1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মদ্যপানের প্রবণতা বাড়ছে কেন ভারতে?

৬ নভেম্বর ২০২৫

ভারতে ক্রমশ বাড়ছে মদ্যপানের প্রবণতা। যদিও বিশ্বজুড়ে এই ট্রেন্ড বিপরীতমুখী বলে দাবি করা হয়েছে সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে।

ভারতে মদ ও এই জাতীয় সামগ্রীর বাজার ফুলেফেঁপে উঠেছে।
এখন ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় ভারতে বেশি মদ বিক্রি হচ্ছে।ছবি: picture alliance/dpa

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মদ্যপানের প্রবণতা সম্পর্কে একটা ছবি উঠে এসেছে।

চাহিদা বাড়ছে ভারতে

ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ অতীতে মদ বিক্রির নিরিখে উন্নত দেশগুলির তুলনায় পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় এদেশে বেশি মদ বিক্রি হচ্ছে।

সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মাথাপিছু মদ্যপানের হার বাড়ছে। ২০০৫ সালে সারা বছরে ভারতীয়রা গড়ে প্রায় আড়াই লিটার মদ খেতেন। এক দশক পরে, ২০১৬ সালে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৭ লিটারে। এই বৃদ্ধির হার যদি ভবিষ্যতে একই থাকে, তাহলে ২০৩০ সালে ভারতে মাথাপিছু বার্ষিক মদ্যপানের গড় পরিমাণ হবে ৬.৭ লিটার।

ভারতে মদ ও এই জাতীয় সামগ্রীর বাজার ফুলেফেঁপে উঠেছে। আর্থিক অংকে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার বাজার। এটা থেকেই স্পষ্ট, এদেশে মদের চাহিদা ও মদ্যপানের প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে মদ ব্যবসায় যুক্ত শীর্ষস্থানীয় সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম বেড়েছে চড়চড় করে।

২০২১ সালে শ্যাম্পেন বিক্রির রেকর্ড

01:53

This browser does not support the video element.

ভারতীয় সমাজে অতীতে মদ্যপান সীমাবদ্ধ ছিল। মূলত অর্থবান মানুষরাই উচ্চমূল্যের বিদেশি মদ কিনতে পারতেন। একেবারে দরিদ্রদের জন্য ছিল সস্তার দেশি মদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রমশ মদ্যপানের অভ্যাস গড়ে তোলায় ব্যবসা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।

শুধু আর্থিক সামর্থ্যের নিরিখে নয়, মদ্যপানের ক্ষেত্রে বয়সের বেড়াজাল ভেঙে গিয়েছে। ক্রমশ তরুণরা মদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। ভারতে সদ্য তরুণ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা এখন মদের মূল ক্রেতা।

চাহিদা কমছে বিশ্বে

গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলিতে মদের চাহিদা কমছে, এমনটাই দাবি করা হয়েছে ব্লুমবার্গের রিপোর্টে। গত চার বছরে বিশ্বের অগ্রণী সংস্থাগুলির মদ বিক্রির পরিমাণ কমে গিয়েছে। এর ফলে এদের ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছে, কমে গিয়েছে শেয়ারের দাম।

সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০টি মদ কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০২১ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে বিক্রি কমে গিয়েছে। অনেক বেশি ঋণের বোঝা চেপে বসেছে মদ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির উপরে। এই লোকসান সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে তারা।

হঠাৎ মদ খাওয়ার পরিমাণ কেন কমে গেল উন্নত বিশ্বে? এর পিছনে রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতিরিক্ত মদ্যপান নিয়ে আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মদ্যপানের কুফল নিয়ে মানুষকে সজাগ করছেন। ক্রমশ বাড়তে থাকা লাইফস্টাইল ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলছেন। এর ফলে শুধু মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়রা নন, তরুণ প্রজন্ম মদ খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে না।

এই পরিস্থিতিতে লোকসান সামাল দিতে একাধিক সংস্থা অ্যালকোহল মুক্ত পানীয় বাজারে ছেড়েছে। এতে মদের স্বাদ পাওয়া যাবে, কিন্তু অ্যালকোহলজনিত শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না। ভারতের বাজারেও এ ধরনের পানীয় বিক্রি হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে মদ বিক্রি

ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও মদের বিক্রি ক্রমশ বাড়ছে। আবগারি বিভাগের সূত্র অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে রাজ্যে ২২ হাজার কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে এই অংক ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা।

গত এক দশকে মদ্যপানের প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে, এটা বোঝা যাচ্ছে বিক্রি দেখে। ২০১৪-১৫ সালে মদ বিক্রি থেকে রাজ্য সরকার সাড়ে তিন হাজার হাজার কোটির কিছু বেশি রাজস্ব পেয়েছিল। ২০২২ ২৩ অর্থবর্ষে এই অংক গিয়ে পৌঁছেছেন ১৬ হাজার কোটিতে।

প্রতি বছর উৎসবের মরশুমে মদের বিক্রি বেড়ে যায়। ৩১ ডিসেম্বর ও পয়লা জানুয়ারি বিপুল চাহিদা থাকে। একই ছবি দেখা যায় দুর্গাপুজোর কয়েকটি দিনে। শুধু কলকাতায় নয়, পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় উৎসব উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ মদ বিক্রি হয়। এই তালিকার শীর্ষে ছিল পূর্ব মেদিনীপুর।

কেন্দ্রীয়স্বাস্থ্য মন্ত্রকের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অন্যান্য রাজ্যে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ মদ্যপান করেন। গত জানুয়ারিতে রাজ্যসভায় দেয়া প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী জানান, ২০১৯–২১ সালের পঞ্চম তথা সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মদ্যপান করেন ২৫.৭ শতাংশ পুরুষ।

এই তালিকায় শীর্ষে গোয়া, প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ সুরাপান করেন। অরুণাচল প্রদেশে ৫৬, তেলেঙ্গানায় ৫০, মণিপুরে ৪৮, ঝাড়খণ্ডে ৪০ শতাংশ পুরুষ মদ্যপান করেন। কিন্তু পাশের রাজ্য বিহারে মদে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখানে মাত্র ১৭ শতাংশ পুরুষের মদ্যপানের কথা উঠে এসেছে জাতীয় সমীক্ষায়। দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে এই হার ১৭ শতাংশের নীচে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমীক্ষার পরে পরিস্থিতি বদলেছে, মদ্যপানের প্রবণতা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

মদ্যপানের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা জনস্বাস্থ্য  ও সমাজে কী প্রভাব ফেলছে, সেটা বিশ্লেষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মনো সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘আমাদের এখানে কখনোই হাই রিস্ক বিহেভিয়ার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা হয় না। শিক্ষাতে কোথাও সেই কারিকুলাম তৈরি করা হয়নি। মদ্যপানকে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। ট্যাবু হিসেবে দেখার বদলে যদি স্বাস্থ্যে এর ঝুঁকির দিকটা দেখা হত, তাহলে মানুষ অনেক বেশি সচেতন করা যেতে পারত। এ জন্য দরকার খোলামেলা, বিজ্ঞানমনস্ক আলোচনা। ছোট থেকেই পড়ুয়াদের এ সম্পর্কে সচেতন করা দরকার।'

তিনি বলেন, ‘মদ্যপান একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গিয়েছে। এখন সরকার মদ্যপানকে উৎসাহিত করছে নানাভাবে রাজস্ব আদায়ের জন্য। উৎসবের উদযাপন এখন মদ্যপান করেই হয়। আইনের তোয়াক্কা না করে কম বয়সীরা মদ্যপান করছেন। তার কারণ, এ বিষয়ে কোনো নজরদারি নেই। যে আইন আছে, মদ আটকাতে সে আইন প্রয়োগ হয় না।'

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা সুবর্ণ গোস্বামী ডিডাব্লিউকে বলেন, "মদ্যপানের ঝোঁক বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশে ফ্যাটি লিভার, সিরোসিস অফ লিভার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে লিভার ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যাও। মদ খেলে ওজন বাড়ে, তাতে হৃদযন্ত্রের সমস্যা বাড়তে পারে। এছাড়া একাধিক অসংক্রামক রোগ আছে, যে ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর মদ্যপান। এখন স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মদ্যপানের ঝোঁক বাড়ছে। এর ফলে ৩০ বছরের নীচে অনেকে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন।"

সরকার এটাকে রাজস্ব সংগ্রহের পথ হিসেবে দেখছে: ডা সুবর্ণ গোস্বামী

This browser does not support the audio element.

তার মতে, "আমাদের দেশের শীতপ্রধান যেসব এলাকা আছে, সেখানে মদ্যপানের প্রবণতা বেশি ছিল। কিন্তু অধিকাংশ এলাকা গ্রীষ্মপ্রধান, সেখানেও এই প্রবণতা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। সরকার এটাকে রাজস্ব সংগ্রহের পথ হিসেবে দেখছে, মদকে সহজলভ্য করে তোলা হচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।"

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা বিভাগের প্রধান সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘পাশ্চাত্যের অনুকরণে যে আধুনিকীকরণ হয়েছে, তাতে সমস্যা রয়েছে। সিগারেট বা মদ্যপানের কুফল ইউরোপের মানুষরা বুঝতে পেরে ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু একই সময়ে আমাদের দেশে মেয়েদের সিগারেট খাওয়া বাড়ছে। যেটা পাশ্চাত্যে ছিল, সেটা এখন আমাদের দেশে এসেছে। নেশার সামগ্রী একইসঙ্গে রাজস্বের উৎস। স্বাধীন সমাজের দোহাই দিয়ে এই ব্যবসা চলতে থাকে। রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত থাকে এগুলি বিক্রি করায়। পশ্চিমবঙ্গে বিপুল আয় মদ বিক্রি করে। ১৮–র বেশি বয়স হলে কেউ অনলাইনে মদ কিনতে পারেন। আগে একটা রাখঢাক ছিল, এত সহজে মদ পাওয়া যেত না। এখন সহজেই কেনা যায়।'

তার বক্তব্য, ‘মানুষের হাতে টাকা বেড়েছে। এর ফলে লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এসেছে। ক্লাব, পাব, ডিস্কোতে যাওয়া উঁচু দরের রুচি হিসেবে ধরা হয়। মধ্যবিত্তরা উচ্চবিত্তদের অনুকরণ করছেন। ঠিক যে ভাবে আমরা সাহেবদের অনুকরণ করছি একটা দেশ হিসেবে, মহিলারা পুরুষদের করছেন, এ ভাবে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হচ্ছে। শরীরে কী প্রভাব পড়ছে, সেটা সাহেবরা দীর্ঘ সময়ে বুঝতে পেরেছেন। ওরা নেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আমাদের সেই পর্যায়ে যেতে সময় লাগবে।'

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ