সংঘাতরত ইরান ও অ্যামেরিকা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করলে কোনো পক্ষই লাভবান হতে পারবে না৷ এ সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷ ডয়চে ভেলের আলোচনায় উঠে এসেছে এমন আশঙ্কার কথা৷
বিজ্ঞাপন
মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহতের পর দুপক্ষই একে অপরকে নানাভাবে হুঁশিয়ারি-হুমকি দিয়ে আসছে৷ কিন্তু দুপক্ষই বলছে, তারা কোনো যুদ্ধ শুরু করতে চায় না৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, সোলেইমানি হত্যার মাধ্যমে অ্যামেরিকা যুদ্ধ শুরু করেনি, বরং যুদ্ধ ঠেকিয়েছে৷ অন্যদিকে, ইরানও এর প্রতিশোধ নিতে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পর পালটা হামলা না হলে আপাতত শান্ত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে৷
এ বিষয়ে ডয়চে ভেলের ফার্সি বিভাগের সাংবাদিক জামশেদ বারজিগর বলেন, ‘‘ইরান যদি মধ্যপ্রাচ্য় থেকে মার্কিন সৈন্য সরানোর দাবির বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তা অ্যামেরিকা মানবে না৷ ফলে আলোচনায় না বসলে এ সংঘাত চলবে৷''
ইরানের বাইরে ইরানের স্বার্থ রক্ষায় সামরিক দিকগুলোর দায়িত্ব ছিল কুদস ফোর্সের৷ সে ফোর্সেরই কমান্ডার ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি৷ ফলে সোলেইমানির মৃত্যুর পর মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার মাধ্যমে কুদস বাহিনী যে দুর্বল হয়ে পড়েনি, এমন একটি বার্তা ইরান বিশ্বকে দিতে চেয়েছে বলেও মনে করেন জামশিদ৷
এমন হামলা-পালটা হামলা, হুমকি, হুঁশিয়ারির বিপদের দিকটাও মনে রাখতে বলছেন ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের সাংবাদিক সঞ্জীব বর্মণ৷ তিনি বলেন, ‘‘এসব করতে করতে যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে, যাতে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে৷ বড় কিছু হলে অ্যামেরিকা বাধ্য হবে আরো বড় আকারের হামলা চালাতে, তখন ইরানও আবার হামলা চালাবে৷''
এর ফলে বিভিন্ন পরাশক্তি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কার কথা জানান সঞ্জীব৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা জানি রাশিয়া ও চীন নানাভাবে ইরানকে সহায়তা করে থাকে৷ এরকম একটি সংঘাতের ক্ষেত্রে তাদের পক্ষেও হাত গুটিয়ে থাকা সম্ভব হবে না৷ তখন যুদ্ধটা বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ এমনকি ইসরায়েল ও সৌদি আরবও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে৷''
সোলেইমানির মৃত্যুর পর শুধু ইরান নয়, এর আশেপাশের বিভিন্ন দেশে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোও প্রতিশোধ নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে৷ এর মধ্যে ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া যেমন রয়েছে, লেবাননের হেজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাসের নামও৷
ফলে জামশেদ মনে করেন আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কুদস ফোর্সের সহযোগী শক্তিরাও চুপ থাকবে না৷ তিনি বলেন, ‘‘সোলেইমানির মৃত্যুর পর আগামী কয়েক মাসের জন্য ইরান কুদস ফোর্সের বাজেট ২০০ মিলিয়ন ডলার বাড়িয়েছে৷ ইরানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে নানা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে৷ ফলে ইরান বার্তা দিতে চায় কুদস ফোর্স এখনও আগের মতো শক্তিশালী রয়েছে এবং সোলেইমানির মৃত্যুতে এর শক্তির কোনো পরিবর্তন হয়নি৷''
আঞ্চলিক সংঘাত শুরু হলে এই শক্তিগুলো কাজে লাগিয়ে শুধু ইরান নয়, ইরানের আশেপাশের বিভিন্ন দেশ থেকেও হামলা-আক্রমণ চালানোর ক্ষমতা রয়েছে বলেও মনে করেন জামশেদ৷
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান৷ সেখান থেকে চিরশত্রুতায় রূপ নিয়েছে তাদের সম্পর্ক৷ কীভাবে এই মেরুকরণ ঘটল দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: gemeinfrei
ইরানের সরকার উৎখাত
১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক৷ তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশটির তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন৷ ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স এবং এবং মার্কিন সিআইএ ক্যু ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে উৎখাত করে৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
শাহের ক্ষমতা আরোহন
মোসাদ্দেকের পতনের পর ক্ষমতায় ফেরেন ইরানের নির্বাসিত শেষ সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি৷ পরবর্তী দুই দশক ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব৷ এক পর্যায়ে মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয় পারস্য উপসাগরের দেশটি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কোন অনুরোধই এসময় ফেলেননি শাহ, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার৷
ছবি: gemeinfrei
ইসলামী বিপ্লব
শাহের আমলে ইরানের তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ ও অ্যামেরিকান কোম্পানিগুলোর৷ ইরানি জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে৷ ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভি৷
ছবি: Getty Images/Afp
খোমেনির ফেরা
দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি৷ তিনি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবের’ নেতৃত্ব দেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেশটির ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে৷ ৪৪৪ দিনের জন্য বন্দী হয় ৫২ অ্যামেরিকান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP/G. Duval
প্রথম অবরোধ
বন্দী সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ দেশটিতে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ও তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷ জব্দ করা হয় ইরানের ১২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ৷ বের করে দেয়া কূটনীতিকদের৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ইরাক-ইরান যুদ্ধ
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হুসেন৷ যুদ্ধ চলাকালে ইরাককে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, অর্থ, সামরিক প্রযুক্তি এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এই যুদ্ধ চলে আট বছর৷ এসময় লেবাননে ইরানের সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হামলায় বৈরুতের একটি ব্যারাকে ২৪৪ অ্যামেরিকান নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/Bildarchiv
ইরানের বিমানে হামলা
১৯৮৮ সালে পারস্য উপসাগরে ইরানের একটি যাত্রিবাহী বিমানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র৷ নিহত হয় ইরানের ২৯০ জন যাত্রী৷ একে দুর্ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান৷ এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক আরও তিক্ততায় রূপ নেয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Taherkenareh
নতুন অবরোধ
ইরান সন্ত্রাসীদের মদত দেয়ার পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, এমন অভিযোগে দেশটিকে একঘরে করার জন্য প্রচার চালায় ক্লিনটন প্রশাসন৷ ১৯৯৬ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ইরানে বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন৷
ছবি: AP
সম্পর্ক সহজীকরণ
১৯৯৮ থেকে পরবর্তী দুই বছর মোহাম্মদ খাতামি সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ করে ক্লিনটন প্রশাসন৷ এজন্য রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়৷ খাতামি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রস্তাব দেন৷ ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷
ছবি: AP
পরমাণু আকাঙ্ক্ষা
২০০৫ সালে আহমদিনেজাদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের আবারও অবনতি ঘটে৷ ইরান এসময় পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে৷ বুশ ইরানকে সন্ত্রাসের রপ্তানিকারক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন৷ তবে ২০১৫ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্র ও জোট রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তিতে বৈরিতার সেই বরফ কিছুটা গলে৷
ছবি: AP
যুদ্ধের দামামা
২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমানু চুক্তি বাতিল করে ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ওয়াশিংটন৷ দুই দেশের প্রক্সি ওয়ার অনেকটাই যুদ্ধাবস্থায় রূপ নিয়েছে চলতি বছরের তিন জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জেনারেল কাসিম সোলেইমানিকে হত্যার পর৷