বাংলাদেশে বিরোধীরা দমন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সংকুচিত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও৷ এমনটাই দাবি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর৷ তাদের কথায়, এর পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনাও ঘটছে৷
বিজ্ঞাপন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডাব্লিউ ২০১৬ সালের বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট-২০১৭ নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের ব্যাপারে এ সমস্ত কথা বলা হয়েছে৷ সংগঠনটির ৬৮৭ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে ৯০টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়৷
রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের পুলিশ ইচ্ছে করেই বিরোধী দলের সদস্য ও সমর্থকদের পায়ে গুলি চালাচ্ছে৷ তাদের কথায় গুলিবিদ্ধদের অভিযোগ, পুলিশি হেফাজতেই তাদেরকে গুলি করা হয় এবং পুলিশ একে আত্মরক্ষামূলক বলে মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে৷ আর এ জন্যই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক সমর্থক ও সদস্য আত্মগোপনে চলে গেছেন৷ অনেককে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, আবার কেউ কেউ কারাভোগ করছেন কিংবা গুম হয়েছেন৷
২০১৬ সালে বাংলাদেশে ব্লগার, শিক্ষাবিদ, সমকামী অধিকার কর্মী, বিদেশি নাগরিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কিছু হামলা হয়৷ বেশিরভাগ হামলার ক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হলেও, বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকেই এর জন্য দায়ী করে৷ শুধু তাই নয়, এদের কারও কারও সঙ্গে বিরোধী রাজনীতিবিদদের সংযোগ রয়েছে বলেও দাবি করে সরকার৷ জঙ্গি সংগঠনগুলোর সন্দেহভাজন সদস্য কিংবা সমর্থকরা বিভিন্ন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়৷
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিধিবহির্ভূত গ্রেপ্তার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে৷ লেখক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা এবং অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে৷
সংবাদমাধ্যমে এক ধরনের ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ চলছে
এছাড়া বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর ওপরও দমন-পীড়ন চলছে বলে দাবি করে এইচআরডাব্লিউ৷ বলা বাহুল্য, দু’টি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে বাংলাদেশে৷ এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য বিশেষ আইন পাস করা হয়েছে৷ ঐ আইনের আওতায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি আইন পাসের প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও দাবি করে এইচআরডাব্লিউ৷
এই প্রতিবেদনের সঙ্গে অনেকটাই একমত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বা আসক-এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা গত সপ্তাহে দেখেছি যে, বিএনপি সমাবেশের অনুমতি পায়নি৷ কিন্তু শাসক দল এবং তার অঙ্গ সংগঠন সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে৷ তাছাড়া সংবাদ প্রকাশের জন্য আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হচ্ছে৷ অনলাইন এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমও চাপের মুখে রয়েছে বাংলাদেশে৷’’
তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দেখছি সংবাদমাধ্যমে এক ধরনের ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ চলছে৷ আমার মতে, ভয়ার্ত পরিবেশের কারণেই এটা হচ্ছে বা দেশে একটি ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে হত্যা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা নেই – সেটা বলা যাবে না৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বেআইনিভাবে আটক, নির্যাতন এখনো লেগেই রয়েছে৷ আর এর প্রধান শিকার হচ্ছেন বিরোধীরা৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কি এইচআরডাব্লিউর প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত? জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’