মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফেরানোর আহ্বান তুরস্ক ও ইরানের
২৫ জানুয়ারি ২০২৪
আংকারায় তুরস্ক ও ইরানের প্রেসিডেন্ট গাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে পদক্ষেপের ডাক দিলেন৷ এদিকে ওয়াশিংটনে বাইডেন প্রশাসন তুরস্ককে যুদ্ধবিমান সরবরাহের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠতা দেখাতে পারে তুরস্ক৷ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতেও পিছপা হয় না সে দেশ৷ অনেক টালবাহানার পর অবশেষে ন্যাটোয় সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে সে দেশ৷ বুধবার আবার প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্কের এমন অভিনব প্রভাব প্রতিপত্তির পরিচয় পাওয়া গেল৷ এদিন তিনি রাজধানী আংকারায় ইরানের প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসিকে স্বাগত জানালেন৷ একই দিনে ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তুরস্ককে এফ-১৬ বিমান বিক্রির লক্ষ্যে কংগ্রেসের অনুমোদন চেয়ে চিঠি লিখলেন৷
এর্দোয়ান ও রাইসি গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তাঁদের মতে, পরিস্থিতির আরো অবনতি এড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন৷ তুরস্ক অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির দাবি জানিয়েছে৷ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের প্রতিও সে দেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে৷ পশ্চিমা সহযোগী ও কয়েকটি আরব দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করলেও তুরস্ক সেই মূল্যায়ন মানে না৷ এ ক্ষেত্রে বরং ইরানের অবস্থানের সঙ্গে এর্দোয়ানের নীতির বেশি মিল রয়েছে৷ ‘প্রতিরোধের অক্ষ' হিসেবে তেহরান হামাস ও হেজবোল্লাহের মতো গোষ্ঠীকে মদত দিয়ে আসছে৷ বুধবারের আলোচনার পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এর্দোয়ান গাজার উপর ইসরায়ের ‘অমানবিক' হামলার কড়া সমালোচনা করেন৷ এমন এক সময়ে এর্দোয়ান ও রাইসির বৈঠক হলো, যখন মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী ইয়েমেনে ইরানের মদতপুষ্ট হুতি বিদ্রোহীদের উপর হামলা চালাচ্ছে৷ গোটা অঞ্চলে ইরান ও ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠার স্থাপনার উপর ইসরায়েল হামলা চালিয়ে আসছে৷
তবে কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও তুরস্কইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি৷ সেই সিদ্ধান্ত এবং সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদতের কারণেও ইরান তুরস্কের সমালোচনা করে এসেছে৷ এর্দোয়ানের সঙ্গে আলোচনার পরেও রাইসি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সব দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রয়োজন আছে৷ আর্মেনিয়া ও আজেরবাইজান সংকটের ক্ষেত্রেও দুই দেশের মতপার্থক্য রয়েছে৷
বাইডেন প্রশাসন প্রতিশ্রুতি মেনে তুরস্ককে অবিলম্বে লকহিড মার্টিন কোম্পানির এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের উদ্যোগ নিচ্ছে৷ প্রায় ২,০০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের বিমানগুলি তুরস্কের সামরিক ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেবে৷ তুরস্কের সংসদ ন্যাটোয় সুইডেনের যোগদান অনুমোদন করার পর এর্দোয়ান এখনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেই আইন স্বাক্ষর করেন নি৷ এফ-১৬ সরবরাহের দিনক্ষণও এখনো স্থির হয়নি৷ অ্যামেরিকার নির্বাচনের বছরে বাইডেন প্রশাসন ও কংগ্রেসের মধ্যে জোরালো বিরোধের কারণে ইউক্রেনের জন্য প্রস্তাবিত সহায়তা আটকে রয়েছে৷ তুরস্কের প্রশ্নে কংগ্রেস কিছুটা নরম অবস্থান নেবে কিনা, তাও এখনো স্পষ্ট নয়৷ একাধিক প্রশ্নে এর্দোয়ান মার্কিন নীতির বিরোধিতা করে আসায় কংগ্রেসে প্রতিরোধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি)
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Taherkenareh
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷