎসবে হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিলে রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়৷ ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের দনিয়ার এক মেলায় বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ৮ জনকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
মসজিদে হামলা
১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়াদের মসজিদে জঙ্গিদের বোমা হামলায় আট জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়৷ ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর পুরান ঢাকায় হোসাইনি দালান ইমামবাড়ায় শিয়াদের সমাবেশে বোমা হামলায় একজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়৷ ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়াদের মসজিদে বোমা হামলায় মারা যায় আট জন, আহত হয় ৪০ জন।
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo
সিনেমা হলে হামলা
২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের অলকা, ছায়াবাণী, পূরবী ও অজন্তা সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা হয়৷ তাতে মারা যায় ১৮ জন, আহত হয়েছিলেন ৩০০ মানুষ৷
ছবি: DW/ISPR
রেস্তোরাঁয় হামলা
২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় বিদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ সদস্যসহ ২৩ জন নিহত হন৷ ওই হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ ঘটে নব্য জেএমবির৷
ছবি: bdnews24.com
বিদেশিদের উপর হামলা
২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা করা হয়৷ ওই হামলায় হাইকমিশনার বেঁচে গেলেও মারা যান দুইজন৷ ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে খুন হন ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজার। ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে রংপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
আদালতে হামলা
২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে সহকারী জেলা জজ সোহেল আহম্মেদ এবং জগন্নাথ পাঁড়েকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়৷
ছবি: AP
মুক্তমনাদের উপর হামলা
বিভিন্ন সময় সশস্ত্র হামলায় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তমনা নিহত হয়েছেন৷ ২০১৫ সালের ঢাকায় গলা কেটে হত্যা করা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে৷ ২০১৬ সালেন ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে বাসায় ঢুকে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ সমকামীদের অধিকার-বিষয়ক সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জুলহাজ আর মাহবুব ছিলেন নাট্যকর্মী৷
ছবি: Robert Richter
ঈদগায় হামলা
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদের সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলা এবং গোলাগুলিতে দুই কনস্টেবলসহ চারজন নিহত হয়৷
ছবি: bdnews24.com
হামলা সারা দেশে
২০০০ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে জামাআতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি৷ ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলার ৫০০ স্থানে বোমা ফাটিয়ে আলোচনায় এসেছিল এই জঙ্গি গোষ্ঠী৷ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ আহত হন।
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
নিষিদ্ধ সাত সংগঠন
কিছু সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নজরে আসার পর সেগুলোকে থামাতে সময়ে সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷ ‘আনসার আল ইসলাম’, জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহরীর এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সব ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷