মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ২০১৯ সালেই জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণা করেছেন৷ অন্যদিকে পূর্ব জেরুসালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী করার স্বপ্নের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইইউ৷
বিজ্ঞাপন
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে এতকাল একযোগে কাজ করার পর দুই পক্ষের মধ্যে বিভাজন অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ গত ডিসেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণা করে ইসরায়েলের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত দেখিয়েছেন৷ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ইসরায়েল সফরে এসে সেই সিদ্ধান্তের দিনক্ষণ ঘোষণা করলেন৷ অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ব জেরুসালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে৷
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স ইসরায়েলের সংসদ ক্নেসেটে তাঁর ভাষণে জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের শেষের মধ্যেই মার্কিন দূতাবাস তেল আভিভ থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তর করা হবে৷ সে সময়ে কয়েকজন ইসরায়েলি আরব সংসদ সদস্য ‘জেরুসালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী' লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছিলেন৷
এদিকে ব্রাসেলসে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনির সঙ্গে আলোচনা করেছেন৷ মোগেরিনি আব্বাসকে বলেন, পূর্ব জেরুসালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী করার স্বপ্নে ইইউ-র সমর্থন রয়েছে৷
আব্বাস ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবার ডাক দিয়েছেন৷ আব্বাস বলেন, ফিলিস্তিনিরা ইইউ-কে সত্যিকারের সহযোগী ও বন্ধু হিসেবে গণ্য করে৷ তাঁর মতে, এর ফলে শান্তি আলোচনার উপর কোনো প্রভাব পড়বে না৷ বরং ফিলিস্তিনিদের মনে শান্তির আশা অটুট থাকবে৷ তিনি ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করেন৷
ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবার আগে আন্তর্জাতিক স্তরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানসূত্র সম্পর্কে ঐকমত্য অটুট ছিল৷ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চূড়ান্ত বোঝাপড়ার আগে তাই কেউ জেরুসালেম শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি৷ ট্রাম্পের একতরফা ঘোষণার ফলে ইউরোপ, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে৷
বিতর্কিত শহর জেরুসালেম
জেরুসালেম বিশ্বের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে বিতর্কিত শহরগুলির অন্যতম৷ ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টান, তিনটি ধর্মের মানুষের কাছে জেরুসালেম একটি পবিত্র শহর৷ এ কারণে জেরুসালেম নিয়ে বিরোধ ও বিতর্ক লেগেই আছে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/S. Qaq
রাজা ডেভিডের শহর
ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবরণ অনুযায়ী, জুডাহ ও ইসরায়েলের রাজা ডেভিড যীশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে জেবুসাইটদের কাছ থেকে জেরুসালেম জয় করেন৷ ডেভিড জেরুসালেমকে তার রাজধানী করেন ও জেরুসালেম তাঁর রাজ্যের ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়৷ বাইবেলে কথিত আছে যে, ডেভিডের পুত্র রাজা সলোমন জেরুসালেমে ইসরায়েলের দেবতা ইয়াওয়েহ’র প্রথম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ও জেরুসালেম ইহুদি ধর্মের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়৷
ছবি: Imago/Leemage
পারস্যের শাসনে
নব্য ব্যাবিলোনিয়ান রাজা দ্বিতীয় নেবুচাডনেজার (বাম থেকে তৃতীয়) খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৭ ও ৫৮৬ সালে জেরুসালেম জয় করেন বলে বাইবেলে আছে৷ তিনি রাজা জেহোইয়াকিম (ডান থেকে পঞ্চম) ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ইহুদিদের বন্দি করে ব্যাবিলনে পাঠান ও ইয়াওয়েহ’র মন্দিরটি ধ্বংস করেন৷ পারস্যের রাজা সাইরাস দ্য গ্রেট ব্যাবিলন দখল করার পর নির্বাসিত ইহুদিদের জেরুসালেমে ফেরার ও মন্দিরটি পুনরায় গড়ে তোলার অনুমতি দেন৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library
রোমক ও বাইজান্টাইন আমল
খ্রিষ্টজন্মের ৬৩ বছর পরে জেরুসালেম রোমক শাসনে আসে, কিন্তু জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ অব্যাহত থাকায় তার তিন বছর পরেই প্রথম ইহুদি-রোমক যুদ্ধের অবতারণা ঘটে৷ চার বছর যুদ্ধের পর রোমকরা জয়ী হয় ও ইহুদিদের মন্দিরটি পুনরায় ধ্বংস করা হয়৷ রোমক আর বাইজান্টাইনরা মিলে প্রায় ৬০০ বছর ধরে জেরুসালেম শাসন করে৷
ছবি: Historical Picture Archive/COR
আরব বিজয়
বৃহত্তর সিরিয়ায় ইসলামের জয়ের পর মুসলিম সেনাবাহিনী জেরুসালেমে পৌঁছায়৷ (ছবিতে) খলিফা উমরের আদেশে ৬৩৭ সালে দীর্ঘ অবরোধের পর জেরুসালেমের পতন ঘটে৷ মুসলিম শাসন চলাকালীন বিভিন্ন গোষ্ঠীর শাসকরা শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত চালান৷ জেরুসালেম একধিকবার অবরুদ্ধ ও বিজিত হয়৷
ছবি: Selva/Leemage
ক্রুসেড
১০৭০ সাল থেকে মুসলিম নেতারা ক্রমেই খ্রিষ্টান জগতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেন৷ শেষমেষ পোপ দ্বিতীয় আর্বান ক্রুসেডের ডাক দেন৷ ২০০ বছরের মধ্যে মোট পাঁচটি ক্রুসেড জেরুসালেম জয়ের জন্য যাত্রা করে৷ কিন্তু ১২৪৪ সালে ক্রুসেডাররা শহরটির নিয়ন্ত্রণ হারায় ও জেরুসালেম পুনরায় মুসলিম শাসনে আসে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
অটোমান ও ব্রিটিশ আমল
অটোমানরা মিশর ও আরব জয় করার পর ১৫৩৫ সালে জেরুসালেম একটি অটোমান জেলার প্রশাসনিক কার্যালয়ে পরিণত হয়৷ অটোমান শাসনের প্রথম কয়েক দশকে শহরটির প্রভূত উন্নতি ঘটে৷ ১৯১৭ সালে অটোমান সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের জয়ের পর ফিলিস্তিন ব্রিটিশ শাসনে আসে ও জেরুসালেম বিনাযুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়৷
ছবি: Gemeinfrei
বিভক্ত শহর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন তার ফিলিস্তিনি সনদ ছেড়ে দেয়৷ অপরদিকে জাতিসংঘ হলোকস্ট থেকে যেসব ইহুদি বেঁচেছেন, তাদের জন্য একটি স্বদেশ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দেশবিভাগের সিদ্ধান্ত নেয়৷ অতঃপর কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ও অংশত জেরুসালেম দখল করে৷ ১৯৬৭ সাল অবধি জেরুসালেমের পশ্চিমাংশ ইসরায়েল ও পুবের অংশ জর্ডানের দখলে ছিল৷
ছবি: Gemeinfrei
পূর্ব জেরুসালেম ইসরায়েলের হাতে ফিরল
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের এক যুদ্ধে ইসরায়েল মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়৷ সাইনেয়াই, গাজা স্ট্রিপ, পশ্চিম তীর, গোলান হাইটস ও পূর্ব জেরুসালেমের দখল করে নেয় ইসরায়েল৷ ইসরায়েলের প্যারাট্রুপার সৈন্যরা ১৯৪৯ সাল যাবৎ প্রথমবারের মতো ইহুদিদের জেরুসালেমের ‘ওয়েলিং ওয়াল’-এ দাঁড়ায়৷ পূর্ব জেরুসালেমকে সরকারিভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগ না করা হলেও, সামগ্রিক প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
জেরুসালেমে মুসলিমদের পবিত্র স্থানগুলি মুসলিমদের জন্য খোলা৷ টেম্পল মাউন্ট একটি স্বশাসিত মুসলিম প্রশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ মুসলিমরা ডোম অফ দ্য রক ও তার সংলগ্ন আল-আকসা মসজিদটি দর্শন করতে পারেন ও সেখানে নামাজ পড়তে পারেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Gharabli
জেরুসালেম নিয়ে বিরোধ
আজ অবধি জেরুসালেমের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ মর্যাদা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তির পথে অন্তরায় হয়ে রয়েছে৷ ১৯৮০ সালে ইসরায়েল গোটা জেরুসালেমকে তার ‘‘চিরন্তন ও অবিভাজনযোগ্য রাজধানী’’ বলে ঘোষণা করে৷ ১৯৮৮ সালে জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমের উপর তার দাবি পরিত্যাগ করার পর ফিলিস্তিন রাজ্য ঘোষিত হয়৷ ফিলিস্তিন রাজ্যও জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী বলে গণ্য করে৷